ভাস্কর্য অপসারণে দাবি কি যৌক্তিক?
ওয়াসিম ফারুক
আদিম যুগ থেকেই শিল্পকর্মের পিপাসুদের অনেকেই এই ভাস্কর্য শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, আছেন আজও। থাকবেন ভবিষ্যতেও। তবে মাঝে মধ্যে এদেশে বিভিন্ন সময় ভাস্কর্য নিয়ে বিতর্ক হতে দেখা যায়। এই বিতর্ককে পুঁজি করে পরবর্তীতে অনেকেই রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করে। আন্দোলনে করার অপপ্রয়াস চালায় দেশের ‘কিছু’ সংগঠন ও ব্যক্তি। খুব সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনের সামনের চত্বরে একটি ভাস্কর্য নিয়ে বির্তর্ক সৃষ্টির প্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপিত ভাস্কর্যটি সম্পর্কে হেফাজতে ইসলাম ও তাদের সমমনা আরও বেশ কয়েকটি সংগঠন সেখান থেকে ‘গ্রিক দেবীর’ মূর্তি প্রচার করে তা অপসারণ করার দাবি তুলেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছেÑ মূর্তি ও ভাস্কর্যের মধ্যে আদর্শিক কোনো পার্থক্য আছে ক? ভাস্কর্যের মাধ্যমে একটি গোত্র, বর্ণ, জাতি বা রাষ্ট্রের ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়। মূর্তি বলতে আমরা বুঝিÑ কোনো ধর্মের দেব-দেবীর প্রতিচ্ছবিকে যাকে ধর্মীয় স্বার্থে বা ধর্মীয় বিশ্বাসে পূজা করা হয়। তবে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপিত ভাস্কর্যটিকে মূর্তি বলে যারা প্রচার করছেন, ‘গ্রিক দেবী’ বলে সাধারণ মানুষকে বোঝাচ্ছেন, বিভ্রান্ত করছেন তাদের সেই দাবির সপক্ষে কি কোনো প্রামাণ্য দলিল-দস্তাবেজ আছে? তাদের দাবি কি সত্যিই যৌক্তিক? সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপিত ভাস্কর্যটি একটু বর্ণনা তাহলে দিতেই হয়। শাড়ি পরা মাথায় লম্বা চুলের এক নারী, যার চোখ বাঁধা এক হাতে দাঁড়িপাল্লা, আরেক হাতে তলোয়ার। এটা আসলেই যে কোনো গ্রিক দেবীর মূর্তি নয়, তার প্রথম প্রমাণই হলোÑ মহিলাটি শাড়ি পরা। কোনো গ্রিক দেবীই শাড়ি পরেননি বা পরবেনও না। শাড়ি সাধারণত বাঙালি নারীরই পোশাক। লম্বা চুলÑ তাও সাধারণত বাঙালি নারীর মাথায়ই দেখা যায় বেশি। তাই এটা যে কোনো গ্রিক দেবীর মূর্তি নয়, এটাই সত্য। ওই নারী ভাস্কর্যটির চোখ বাঁধা। অর্থাৎ নিরপেক্ষতার প্রতীক আর এক হাতে আছে দাঁড়িপাল্লা, আরেক হাতে তলোয়ার। তার মনে দাঁড়িপাল্লা ন্যায়বিচারের প্রতীক আর তলোয়ার বিচারের সাজা কর্যকরেরই প্রতীক। অনেক মুসলিম রাষ্ট্রের জাতীয় পতাকা কিংবা বিচারের প্রতীক হিসেবে তলোয়ারের ছবি দেখা যায়।
এদেশের শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে দেশের কিছু সংগঠনের আপত্তি অনেক পুরোনো। যেকোনো আন্তর্জাতিক বিমান কিংবা আন্তর্জাতিক নৌ-বন্দরই একটি দেশের প্রবেশের সিংহদ্বার। তাই ওই সব স্থানে নির্মাণ করা হয় সে দেশের শিল্প-সংস্কৃতির নানান প্রতিচিত্র। ফকির লালন শাহসহ অন্যান্য বাউলেরাও ছিলেন আমাদের সাংস্কৃতিরই একটি বড় অংশ। তাই হযরত শাহজালাল (রা.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনের রাস্তার চত্বরে স্থাপন করা হয়েছিল ‘অচিন পাখি’ নামের বাউল ভাস্কর্য। এই ভাস্কর্যটি সরানো নিয়েও উগ্র মৌলবাদীদের তৎপরতা কম ছিল না। তাদের তৎপরতাই শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছিল। সরকার মৌলবাদীদের ভয়ে ‘অচিন পাখি’ নামের বাউল ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলেছিল তখন।
আফগানিস্তানের তালেবানেরাও ধর্মের দোহায় দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিল বাশিয়ান প্রদেশের দেড় হাজার বছরের বছরের পুরনো জোড়া বুদ্ধমূর্তি। এর আগে আমরা ১৯৯২ সালে দেখেছি ভারতের অযোধ্যায় হিন্দু মৌলবাদীদের তা-ব। প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বাবরি মসজিদ শুধুমাত্র ধর্মীয় উন্মাদনায় মুহূর্তেই সম্পূর্ণরূপে ভূমিস্যাৎ করে দেয়। বাবরি মসজিদ শুধুমাত্র মুসলমানদের একটি মসজিদই ছিল না এটা ভারতের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের চিহ্নও ছিল বটে।
ভাস্কর্য শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মীয় প্রধান দেশেই নয় বিশ্বের অনেক ইসলামিক রাষ্ট্রেও দেখা যায় এমন সৌদি আরবের মতো ইসলামিক রাষ্ট্র যেখানে শরিয়া আইন চালু আছে সেখানেও ভাস্কর্য দেখা যায়। গত বছর সৌদি আরবের ৮৬তম জাতীয় দিবস উপলক্ষে দেশটির বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের ২১৬ বর্গমিটার উচ্চতার সবচেয়ে বড় প্রতিকৃতি উন্মোচন করা হয়েছে যার নির্মাতাও সৌদি চিত্রশিল্পী মোহাম্মদ আসিরি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রতিকৃতি হিসেবে সালমানের ছবিটিকে স্বীকৃতি দিতে ইতোমধ্যে গিনেসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছে সৌদি শিক্ষা বিভাগ। এ ছাড়াও ইরান, মিসর, ইরাকের জাদুঘরে অসংখ্য ভাস্কর্য এবং প্রাচীন শাসক ও দেব-দেবীর মূর্তি তো রয়েছেই, সেসব দেশে উন্মুক্ত স্থানে রয়েছে অনেক ভাস্কর্য। অথচ আমদের এখানে হলেই কিছু মানুষের যত সমস্যা।
উগ্র মৌলবাদী শক্তি কখনোই এদেশের শিল্প-সংস্কৃতি মেনে নিতে পারেনি। এখনও তারই প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। তাদের কর্মকা- তাই প্রমাণ করে। জনতার দাবিÑ এদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে সরকারের প্রতিশ্রুতি দৃশ্যমান হোক। কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করুক। অপশক্তিসমূহের সব অন্যায় আচরণ প্রতিরোধ করবে। প্রতিহত করবে।
লেখক: কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান