বিভিন্ন ইস্যুতে ধর্মঘট : কার লাভ, কার ক্ষতি?
রবিউল আলম
লেখক: মহাসচিব, বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি
জনজীবন দুর্ভোগে নেমে আসুক তা কারও কাম্য নয়। কেউ তা কামনা করে বলেও মনে হয় না। তবু ধর্মঘট করতে হয় কেন? যারা ধর্মঘট করেন তারা কি জনদুর্ভোগের শিকার হনন না, তারা কি এদেশের জনগণ নন?
একজন সচেতন নাগরিক হয়ে কখনো ধর্মঘট জনজীবনকে জিম্মি করে পালন করতে হবে তাও মানতে পারি না ও সমর্থন করতে পারি না। তবুও আমাকে জনস্বার্থ, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও সরকারের সুনাম রক্ষার জন্য ৬ দিন মাংস ব্যবসায়ীদের ধর্মঘট পালন করতে হয়েছে। কিন্তু কোনো নৈরাজ্য করা হয়নি, স্বেচ্ছায় ধর্মঘট হয়েছে। জনদুর্ভোগ বিবেচনা করে স্বেচ্ছায় ধর্মঘট স্থগিত করা হয়েছে। কিন্তু সরকারের দায়িত্বে যারা আছেন তারা কেন মাংস ব্যবসায়ীরা ধর্মঘট করল একবার ডেকে জিজ্ঞাসাও করেননি। কেন এই ধর্মঘট, আরও একটি ধর্মঘটের আশায়, প্রশ্ন উঠতেই পারে। মাংস ব্যবসায়ীরা কি এদেশের জনগণের তালিকায় পড়ে না, কারা বাধ্য করেছেন ধর্মঘটের মতো অশান্ত পরিবেশ তৈরি করতে?
ডাক্তার, সরকারি কর্মচারী, শ্রমিক, মালিক এমনকি পরিচ্ছন্ন কর্মীরাও ধর্মঘট পালন করছেন, কেন এই প্রশ্নের উত্তর আগেই খোঁজা উচিত। জাতির বিবেক, জাতীয় সম্পদ তারেক মাসুদ ও মিশুক মনিরের মতো অমূল্য জীবন সড়ক দুর্ঘটনায় কেড়ে নেওয়া কামনা করতে পারি না, আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ধর্মঘট মানতে পারছি না, সমর্থনও করতে পারছি না।
আইন সবার জন্য সমান এ কথার সঙ্গে আমার দ্বিমত নেই। আইন করার সঙ্গে যারা জড়িত তারা কি বিবেচনা করেন, একজন পরিবহন শ্রমিক, পরিচ্ছন্ন কর্মী বা মাংস শ্রমিক আইনের আশ্রয় নিতে পারে না অর্থের অভাবে, জ্ঞানের অভাবে, আইন সম্পর্কে না জানার কারণে, অর্থ না থাকার কারণে। একজন গাড়ির চালকের উচ্চআদালতে আপিল করার সামর্থ্য আছে কি না তাও খতিয়ে দেখতে হবে। আমি বলছি না অপরাধীরা শাস্তি পাবে না, তাদের আইনের আওতায় আনা যাবে না। আইন ছাড়া দেশ চলবে কিভাবে?
ধর্মঘট প্রত্যাহার হয়েছে, যান চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে, কিন্তু শ্রমিকদের মাঝে কিছু ক্ষোভ রয়েছে, কিছু ভুল থাকবে, এই ভুল বুঝিয়ে শ্রমিকদের মাঝে যারা ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়েছিল তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। দুটি রায় খুব কাছাকাছি হওয়ায় কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি শ্রমিকদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। মৃত্যুদ- পাওয়া মিরু, ঝাউচরের বাসিন্দা খোদেজাকে ব্যক্তিগত ঝগড়া থেকে সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত ট্রাক চালিয়ে হত্যা করেছিলেন। ফাঁসির আদেশটি এমন সময় আসে যখন মিশুক মনির ও তারেক মাসুদের হত্যায় অভিযুক্ত চালক জমির আলীর যাবজ্জীবন কারাদ-ের আদেশ দেওয়া হয়। প্রতিটি শ্রমিকের মাথায় একটি কথা কিভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে, ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদ- নিয়ে গাড়ি চালাব না। তাদের এই একটি কথার সঙ্গে আমিও একমত, মৃত্যুদ-ের আদেশ থাকলে আমিও চালকের পেশায় আসব না। কিন্তু চালকের জন্য মৃত্যুদ-ের আদেশ দেওয়া হয়নি, একজন হত্যাকারী চালকের ভূমিকায় পাশের বাড়ির প্রতিবেশীকে ব্যক্তিগত ঝগড়ার কারণে মাটি ভরা ট্রাক দিয়ে হত্যা করেছে, তাকে কি চালক বলা যাবে? তাকে হত্যাকারী বলে মৃত্যুদ- দিয়েছে আদালত, আমাদের আদালতের পাশে থাকতেই হবে।
আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে, জমির আলী উচ্চ আদালতে যেতে পারবেন। আমরা আশা করব, জমির আলী ন্যায়বিচার পাবেন। আদালত সবার জন্য বিচারের শেষ ভরসা। ধর্মঘট নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। কি কারণে হঠাৎ করে ধর্মঘট, নৌ পরিবহনমন্ত্রীর ভাষায় কর্মবিরতি, যে নামেই বলা হোক না কেন, জনদুর্ভোগ হয়েছে। মন্ত্রীকে নিয়ে অনেক আলোচনা, সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু একটিবারও কি আমরা ভেবে দেখেছিÑ নৌ-পরিবহনমন্ত্রী যদি ফেডারেশনের সভাপতি না থাকতেন, তবে কি এত সহজে কর্মবিরতি শেষ করা যেত, লাইসেন্স বাতিল পরিবহন সিজ করে কি আর জনদুর্ভোগ এড়ানো যেত? পূর্বের অনেক ধর্মঘট দেখার অভিজ্ঞতা আছে আমাদের। বলা হচ্ছে, পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই ধর্মঘট হয়েছে, আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ধর্মঘট করেছে বোকা শ্রমিকরা।
শাজাহান খান আইন না জানা, ধর্মঘটের বিধান না বোঝা শ্রমিকদের রক্ষা করতে এগিয়ে এসে কর্মবিরতি নাম দিয়ে মিডিয়াকে বুঝিয়েছেন, প্রমাণ করেছেন সরকার ও জনগণকে ধর্মঘটের কবল থেকে উদ্ধার করেছেন, সম্ভব হয়েছে ফেডারেশনের সভাপতির দায়িত্বে থাকার কারণে। তবে কথা হচ্ছেÑ ভবিষ্যতে আমরা কোনো ধর্মঘটকেই সমর্থন করব না। এমনকি ইন্টার্নি চিকিৎসকদের ধর্মঘটও না। আশা করি, সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা আগে থেকেই ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
সম্পাদনা: আশিক রহমান