সব চরিত্র কাল্পনিক
কিযী তাহ্নিন
লেখক: কলামিস্ট
আমার ডেঙ্গু হয়েছে। গত দুদিন ধরে হাসপাতালে। শরীরে অসুখ হলে, মন অনেকখানি বিশ্রাম পায়। সেই বিশ্রামের ফাঁকে, ভেবে-চিন্তে অল্প কয়েকজনকে জানিয়েছি অসুস্থতার কথা। শুধু তাদের জানিয়েছি, যারা আমায় খানিকটা গুরুত্ব দিবে, একটিবার দেখতে আসবে, অথবা একটা কল কিংবা ছোট্ট একটি মেসেজ। অসুখ হলে, মন বিশ্রামের পাশাপাশি প্রয়োজনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব ও আকাক্সক্ষা করে।
চোখ দুটো ব্যথায় অস্থির, চোখ বুঁজে থাকলে স্থিরতা খানিকটা আসে। সেই সঙ্গে আছে ভাবনারাও। এ কদিনে জাগ্রত এবং ঘুমন্ত অবস্থায়, যত ধরনের গল্পেরা ভিসিটর হয়ে ভাবজগতে এসেছে, তা লিখে ফেলে একখান বই প্রকাশ করা যেতে পারে, ‘ডেঙ্গুতে পাওয়া গল্প’। ডাক্তার বলছেন ছেড়ে দিবেন দ্রুত। সব ভালোর দিকে। আমিও তাই ভাবছি, শুধু ব্যথামেশানো চোখদুটো বড্ড অস্থির।
আজ সকালে ঘুম ভেঙেছে, ঠিক কয়টাই জানি না। কিন্তু সোনালী রোদের রেখা তেছরা হয়ে সাদা ফিনফিনে পর্দা ভেদ করে, আমার গায়ে জড়ানো শ্যাওলা রঙের কাঁথার ওপর এসে আছড়ে পড়েছে। বুঝলাম বেলা হয়েছে। চোখ ব্যথা এখনো। ব্যথাব্যথা চোখে আধখোলা চোখে ডান পাশে তাকিয়ে দেখি, ‘নাই’ বসে আছে। হাঁটু মুড়িয়ে কোণার চেয়ারে। বালুর পা মুড়ে রেখেছে। দেখা যাচ্ছে না। ব্যথা উপেক্ষা করে পুরো চোখ মেলে দেখি আসলেও ‘নাই’ বসে আছে। আমি হাসলে, কোনো ব্যথা হয় না। তাই বিস্তৃত এক হাসিতে তার দিকে তাকালাম আবার। খানিকটা লজ্জা আর অস্বস্তিও হচ্ছিল। ‘নাই’কে আসলে জানানো হয়নি। যদিও সে গুরুত্বপূর্ণ মানুষের একজন, কিন্তু এ অবস্থায় ক্যাম্পাসের মাঠে যেয়ে তাকে জানানো সম্ভব না বলেই তাকে জানানো হয়নি।
বললাম, ‘কি রে নাই? অবস্থা দেখসিস আমার? যা তা…’ ‘নাই’ কিছু বলে না। তাকিয়ে আছে হালকা চোখে। এই গরমে হলুদ রঙের উলের জ্যাকেট পরা। আমিই বলি, ‘কি রে জ্বর-টর নাকি? এই গরমে উলের গোলা হয়ে আসছিস যে? দেখিস আবার…’। মুখ টিপে হাসল কি না বোঝা যাচ্ছে না, চোখ ব্যথা বন্ধ করি। চোখ বন্ধ রেখেই বলি, ‘তুই আসলি যদি, কথা বলিস না কেন? আর তোকে জানাল কে, যে আমি এখানে?’ নাহ, কোনো কথাই শুনতে পাচ্ছি না। ‘নাই’ কি কথা বলছেই না নাকি আবার কানে তালা লেগে গেল। কিন্তু এইমাত্র টুক করে একটা আওয়াজ পেলাম। ওহ তাইলে কানের তালা তো খোলাই আছে। চোখ আধা মেলে দেখি নার্স এসেছে।
হাতে নাস্তার ট্রে। ভাবলাম ‘নাই’কেও বলি নাস্তা করতে। কিন্তু তাকিয়ে দেখি, নার্স টেবিলের ওপর নাস্তার ট্রে রেখে দ্রুত পায়ে ‘নাই’-এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে সে ‘নাই’-এর পিঠের জামা খামচে ধরে তাকে আকাশে তুলে মাটিতে আছড়ে ফেলে দিল। আমার ব্যথাময় চোখ ছানাবড়া। করুণ চোখে মেঝের দিকে তাকিয়ে দেখি, আমার হলুদ উলের জ্যাকেটটা মাটিতে লুটোপুটি। আমি করুণতর চোখে নার্সের দিকে তাকাই। ‘কালকে খেতে যেয়ে খানিকটা ঝোল পড়ল না? আপনি তো ধুতে দিতে বলেছিলেন। সরিয়ে রাখলাম নিচে। একটু পর এসে নিয়ে যাবে।’
ওহ এই তাইলে ঘটনা। আধা চোখে উলের জ্যাকেটকে তবে ‘নাই’ ভাবছিলাম। সেই তো ‘নাই’ আসবে কোথেকে এখানে। চোখে সর্ষে ফুল, ভাবলাম এখানে ‘নাই’, ব্যথা চোখে, সবই ভুল, চোখের ভুল। এক রত্তি পিচ্চি, ‘নাই’, বালুর পা আর দু-চার কথা বলা এক শিশু মানুষ, কবে নির্লিপ্তভাবে ভাবজগতে বাস করতে শুরু করল, এমন কিছু আমি এখন ভাবছি না। বরং, বিছানায় আসনপিঁড়ি হয়ে খুব মন দিয়ে ডিম সিদ্ধ খাচ্ছি। ভাবজগতে ভিসিটরদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে, কোনো এক ভাবগুরু। আমার মানে ‘আছে’র কানে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন, ‘তোমায় আমি হারাই যদি তুমি হারাও না যে।’
সম্পাদনা: আশিক রহমান