বাংলাদেশের কবিতা ও রাজনৈতিক চেতনায় ৭ মার্চ
মিল্টন বিশ্বাস
বঙ্গবন্ধুর এই শাশ্বত উপস্থিতি বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে কবিদের কবিতার চরণে চরণে। কারণ তার মৃত্যু তাকে আর ভুলতে দেয়নি। ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর যখন এদেশে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দ ছিল প্রায় নিষিদ্ধ, তখন সামরিক শাসনের ভ্রƒকুটিকে তুচ্ছ করে বঙ্গবন্ধুর কথা এই প্রথম এবং প্রকাশ্যে শিল্প-সাহিত্যে উচ্চারিত হয়। যে সময়ে নির্মলেন্দু গুণ ‘বঙ্গবন্ধু’র নাম নিয়েছিলেন সেই সময় বঙ্গবন্ধুর নাম নিতে শুধু সাহসের প্রয়োজন হতো না, দুঃসাহসও প্রয়োজন ছিল। নির্মলেন্দু গুণ জাতির ক্রান্তিকালে সেই দুঃসাহসিক ঘটনায় পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন।’ খোন্দকার আশরাফ হোসেন, গুণের কবিতার দোষগুণ বিবেচনায় তুখোড় জনপ্রিয় এই কবির কবিতায় স্পষ্টতা ও সরল প্রকাশভঙ্গি খুঁজে পেয়েছেন। তবে তিনি স্বীকার করেছেন যে, শৈল্পিক নিষ্ঠা ও প্রাকরণিক দক্ষতা আছে তার কবিতায়। ‘সেই রাত্রির কল্পকাহিনী’তে কবি নির্মলেন্দু গুণ নিজেকে পিতার হত্যার জন্য অপরাধী মনে করেছেন। আর তার মানবিক দিকগুলো তুলে ধরেছেন। বন্দুকের নল ও গুলির চেয়ে মানুষের বেঁচে থাকাকে সত্য বলে মেনেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
তোমার বুক প্রসারিত হলো অভ্যুত্থানের গুলির অপচয়
বন্ধ করতে, কেননা তুমি তো জানো, এক-একটি গুলির মূল্য
একজন কৃষকের এক বেলার অন্নের চেয়ে বেশি।
কেননা তুমি তো জানো, এক-একটি গুলির মূল্য একজন
শ্রমিকের এক বেলার সিনেমা দেখার আনন্দের চেয়ে বেশি।
মূল্যহীন শুধু তোমার জীবন, শুধু তোমার জীবন, পিতা। (কাব্যসমগ্র-১, ২০১১: ২৭৮)
কবি নিজেই বলেছেন, ‘আমি জানি, সংগ্রামই সত্য, সংগ্রামই সুন্দর। প্রেম, সেও এক সংগ্রাম।’ তার কবিতায় সংগ্রাম ও প্রেমের সুন্দর অভিব্যক্তি রয়েছে; আবার নিজের মনোজগতের আকাক্সক্ষা অভিদ্যোতিত হয়েছে বিচিত্রভাবে। যেমন ‘রাজদ-’ কবিতায় তিনি লিখেছেন-
১৯৭৫ এ আমি হারিয়েছি আমার প্রতীক, শৌর্যবীর্যধারা, অন্ধকারে।
তারপর থেকে ভিতরে ভিতরে একা, গৃহহারা। স্বপ্নহীন ক্ষোভে
বসে থেকে থেকে ঘুমে ঘুমে, আত্মগোপনে গোপনে ক্লান্ত।
একটা কিছুকে উপলক্ষ্য করে আবার দাঁড়াতে চাই;
বাংলার মাটি বাংলার জল আমাকে কি নেবে? (কাব্যসমগ্র-১, ২০১১: ২৫০)
পশ্চিমবঙ্গে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি সরাসরি পঙ্ক্তিবদ্ধ করে তাকে নিয়ে প্রথম কবিতা লেখেন দক্ষিণারঞ্জন বসু ১৯৭০ সালের ১২ ডিসেম্বর। বাংলাদেশে নির্মলেন্দু গুণের পর দ্বিতীয় কবিতাটি জসীম উদ্দীনের ‘বঙ্গবন্ধু’ রচিত হয় ১৯৭১ সালের ১৬ মার্চে। তৃতীয় কবিতাটি ১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল হাবীবুর রহমান রচনা করেন ‘বঙ্গবন্ধু তুমি আছ বলে’ শিরোনামে (প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি দৈনিক আজাদে)। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ একাকার হয়ে গিয়েছিল ১৯৭১-এর ২৬ মার্চের পর। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে অনেকেই কলম তুলে নিয়েছিলেন। আবেগের প্রাবল্যে আর মুক্তিযুদ্ধের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশের সময় বঙ্গবন্ধু অন্তরালে থাকেননি। আবার বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দুই বাংলার কবিতায় মুক্তিসংগ্রামের ঘটনা ঠিক ঠিকভাবে চিত্রিত হয়েছে। হাবীবুর রহমানের ‘বঙ্গবন্ধু তুমি আছ বলে’ কবিতায় নেতার নামে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, তার স্মরণে শত্রুকে মোকাবিলার অকুতোভয় পরাক্রম চিহ্নিত হয়েছেÑ
বঙ্গবন্ধু, তুমি আছ বলেÑ
বিভীষিকাময় অন্ধকারের শব ঠেলে ঠেলে
প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তের মৃত্যুকে উপেক্ষা করে
আমরা এগিয়ে চলি উদয়াচলের পথে,
. . . . . . . . .
বঙ্গবন্ধু তুমি আছ বলেÑ
আমরা অসহযোগ করি, শয়তানের কুচক্রের সাথে
ঘরে ঘরে দুর্জয় শপথের উত্তাপে শাণিত করি প্রহর। (দুই বাংলার কবিতায় বঙ্গবন্ধু, ২০০৫: ৪৬)
স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের সার্বভৌম রাষ্ট্রের আঙিনায় বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় কবি লিখলেন কবিতা। সিকান্দার আবু জাফর ও আবুবকর সিদ্দিক জাতির জনকের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে লিখেছেন ‘সে নাম মুজিব’ এবং ‘প্রশ্ন’ কবিতা। এ ধারা যখন আরও বেগবান হওয়ার অপেক্ষায় তখনই এলো ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট। নৃশংস হত্যাকা- ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মধ্যে মানুষের অস্তিত্ব যখন বিপন্ন তখনো কবিদের আবেগ ও ভালোবাসা থেমে থাকেনি। নির্যাতনের ভয়ে প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকলেও কবিদের বিবেকের তাড়না সত্য ছিল। ১৯৭৬ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত ‘স্বাধীনতা’ নামক সংকলনে মৃণাল সরকার ‘স্নায়ুতে উদ্ধার খুঁজি’ কবিতাটি সরকার মুজিব বিন ছদ্মনামে লেখেন-
এই সেদিনও তো রাজ্য ছিল
সোনার সংসার ছিল
পা-বেরা রাজা ছিল
হায়! যুধিষ্ঠির চলে গেলে
ছারখারে ছাই হয় সোনার সংসার।
কামাল চৌধুরী ১৯৭৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি রচনা করেন ‘জাতীয়তাময় জন্মমৃত্যু’ কবিতাটি। পঁচাত্তরের পৈশাচিক ঘটনা নিন্দার শৈল্পিক অভিব্যক্তি এ কবিতা-
রক্ত দেখে পালিয়ে গেলে
বক্ষপুরে ভয়
ভাবলে না কার রক্ত এটা
স্মৃতি গন্ধময়?
দেখলে না কার জন্মমৃত্যু
জাতীয়তাময়!
বলা হয়ে থাকে এটিই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর স্বনামে লিখিত প্রথম কবিতা। ১৯৭৭ সালে ছাত্র ইউনিয়নের একুশের স্মরণিকা ‘জয়ধ্বনি’তে এটি প্রকাশিত হয়। এর আগে প্রকাশিত বিভিন্ন সাময়িকী ও স্মরণিকার কবিতাগুলো ছিল ছদ্মনামে। ‘গণসাহিত্য’ সাময়িকীর ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর সংখ্যা, ১৯৭৬ সালের ছাত্র সমাজের একুশের স্মরণিকা ‘স্বাধীনতা’য় এবং ১৯৭৬ সালের কমিউনিস্ট পার্টির ‘একুশের স্মরণিকা ৭৬’-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। অবশ্য ১৯৭৭ সালের ৩ নভেম্বর সাহস বাড়িয়ে দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত আবুল ফজলের ‘মৃতের আত্মহত্যা’ গল্পটি সমকালে প্রকাশিত হলে। সামরিক সরকারের উপদেষ্টা হবার পরেও তার এ ধরনের গল্প রচনা কবিদের আরও সাহসী করে তোলে। একই বছর সমকালে (মাঘ, ১৩৮৪) মোহাম্মদ রফিকের একটি কবিতা ছিল এ রকমÑ
আগস্টের পনের তারিখ উনিশ’শ পঁচাত্তর. . .
অতর্কিত শিকারীর পদশব্দে অরণ্য শঙ্কিত.. .
বাঙালির শুদ্ধ নাম শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্য তরুণ গোষ্ঠীর একুশের স্মরণিকা ‘এ লাশ আমরা রাখব কোথায়’ প্রকাশিত হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এটি ছিল প্রথম প্রতিবাদী কবিতার সংকলন। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে কাজটি ছিল দুঃসাহসিক। এ সংকলনটি ছিল ৩০টি ছড়া ও কবিতার সমাবেশে সামরিক শাসনকে উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের অসাধারণ নিদর্শন। অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা’ দিয়ে শুরু করে যথাক্রমে সূচি ছিল এ রকমÑ দিলওয়ার(ছড়া), হায়াৎ মামুদ(মুজিবের এপিটাফ), রাহাত খান(যখন সময় হবে), মাশুক চৌধুরী(চিৎকার), ফরিদুর রহমান বাবুল(ছড়া:সাম্প্রতিক), সুকুমার বড়–য়া(৭ মার্চ), মোহাম্মদ মোস্তফা(আবার আসে ‘বাং-কর্ণো’), আমিনুল ইসলাম বেদু(প্রণাম, তোমাকে বঙ্গবন্ধু), মাহমুদুল হক(বকুল গন্ধ বাঘের চোখে), নির্মলেন্দু গুণ(মুজিব মানে মুক্তি), তুষার কর(বঙ্গবন্ধুর জন্যে), আলতাফ আলী হাসু(অঙ্গীকার), মোহাম্মদ রফিক(ব্যাঘ্র বিষয়ক), আবদুল আজীজ(সরম লাগার ছড়া), শান্তিময় বিশ্বাস(পিতার জন্য), ভীষ্মদেব চৌধুরী(পিতা: তোমার জন্যে), আখতার হুসেন(সোনার বরণ ছেলে), জিয়াউদ্দিন আহমদ(শেখ মুজিব), জাহিদুল হক(গোলাপ), ইউসুফ আলী এটম(ছবির ছড়া), সিরাজুল ফরিদ(ছড়া), ফজলুল হক সরকার(শেখ মুজিব), মহাদেব সাহা(আবার আসিব ফিরে), জাফর ওয়াজেদ(একটি মুজিব), লুৎফর রহমান রিটন(একটি ছেলের কথা), নুর-উদ-দীন শেখ(সেই ছেলেটি), ওয়াহিদ রেজা(জাতির পিতা), কামাল চৌধুরী(একজন প্রেমিকের কথা), খালেক বিন জয়েন উদ্দীন(রাখাল রাজার জন্যে)। এসব কবিতা-ছড়ায় কেবল সেøাগান ছিল না, ছিল আবেগ ও অনুভূতির প্রগাঢ় প্রকাশ। ব্যঞ্জনাত্মক সেই অভিব্যক্তির কিছু দৃষ্টান্ত নিম্নরূপ:
ক) নদী ছলো ছলো নাম বহমান, বাঁধ দিতে আসে কে?
বাতাস বৈরী গুমোট হাওয়া তবু গাবো তার জয়
ফুলেল জলসা তোমার জন্যে রক্ষিত আছে পিতা
জয় বাংলার বঙ্গবন্ধু অবিনাশী অক্ষয়।
খ) আবার আসিব ফিরে এই বাংলায়
কোনো শংখচিল নয়, শেখ মুজিবের বেশে
হেমন্ত কুয়াশা আর এই প্রিয়, মানুষের দেশে। (চলবে-৪)
লেখক: অধ্যাপক এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান