কোটায় বন্দী নারী, বৃত্তে বন্দী দিবস
কাকন রেজা
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
নারী দিবসে ‘উইমেন মার্চ’ দেখলাম। সম্মুখ দর্শন নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। হাসিমাখা সেলফির ‘মার্চে’ ভরপুর নিউজফিড। হাসিমুখে বিপ্লব কিন্তু বড় কঠিন জিনিস। বেতালা কিসিমের একজন বললেন, ‘উইমেন মার্চ তো দেখলাম, কিন্তু এতে ‘হিউমেন’ কই! এটা হওয়া উচিত ছিল ‘হিউমেন মার্চ’। তার এমন সব বক্তব্যের মূল সারাংশ ছিল, মানুষই প্রতিবাদ করে জুলুমের বিরুদ্ধেÑ তা হোক নারী, পুরুষ, বৃহন্নলা কিংবা প্রাণীকূলের যে কারও সঙ্গে। মানুষের পদযাত্রায় জুলুম আর অনাচারের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠলে সেটা হয়ে ওঠে ‘হিউমেন মার্চ’, জনতার মিছিল। জুলুমের বিরুদ্ধে, বর্বরতার বিরুদ্ধে যুথবদ্ধ আওয়াজ।
বিভ্রান্ত হলাম, সত্যিকারার্থেই মিছিলের ব্যানারে ‘শোভিত’ বক্তব্যের সঙ্গে এই ‘মার্চে’র কোনো হৃদ্বিক মিল নেই দেখে। অনেকটা পহেলা বৈশাখের ‘শোভাযাত্রা’র মতো আনন্দে উচ্ছল! মে দিবসকে ‘মহান’ আখ্যা দিয়ে যেমন আমাদের শ্রমিককূল মাতেন ‘হোলি’তে। যার ফলে ‘মহান’ শব্দটাই প্রশ্নবোধক হয়ে যায়। দাবি আদায়ের দিবস, রক্তধারায় দাবি আদায়ের দিন, আমাদের কাছে অনায়াসে হয়ে যায় ‘উৎসবের দিন’! এবারের নারী দিবসের ‘মার্চ’ আমাকে তেমন কথাই স্মরণ করিয়ে দিল। ‘নারী দিবস’ নিয়ে বেশকিছু লেখাও পড়লাম কাগজে এবং সেলফোন ও ল্যাপটপের পর্দায়। প্রতিটি লেখায় দেখলাম উষ্মা আর ক্ষোভ। না পাওয়ার উষ্মা, অত্যাচারিত হওয়ার ক্ষোভ। আর সেই ক্ষোভ মূলত পুরুষদের বিরুদ্ধে। প্রতিটি লেখায় নারী যে পুরুষের সমান এবং কারও মতে সমান না হলেও খুব একটা কম নয় এমন প্রমাণ করার নানা চেষ্টাচরিত্র। কেউ আরেকটু আগ বাড়িয়ে ধর্মে নারীর স্থান, জায়া-জননীদের ত্যাগ, এসবকে টেনে ‘যে রাধে সে চুলও বাঁধে’ এমন ভাষায় নারীকে পুরুষের কিছুটা উপরের জায়গা ঠাঁই দিতে চেয়েছেন। অনেকটা রেলের কামরায় ঠেলে উপরের সিটে তুলে দেওয়ার মতোন। কিন্তু আশ্চর্যের কথা হলো, একজনের লেখা বাদে আর কোনো লেখায় নারীকে ‘হোমো সেপিয়েন্স’ প্রজাতি বলে স্বীকৃতি দিতে দেখলাম না। নারীকে ‘মানুষ’ বলতে শুনলাম না। তবে ‘মানুষ’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দেখলাম। ব্যাকরণের বৈষম্য নিয়েও কথা হলো। কিন্তু কেউ বললেন না, মানবের বিপরীত বা লিঙ্গান্তরিত শব্দ হলো মানবী, পুরুষের নারী, কিন্তু ‘মানুষ’ শব্দটির কোনো লিঙ্গান্তর হয় না।
‘অধিকার’ নিয়ে এত কথামালা, এত ‘গপ্পোবাজি’। সম্মান নিয়ে, শ্রদ্ধা নিয়ে এবং এসবের না পাওয়া নিয়ে হাহুতাশ। কেন ‘নারীরা পায় না’ এমন রাগী জিজ্ঞাসা অনেকের। নারীদের জন্য কেন আলাদা করে কোনোকিছু রাখা হয় না, যেমন সংসদের আসন রাখা হয়, বাসে সিট রাখা হয়! তেমন কেন সব জায়গায় রাখা হয় না, এমন আক্ষেপও দেখি অনেকের। বিস্মিত হই, ‘সংখ্যালঘু’ শব্দের আপত্তিজনক কোটায় মানুষকে ‘নারী’ নামে বৃত্তবন্দী হতে দেখে।
‘কোটা প্রথা’য় বন্দী আমাদের নারীকূল! দিবসভিত্তিক ‘প্রতিবাদ’ এখন মূল প্রতিপাদ্য নারীবাদীতার! যেমনÑ কোটা প্রথায় বন্দী আমাদের সাঁওতাল, চাকমা, মারমা, হাজং। এরা সব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। আগে বলা হতো উপজাতি। নারীরাও কি তাই? তা না হলে তাদের সমতার দাবি করতে হয় কেন! নারীদেরও কি তবে ‘সংখ্যালঘু’, ‘উপজাতি’ কিংবা ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে? নারীরা কি তবে ‘মনুষ্যকূলে’র বাইরের কিছু!
আমাদের বৈপরীত্য সবখানে। আমরা মানুষ চিহ্নিত করি না, সংখ্যা চিহ্নিত করি, দুর্বলতা চিহ্নিত করি। আমরা বলিÑ এ ধর্মের লোক সংখ্যায় কম, এই জাতের লোক সংখ্যায় কম, এই সম্প্রদায়ের মানুষ সংখ্যায় কম। সুতরাং এদের জন্য প্রয়োজন কোটার! আমরা মানুষকে নারী ও পুরুষে বিভাজন করি। বলি নারীর শক্তি কম, নিগৃহীত, অত্যাচারিত অতএব তাদেরও ‘কোটা’ বন্দী করা হোক। নারী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, ধর্মাচারে আমরা বিভক্ত হই। আমরা মানুষ হিসেবে এক হই না। আর এটাই হলো কথিত নারীবাদের সঙ্গে সত্যিকার ‘বোধের’র মূল সংঘাত।
সঙ্গত না হলেও বৈপরীত্যের আরেকটি উদাহরণ দিই। আমরা সাঁওতালদের ঘরে আগুন লাগানোর প্রতিবাদ করি, কিন্তু যখন তাদের অস্তিত্বের মূলে আগুন লাগানো হয় তখন চুপ থাকি। আদিবাসী, উপজাতি সবশেষ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কতভাবেই না ডাকা হয় সাঁওতাল, চাকমা, মারমা, ম্রং, গারো, হাজং ও অন্যান্যদের। তাদের নিজস্ব জাতিসত্তা মুছে দিয়ে পরিচিতি পাল্টে দেবার ‘কৃত্রিম’ চেষ্টা চলে। অস্তিত্বের মূলে আগুন দেওয়ার এবং বিনাশের এমন আয়োজনে প্রতিবাদীরা সব নিশ্চুপ। উল্টো বলেন, ‘বেশ তো, বেশ তো’! আহারে প্রতিবাদ, বাহারে বৈপরীত্য!
যাই হোক আবার আসি ‘নারী দিবস’ বিষয়ে। দিবসভিত্তিক নারী প্রেমের সাতকাহনে। একজনের লেখা পড়লাম। তার বক্তব্য হলোÑ ইদানিং পুরুষরা ‘লেডিজ ফার্স্ট’ জাতীয় ভদ্রতার বিষয়টিও ভুলে গেছে। বোঝেন অবস্থা, তারা যে মানুষ নয়, তারা ‘লেডিস’ এ কথাটা পুরুষকে আর কষ্ট করে বলে দিতে হলো না। মাঝেমধ্যে মনে হয়, ‘কেউ কেউ অত্যাচারিত হতেও ভালোবাসে’! নারী দিবসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিউজফিডও সয়লাব ‘শুভেচ্ছা’ বাণীতে। এমন শুভেচ্ছায় অনেকে অনুভূতির প্রকাশে বলেছেন, ‘আমার সাফল্যের পেছনে প্রেরণা তুমি হে নারী, তাই শুভেচ্ছা তোমাকে’। এসব পড়ে বড় আনন্দ লাগল। বুঝলাম, নারীরা তাদের পুরুষ বানিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মানুষ বানিয়েছে কী?
ফুটনোট: আমাদের মতো দিবসপ্রেমী পৃথিবীতে দুর্লভ। প্রতিটা দিবস, তা হোক হাতধোয়া দিবস, সাবান দিবস, লবন দিবস; আমরা প্রবল উৎসাহে ‘দিবস’ পালন করি। তবে ‘হাতধোয়া দিবস’টি আমাদের সবচেয়ে ফেভারিট। আমরা বছরে একদিন বিশেষ দিবস পালন করি, তারপর? তারপর আবার কী, হাত ধুয়ে ফেলি!
পুনশ্চ: বারবার বলি, আবারও বলছিÑ নারীদের ‘পুরুষ’সম হবার প্রচেষ্টা বাদ দিয়ে ‘মানুষ’ হবার চেষ্টা করতে হবে। যা উচ্চকণ্ঠ নারীদের অনেকের মধ্যেই চোখে পড়ে না। কথিত নারীবাদীদের মধ্যেও না। এরা বোধহয় জানে না, ‘মানুষ’ শব্দটির ‘লিঙ্গান্তর’ হয় না। সব পুরুষই মানুষ হয় না, এটাও অনেকে বুঝতে চায় না। নারী কিংবা পুরুষ নয়, মানুষ হলে এমনিতেই সম্মান ও শ্রদ্ধা তার অধিকারে চলে যায়।
সম্পাদনা: আশিক রহমান