প্রশিক্ষণ নিচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে একের পর এক অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে জঙ্গিরা
ইসমাঈল হুসাইন ইমু: আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া অবস্থানের পরও জঙ্গিরা তাদের অস্তিত্ব ধারাবাহিকভাবে জানান দিয়ে আসছে। সম্প্রতি টঙ্গীতে নিষিদ্ধ হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের (হুজিবি) শীর্ষ নেতা কারাবন্দী মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টার ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই কুমিল্লার চান্দিনায় গ্রেনেড ও ছুরিসহ জসিম (২২) ও হাসান (২৪) নামের দুই জঙ্গিকে আটক করা হয়েছে। এসব ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের। তারা বলছেন, আটক দুই যুবক নব্য জেএমবির সদস্য। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার গ্রেনেডগুলো এ যাবৎকালের সবচেয়ে শক্তিশালী গ্রেনেড। দুই কেজি ওজনের একেকটি গ্রেনেড দিয়ে বড় ধরনের হামলা করা সম্ভব। পরপর দুটি ঘটনায় হঠাৎ নিরাপত্তা হুমকিতে উদ্বিগ্ন খোদ গোয়েন্দারা। তবে সরকার বলছে জঙ্গিরা নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, কারাগার থেকে আদালতে নেওয়ার পথে প্রিজনভ্যানে হামলা চালিয়ে মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনার বিষয়টি বেশ কদিন আগেই জানতে পারে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজিবি) এবং আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) যৌথভাবে এ মিশনে অংশ নেবে এ তথ্যও তাদের হাতে আসে। যা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে সিটিটিসির গোয়েন্দারা।
এদিকে ২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজনভ্যানে হামলা চালিয়ে এক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে তিন জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার পর দুর্র্ধর্ষ আসামিদের আনা-নেওয়ার পথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার তাগিদ দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু মুফতি হান্নানকে বহনকারী ভ্যানে কিভাবে ককটেল হামলা হলো তা ভাবিয়ে তুলেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। উদ্বেগজনক এ পরিস্থিতিতে র্যাব-পুলিশকে বিশেষভাবে সতর্ক করা হয়েছে। জঙ্গিগোষ্ঠীর শক্তি-সামর্থ্য ও গোপন সাংগঠনিক তৎপরতা সম্পর্কে সব ধরনের তথ্য সংগ্রহের জন্য গোয়েন্দাদের বিশেষ অভিযান চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে কারাবন্দি জঙ্গি নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা জোরদারের পাশাপাশি জামিনে থাকা জঙ্গি সদস্যদের অবস্থান দ্রুত চিহ্নিত করতে বলা হয়েছে। তাদের নেপথ্য মদদদাতা ও অর্থদাতাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার সর্বোচ্চ তাগিদ দেওয়া হয়েছে। জঙ্গিদের সঙ্গে রাজনৈতিক কোনো দলের সম্পৃক্ততা রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দারা।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, হিযবুত তাহরির, হিযবুত তাওহীদ ও জেএমবির বিপুলসংখ্যক সদস্য জামিন পাওয়ার পরে লাপাত্তা হয়ে গেছে। জামিনপ্রাপ্তদের অল্প কয়েকজন আদালতে নিয়মিত হাজিরা দিলেও বেশিরভাগই ঠিকানা বদল করে আত্মগোপনে রয়েছে। তাই পুরনো ঠিকানায় আদালতের সমন পাঠিয়ে কোনো লাভ হচ্ছে না। আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখায় তারাও তাদের ব্যাপারে কিছু বলতে পারছেন না।
জানা গেছে, ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে হিযবুত তাওহীদের সদস্য আনিছুর রহমান সাকির, নুরুল ইসলাম সজল, রাজু আহম্মেদ, এবিএম রায়হান সরকার রাজধানীর দক্ষিণখান থানা এলাকা থেকে গ্রেফতার হয়। এ ঘটনার ব্যাপারে যথারীতি মামলা দায়ের করা হয়। পরে তারা জামিনে বেরিয়ে এসে নিজেদের ঠিকানা বদল করে ফেলে। উধাও হওয়া জঙ্গি সদস্যদের তালিকায় আরও রয়েছে শ্যামপুর থেকে গ্রেফতারকৃত জেএমবি সদস্য সৈয়দ জিয়াউল ইসলাম ওরফে লিয়ন ওরফে রোকন ওরফে জিতু ওরফে উজ্জল ওরফে হিমু। জামিন পাওয়ার পর থেকে তিনি উধাও।
অপরদিকে গত এক বছরে চট্টগ্রামে তেমন কোনো জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালায়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাই দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকা হুজি সাম্প্রতিক সময়ে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। প্রিজনভ্যানে হামলা চালিয়ে কারাগারে থাকা হুজির শীর্ষ নেতাদের মুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়ে সংগঠনটির নেতারা চট্টগ্রামে ফের অবস্থান করছিল।
নিষিদ্ধ ঘোষিত এই সংগঠনটির আস্তানায় আসার কথা ছিল চট্টগ্রামের আঞ্চলিক কমান্ডারেরও। সংগঠনটির নেতাদের উদ্দেশ্য ছিল দেশের যেকোনো অঞ্চলে সুযোগ বুঝে প্রিজনভ্যানে আক্রমণ করে শীর্ষ নেতাদের মুক্ত করা।
২০১৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর বন্দরনগরীর সদরঘাট থানার মাঝিরঘাটে সাহা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে ছিনতাইয়ের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে জেএমবি সদস্যদের সন্ধান পায় পুলিশ।
নগর গোয়েন্দা পুলিশ ওই বছরের ৬ অক্টোবর কর্ণফুলী থানার খোয়াজনগরে একটি বাড়িতে অভিযান চালায়। অভিযানে পুলিশের ওপর গ্রেনেড হামলার চেষ্টা করে চট্টগ্রামের নব্য জেএমবির ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’ জাবেদ। পুলিশ জানায়, তিনি পরদিন গ্রেনেড বিস্ফোরণে মারা যান।
এর কিছুদিন পর নৌবাহিনীর ঈশা খাঁ ঘাঁটির একটি মসজিদে বোমা হামলা হয়। তদন্তের মধ্যে ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর ভোরে হাটহাজারি উপজেলার আমান বাজারের একটি বাসায় জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় গোয়েন্দা পুলিশ। সেখান থেকে সেনাবাহিনীর পোশাক, স্নাইপার রাইফেল এবং গুলি ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। নাফিজ নামে এক যুবক নিজেকে ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে বাসাটি ভাড়া নিয়েছিল বলে বাড়ির মালিক দাবি করেন।
কিন্তু পুলিশ জানায়, নব্য জেএমবির চট্টগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার ফারদীন বাসাটি ভাড়া নিয়েছিল। দীর্ঘদিন ফারদীনের খোঁজে থাকার পর গত বছর বগুড়ার একটি বাসায় বোমা বিষ্ফোরণে ফারদীনের নিহত হওয়ার খবর দেয় পুলিশ।