ভাস্কর্য সরানোর দাবি কি যৌক্তিক? ভাস্কর্য সরানোর দাবি হেফাজতে ইসলামের একটি গভীর ও সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র
শাহরিয়ার কবির
সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গন থেকে ভাস্কর্য সরানোর দাবি সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রোনোদিত ও রাজনৈতিক। মতলববাজী দাবি। প্রথম কথা হচ্ছেÑ সুপ্রিম কোর্টে যে ভাস্কর্য রয়েছে সেটা কোনো গ্রিক দেবী নয়, এটা হচ্ছে ভাস্কর্য। এই ভাস্কর্যটিকে বিবেচনা করা হয় ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে। এটা শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর বহু দেশেই রয়েছে। এমনকি ইসলামী রিপাবলিক অব ইরান, যেখানে শরিয়াহ আইন আছে। সৌদি আরব থেকে শুরু করে সমস্ত মুসলিমপ্রধান দেশেও ভাস্কর্য রয়েছে। মুসলিমপ্রধান কোনো দেশে কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো ভাস্কর্য নিষিদ্ধ করেনি। সৌদি আরবে ভাস্কর্য আছে, মিসরে আছে, তুরস্কেও রয়েছে, ইরাকে, ইরানেও আছে, পাকিস্তানে ও ইন্দোনেশিয়াতে ভাস্কর্য রয়েছে। কোন মুসলিমপ্রধান দেশে ভাস্কর্য নেই?
হেফাজতে ইসলাম ভাস্কর্য অপসারণের জন্য যা করছে তা অনাকাক্সিক্ষত। ভাস্কর্যকে মূর্তি নাম দিয়ে তা সরানোর কথা তারা বলছেন। মূর্তিকে পূজা করা হয়। কিন্তু কেউ কি সুপ্রিম কোর্টের ভাস্কর্যে পূজা করে? ভাস্কর্য সরানোর দাবি হেফাজতে ইসলামের একটি গভীর ও সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র বলেই মনে করি আমি।
হেফাজতের বিচার করার সময় এসেছে, একাত্তরের গণহত্যা এবং সাম্প্রতিককালে তাদের যে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সঙ্গে সম্পৃক্ততার জন্য। আমরা গত বছর স্বেতপত্র বের করেছিলাম। স্বেতপত্রে আমরা দেখিয়ে দিয়েছি যে, হেফাজতের শীর্ষ নেতারা একাত্তরের মানবতা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কেউ নেজামী ইসলাম করেছেন, কেউ জামায়াতে ইসলাম করতেন, কেউ মুজাহিদ বাহিনীর সংগঠন করেছেন। এইভাবে তারা মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমরা মহামান্য ট্রাইব্যুনালকে বলেছি, সরকারকে বলেছি যে, এই সংগঠনের বিচার করতে হবে। এখন সংগঠনের বিচার শুরু হলেই হেফাজতের আহমেদ শফি থেকে শুরু করে অনেককেই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। সেখান থেকে তারা এখন জনগণের দৃষ্টি সরাবার জন্য কখনো পাঠ্যবইয়ের সংস্কারের জন্য, কখনো ভাস্কর্যকে মূর্তি বানিয়ে সেটা সরানোর দাবি জানাচ্ছে। এগুলো সব রাজনৈতিক মতলববাজি। এটা করছে তারা ওই মামলা থেকে বাঁচার জন্য। যদি তারা গ্রেফতার হন তখন তারা বলবেন, ইসলামের জন্য তারা আন্দোলন করেছেন বলেই তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এটা তাদের একটা কৌশল। এবং সরকার যদি তাদের কাছে নতি স্বীকার করে তাহলে সর্বনাশের আর বাকি থাকবে না।
এখানে সুপ্রিম কোর্টকেও হেফাজতের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ, সুপ্রিম কোর্টের সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করছে তারা। সুপ্রিম কোর্ট একটা স্বাধীন সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান। এই সিদ্ধান্তটা সুপ্রিম কোর্টের থেকে নেওয়া হয়েছে। এখানে সরকারেরও কিছু করার নেই। সরকার যদি এটা সরাতে যায় তাহলে তো আমরা আদালত অবমাননার জন্য দায়ী করব সরকারকে। সুপ্রিম কোর্টকেও এ ব্যাপারে ভূমিকা নিতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গনে স্থাপিত এই ভাস্কর্য নিয়ে যারা হুমকি দিচ্ছেন সুপ্রিম কোর্টের বিরুদ্ধে, সংবিধানের বিরুদ্ধে, আমাদের সংবিধানে কোথায় লেখা আছে যে, ভাস্কর্য থাকতে পারবে না। এমনকি ইসলামের কোথায় আছে। সৌদি আরবের বাদশা ইন্দোনেশিয়া ভিজিট করতে গিয়েছিলেন। বালিতে অনেক হিন্দুদের মূর্তি রয়েছে। রাস্তায় রাস্তায় হিন্দু দেব-দেবীদের মূর্তি স্থাপন করা আছে। বাদশার সম্মানে সেসব মূর্তি ঢেকে দেওয়ার জন্য কেউ কেউ প্রস্তাব করলে ইন্দোনেশিয়া সরকার সরাসরি নাকচ করে দিয়ে বলেছিল, এসব মূর্তি ঢাকা যাবে না। কারণ এসব মূর্তি আমাদের সংস্কৃতিরই অংশ। ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত মুসলিমপ্রধান দেশ। কিন্তু বালির গভর্নর বলেছেন, না এসবের কোনোকিছুই ঢাকা হবে না। এসব আমাদের সংস্কৃতিরই অংশ। ভাস্কর্য তো নান্দনিকতার জন্য। পৃথিবীর সব কয়টা দেশে ভাস্কর্য রয়েছে।
সৌদি আরবের রাজধানী জেদ্দাতে ভাস্কর্য দেখা যাবে। এমন কোনো মুসলিম দেশ নেই যেখানে ভাস্কর্য পাওয়া যাবে না। মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুড যখন ক্ষমতায় এসেছিল, তিন বছর আগেÑ তখন তারা উদ্যোগ নিয়েছিল যে, মিসরের পিরামিডের পাশে যে অর্ধেক সিংহ এবং অর্ধেক মানুষ ওইটা তারা ঢেকে দিবে। কায়রোর আল আজহার ইউনিভার্সিটি, যাকে ইসলামের সেন্ট্রাল হেড-কোয়ার্টার বলা হয়। তখন আল আজহার ইউনিভার্সিটির গ্র্যান্ড মুফতি ফতোয়া দিয়েছিলেন যে, না ওটা সরানো যাবে না। ওটা মিসরীয় সভ্যতার অংশ। ভাস্কর্যও তো আমাদের সংস্কৃতির অংশ। এতে আপত্তির কি আছে? এটা ইসলামের সঙ্গে দূরতম সম্পর্ক নেই। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক মতলবে তারা এটা করছে লাইমলাইটে আসার জন্য। যাতে তাদের গ্রেফতার করলে বলতে পারেন, আমরা ইসলামের জন্য আন্দোলন করতে গিয়েছিলাম বলেই আমাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এটাই হচ্ছে হেফাজতের আসল উদ্দেশ্য।
পরিচিতি: ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি
মতামত গ্রহণ: তানভীন ফাহাদ
সম্পাদনা: আশিক রহমান