মানহীন গ্যাস সিলিন্ডার ভাবনার বিষয়!
ইকতেদার আহমেদ
লেখক: সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
আমাদের দেশে গ্যাস সিলিন্ডারের বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে। বর্তমানে গ্যাস সিলিন্ডারের সর্বাধিক ব্যবহার গৃহস্থালি, হোটেল রেস্টুরেন্ট, আবাসিক হল প্রভৃতিতে রান্নায়। এর পরের অবস্থানে রয়েছে যানবাহন। তাছাড়া হাসপাতালে রোগীদের অক্সিজেন সরবরাহে, মেরামত কারখানা ও বড় ধরনের ইমরাত ও সেতু নির্মাণে ঝালাই কাজে এবং বেলুনে গ্যাস ভরার কাজে সিলিন্ডারের ব্যবহার হয়ে থাকে। একটি সমীক্ষা হতে জানা যায়, রান্নার কাজে ব্যবহৃত সিলিন্ডারের সংখ্যা ৫০ লাখের ঊর্ধ্বে। এ সকল সিলিন্ডারের শতকরা ৮০ ভাগের যোগানদাতা বিভিন্ন বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, অপরদিকে ২০ ভাগের যোগানদাতা বাংলাদেশে পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। বিপিসির মাধ্যমে যে সকল সিলিন্ডার সরবরাহ করা হয় সেগুলোর গুণগতমান বিস্ফোরক অধিদফতরের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু বিভিন্ন বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হতে যে সকল গ্যাস সিলিন্ডার সরবরাহ করা হয় এগুলোর গুণগতমান নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে কোনো আইন, বিধি বা নীতিমালার অনুপস্থিতিতে যথাযথ মান নিয়ন্ত্রণ ব্যতিরেকেই এগুলো ভোক্তাদের বরাবর সরবরাহ করা হয়।
গৃহস্থালির রান্নায় সিলিন্ডারে যে গ্যাস ব্যবহৃত হয় সেটিকে বলা হয় লিকুডিফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি)। এটি শোধনাগারে অশোধিত জ্বালানি তেল (ঈৎঁফব ড়রষ) প্রক্রিয়াজাতকালীন উপজাত হিসেবে পাওয়া যায়। গৃহস্থালির রান্নায় এলপিজির স্বল্পতায় আমদানিকৃত এলএনজির ব্যবহার শুরু হয়েছে। এ এলএনজি তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম হতে বিশেষ প্রক্রিয়ায় গ্যাসে রূপান্তর পরবর্তী কারখানায় উচ্চ চাপে সিলিন্ডারে ভরা হয়। যানবাহনে যে গ্যাস ব্যবহৃত হয় সেটিকে বলা হয় লিকুডিফাইড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি)। এটি গ্যাস ক্ষেত্র হতে পাইপলাইনে সরবরাহ পরবর্তী বিভিন্ন সিএনজি স্টেশন হতে বিশেষ প্রক্রিয়ায় উচ্চ চাপ প্রয়োগে যানবাহনের সিলিন্ডারে প্রবেশ করানো হয়। হাসপাতালে রোগীদের অক্সিজেন সরবরাহের নিমিত্ত সিলিন্ডারে যে গ্যাস ব্যবহৃত হয় সেটি মূলত বায়বীয় অক্সিজেন। এটি কারখানায় উৎপাদন পরবর্তী সেখানেই যান্ত্রিক পদ্ধতিতে সিলিন্ডারে ভরাট করা হয়। ঝালাই কাজে ব্যবহৃত গ্যাস অক্সিজেন ও অ্যাসিটিলিনের মিশ্রন অথবা আর্গন, কার্বন ডাইঅক্সাইড, হাইড্রোজেন, হিলিয়াম বা অক্সিজেনের মিশ্রন। উভয়টি কারখানায় উৎপাদন পরবর্তী যান্ত্রিক পদ্ধতিতে উচ্চ চাপে সিলিন্ডারে পূর্ণ করা হয়। যে বেলুন গ্যাস ভরাট পরবর্তী ঊর্ধ্বমুখী হয় এটিকে বলা হয় গ্যাস বেলুন। বেলুনে ব্যবহৃত গ্যাস হলো হাইড্রোজেন। এটিও কারখানায় উৎপাদন পরবর্তী যান্ত্রিক পদ্ধতিতে উচ্চ চাপে সিলিন্ডারে প্রবেশ করানো হয়।
উপরোক্ত সকল ধরনের গ্যাস দাহ্য পদার্থ। এগুলো উচ্চ চাপে সিলিন্ডারে প্রবেশ করানোর কারণে সবসময় সিলিন্ডারের সকল পাশে এগুলোর বহির্মুখী চাপ অব্যাহত থাকে। সিলিন্ডার গ্যাস দ্বারা পরিপূর্ণ অবস্থায় এ চাপ অধিক হয়। ব্যবহারের নিমিত্ত সিলিন্ডার হতে বিশেষ পদ্ধতিতে গ্যাসের বহির্মুখী চাপ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। দীর্ঘদিন ব্যবহারে সিলিন্ডারের কোনো অংশ ক্ষয়ের কারণে দুর্বল হয়ে গেলে তাতে সিলিন্ডার হতে গ্যাস বের হওয়ার উপক্রমে বিস্ফোরণ ঘটে থাকে। দেশে বিভিন্নভাবে যে সকল সিলিন্ডারের ব্যবহার হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ বছর ব্যবহার পরবর্তী এগুলোর সক্ষমতা বা কার্যকারিতা বহুলাংশে বিনিষ্ট হয়। কিন্তু সরকারি বা বেসরকারি উভয় প্রতিষ্ঠান হতে সরবরাহকৃত সিলিন্ডার সরবরাহ পরবর্তী কখনো গুণগতমান যাচাইয়ের আওতায় আনা হয় না বিধায় এগুলোর ব্যবহার নির্ধারিত সময় পরবর্তী সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ। এ ঝুঁকি নিয়েই আমাদের সর্বত্র গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহার চলছে।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশে গ্যাস সিলিন্ডারের মেয়াদ নির্ধারণ করে দেওয়া থাকে এবং মেয়াদ অবসান পরবর্তী সে সকল গ্যাস সিলিন্ডার বিনষ্ট করা হয়। দেশে এতদবিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইনগত বিধান ও নীতিমালা না থাকায় সিলিন্ডারের মেয়াদ কখনো ব্যবহারকারিদের জন্য কোনো ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দেয় না। আর তাই সিলিন্ডার ক্রয় অথবা যানবাহনে স্থাপন পরবর্তী কোনো ধরনের গুণগতমান বিষয়ে এগুলোকে কখনো এতদসংক্রান্ত পরীক্ষকের নিকট নেওয়া হয় না।
গুণগতমান বিনষ্ট হওয়া পরবর্তী সিলিন্ডার ব্যবহার অব্যাহত থাকার কারণে বর্তমানে দেশে এমন কোনো দিন নেই যেদিন গণমাধ্যমে অন্যূন একটি সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটনার খবরের প্রকাশ না ঘটে। এ ধরনের বিস্ফোরণে মারাত্মকভাবে যারা দগ্ধ হয় তাদের তাৎক্ষণিক মৃত্যু ঘটে। যাদের শরীরের ৪০ ভাগের ঊর্ধ্ব দগ্ধ হয় তাদের দীর্ঘ ভোগান্তির পর মৃত্যু হয়। দগ্ধ হওয়ার পরিমাণ এর নিম্নে হলে তাদেরও দীর্ঘদিন বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়। চিকিৎসা নেওয়া পরবর্তী এদের অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় শরীরের এক বা একাধিক অঙ্গ চিরস্থায়ীভাবে নিষ্ক্রিয়। এ ধরনের চিকিৎসা একদিকে ব্যয়বহুল অপরদিকে সারাদেশে একটি মাত্র বিশেষায়িত হাসপাতালে এ চিকিৎসা দেওয়া হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে এমন অনেক পরিবার রয়েছে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণে যাদের পিতৃ বা মাতৃহারা হতে হয়েছে। এসব পরিবারের সন্তানদের পরিবারের উপার্জন ব্যক্তি অথবা গৃহকর্তৃর মৃত্যুর কারণে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়।
দেশে বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত সকল ধরনের সিলিন্ডার আমদানিকৃত। পৃথিবীর সকল দেশের উৎপাদিত সিলিন্ডার গুণগত দিক থেকে সমমানের নয়। সচরাচর দেখা যায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উৎপাদিত সিলিন্ডার গুণগত দিক থেকে উচ্চমানের হয়ে থাকে। ইউরোপ ব্যতীত অন্যান্য দেশে উৎপাদিত সিলিন্ডার সাশ্রয়ী বিধায় আমাদের আমদানিকারকরা দেশের ক্রেতা সাধারণের সামর্থ্যরে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তাদের নিকট প্রতিযোগী মূল্যে সিলিন্ডার সরবরাহে সচেষ্ট। আর এর মাধ্যমে তারা যে গুণগতভাবে নিম্নমানের সিলিন্ডার সরবরাহ করে ক্রেতাদের মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছেন এ ব্যাপারে তারা একেবারেই নিরুদ্বেগ।
সিলিন্ডারের দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতি হতে ব্যবহারকারিদের সুরক্ষা করতে হলে সরকারকে প্রথমত আমদানিকৃত অথবা দেশে উৎপাদিত সিলিন্ডার যেন উচ্চমানের হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। অতঃপর বাজারজাতকরণের পূর্ববর্তী বিস্ফোরক অধিদফতরের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ দ্বারা আবশ্যিকভাবে এগুলোর গুণগতমান পরীক্ষা করতে হবে। বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত সিলিন্ডারসমূহের উৎপাদন ও মেয়াদের বিষয়টি স্পষ্টভাবে সিলিন্ডারের গায়ে লিপিবদ্ধ থাকতে হবে। উৎপাদন পরবর্তী কখন সিলিন্ডারটির ব্যবহার শুরু হয়েছে সে বিষয়ে ব্যবহারকারিকে অবশ্যই সচেষ্ট হতে হবে। মেয়াদ উত্তীর্ণের পর এর ব্যবহার যেন কোনোভাবেই না হয় সে বিষয়ে ব্যবহারকারিসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের নজরদারি থাকতে হবে। মেয়াদ উত্তীর্ণের পর সিলিন্ডারের বিনষ্টকরণ কাজ যেন যথাযথ প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয় সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ তথা বিস্ফোরক অধিদফতরকে এ বিষয়ে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে এবং মেয়াদ উত্তীর্ণ সিলিন্ডার কোনোভাবেই পুনঃসংস্কারের মাধ্যমে নতুনত্বের প্রলেপ দিয়ে পুনঃ বাজারজাতকরণের প্রচেষ্ট যেন নেওয়া না হয় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলকে তৎপর থাকতে হবে। আশা করা যায় বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতঃ উপরোক্ত ব্যবস্থাদি অবলম্বনে সংশ্লিষ্ট সকলে সচেষ্ট হলে আমরা ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা একেবারেই সীমিত পর্যায়ে নিয়ে আসতে সমর্থ হব।
সম্পাদনা: আশিক রহমান