বাংলাদেশের কবিতা ও রাজনৈতিক চেতনায় ৭ মার্চ
মিল্টন বিশ্বাস
এছাড়া ১৯৭৮ সালে ৪০ পৃষ্ঠার সংকলন ‘এপিটাফ’ প্রকাশিত হয়। বঙ্গবন্ধুর বর্বরোচিত হত্যাকা-ের প্রতিবাদে এসব প্রকাশনা জনমনে কার্যকর প্রভাব রেখেছিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা- নিয়ে ১৯৮০ সালে বিভিন্ন জনের প্রতিক্রিয়া দিয়ে ‘আবার যুদ্ধে যাব’ এবং ১৯৮২ সালে মহাদেব সাহার কাব্যগ্রন্থ ‘তোমার পায়ের শব্দ’ প্রকাশিত হয়। প্রকাশ্য সভায় স্বকণ্ঠে পঠিত নির্মলেন্দু গুণের কবিতাই বাংলাদেশের প্রথম কবিতা। মূলত কবিতায় বঙ্গবন্ধুর মহিমা ও বীরত্বব্যঞ্জক কীর্তি পরম্পরা যেমন উচ্চারিত হয়েছে তেমনি শোকাবহ মৃত্যুর ঘটনায় হৃদয়ের ক্ষরণ ও তার স্মৃতি সবই কবিদের কবিতায় রূপময় হয়ে উঠেছে।
২. সেদিনের রেসকোর্স ময়দান ও বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ৭ মার্চের ভাষণটিকে কেন্দ্র করে নির্মলেন্দু গুণের ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো’ কবিতার পঙ্ক্তিমালায় যথার্থই উপস্থাপিত হয়েছেÑ ‘লাখ লাখ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে/ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে।’ দশ লাখেরও বেশি মানুষের সেই সমাবেশ মানবসভ্যতার ইতিহাসের বিরল ঘটনা। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়ী হয়ে দীর্ঘদিনের শোষণ বঞ্চনা থেকে বঙ্গবন্ধু যখন জনগণের মুক্তির স্বপ্নে বিভোর ঠিক তখনই পাকিস্তানি শাসকচক্র ষড়যন্ত্র করে ১ মার্চ ঘোষণা দিয়ে ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে। নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তর করলে ভুট্টোদের বঙ্গবন্ধুর কর্তৃত্ব মেনে নিতে হতো। সেটা না মানার জন্যই পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা ভুট্টো বলেছিল তাদের দল বাদ দিয়ে অধিবেশন বসলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত জীবনযাত্রা নীরব নিথর করে দেওয়া হবে। ইয়াহিয়া তার হুমকির কাছে মাথানত করে। আর তার ঘোষণার পরে বাংলাদেশ অগ্নিগর্ভ উত্তাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়। ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’, ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো সোনার বাংলা মুক্ত করো’, ‘পি-ি না ঢাকা, ঢাকা-ঢাকা’, ‘পাঞ্জাব না বাংলা, বাংলা বাংলা’, ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মারো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’- এসব সেøাগান কণ্ঠে নিয়ে ঢাকাসহ সারাদেশ তখন মিছিলের সমুদ্র। বঙ্গবন্ধু জানান বিনা চ্যালেঞ্জে তিনি কোনো কিছুই ছাড়বেন না। ছয়দফার প্রশ্নে আপস না করারও ঘোষণা আসে। ১ থেকে ৫ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল চলতে থাকে। ছাত্রলীগ আর ডাকসুর সমন্বয়ে ‘স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। চলমান অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। গণজাগরণের এই পরিস্থিতিতে ৭ মার্চ ছিল স্মরণীয় দিন। ৭ মার্চের ভাষণের মধ্যে কলকাতার অধুনালুপ্ত দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার এককালের সম্পাদক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় দেখেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং উপমহাদেশের দুটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ধারার দর্শনের প্রভাব অর্থাৎ গান্ধীজির নিরস্ত্র নৈতিক যুদ্ধের আহ্বান এবং নেতাজী সুভাষচন্দ্রের সশস্ত্র সংগ্রামের রাজনৈতিক দর্শন। এছাড়া স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তী ধাপেরও নির্দেশ রয়েছে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণে। উপরন্তু ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বাক্যটি সারা দুনিয়ার নির্যাতিত মানুষের কাছে মুক্তিমন্ত্রতুল্য। খ্যাতিমান গবেষকের মন্তব্য, ‘বাঙালির মুক্তির সনদ ছিল এই ভাষণটি। এই দিনই রাষ্ট্রের ভিত্তি তৈরি হয়ে যায়। পাকিস্তানকে বাঙালিরা প্রত্যাখ্যান করে।’
৭ মার্চ নিয়ে রচিত হয়েছে অনেকগুলো কবিতা। এই ‘রাজনীতির কবি’র ৭ মার্চের ভাষণই একটি মহাকবিতা। পাকিস্তানের অপশাসনের বিরুদ্ধে তার জ্বালাময়ী ভাষণ জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছে বারবার, ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬৬-এর ছয় দফা, ৬৯-এর গণআন্দোলন সংঘটিত হয় তার নেতৃত্বে। ৭১-এর প্রথম মাস জানুয়ারি থেকে তিনি মুক্তিকামী মানুষের শৃঙ্খল মোচনের শপথে উদ্দীপিত করেন সাধারণ মানুষকেÑ রাজনৈতিক কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধা এবং বুদ্ধিজীবী মহলের প্রত্যেককে; কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক নির্বিশেষ। বাঙালির নিজের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে চিনতে শেখা তার মাধ্যমেই। ৭ মার্চে ভাষণের আগে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়া হয়েছিল। এসবই আছে কবিতার মধ্যে। বঙ্গবন্ধুর আত্মদানকে অর্থবহ করার জন্যই এই কবিতাবলি। তার রক্তের ঋণ শোধ হবে না কিন্তু তার স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় জেগে থাকবে এসব কবিতার মধ্য দিয়ে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় লিখিত জসীম উদ্দীনের ‘বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক কবিতায় এই ঐতিহাসিক ভাষণের কথা বলা হয়েছে। বিশেষত বঙ্গবন্ধুর একাত্তরের মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হওয়া অসহযোগ আন্দোলনের বিষয়টিকে কবি তুলে ধরেছেন দীর্ঘ কবিতাটির একটি অংশে-
তোমার হুকুমে রেল-জাহাজের চাকা যে চলেনি আর
হাইকোর্টের বন্ধ দরজা খুলিবে সাধ্য কার!
. . . . . . . . .
তোমার হুকুমে তুচ্ছ করিয়া শাসন-ত্রাসন ভয়,
আমরা বাঙালি মৃত্যুর পথে চলেছি আনিতে জয়।(কবিতায় বঙ্গবন্ধু, ২০১২:৪৫)
কবি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের গুণাবলির প্রশংসা করেছেন। তার আপসহীন অবস্থান ও মানুষের আস্থা-ভরসার নেতা হিসেবে মুক্তিসংগ্রামে বিজয়ের চিত্রও তুলে ধরেছেন তিনি। ৭ মার্চের ভাষণই মানুষকে নতুন এক স্বপ্নে আন্দোলিত করে। জাগরণ ও শিহরণে উদ্দীপিত মানুষ মুক্তির স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে উৎসাহী হয়। জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান বঙ্গবন্ধু। নির্মলেন্দু গুণের ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’, ওমর আলীর ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, সানাউল হকের ‘সাতই মার্চ একাত্তর’, আল মাহমুদের ‘নিশিডাক’ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকেন্দ্রিক কবিতা। নির্মলেন্দুর কবিতার একটি অংশ-
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তার অমর-কবিতাখানি;
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।(কাব্যসমগ্র-১, ২০১১: ৩৭৬)
কবির বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে ৭ মার্চের ভাষণই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। ১৫ আগস্টের পরে জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে গণ্য করার প্রচেষ্টা নিরর্থক এই কবিতাই তার সাক্ষ্য। আল মাহমুদের কবিতার অংশ বিশেষ-
তার আহ্বান ছিল নিশিডাকের শিস্ তোলা তীব্র বাঁশির মত।
প্রতিটি মানুষের রক্তবাহী শিরায় কাঁপন ধরিয়ে দিয়ে তা বাজত
. . . সে যখন বলল, ‘ভাইসব’।
অমনি অরণ্যের এলোমেলো গাছেরাও সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে গেল
সে যখন ডাকলো, ‘ভাইয়েরা আমার’. . .
অসীম সাহার কবিতায় এভাবে প্রকাশিত ৭ মার্চ-
তুমি হাত উত্তোলিত করলেই
হিমালয় মাথা নিচু করে তোমার পায়ের কাছে এসে
আনত প্রজার মতো জানায় কুর্নিশ।
এছাড়া শামসুল আলমের ‘এবারের সংগ্রাম. . . স্বাধীনতার সংগ্রাম’, তাহমীদুল ইসলামের ‘সমুদ্রের অর্কেস্ট্রা: ৭ মার্চ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ’ প্রভৃতি কবিতা একই প্রসঙ্গে রচিত। শামসুল আলমের কবিতায় ৭ মার্চের ভাষণকে ঝড়ো বাতাসের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
‘স্বাধীনতার কবি’ শামসুর রাহমানের একাধিক কবিতায় বঙ্গবন্ধু রূপক-প্রতীকে আবার কখনো সরাসরি আত্মপ্রকাশ করেছে। ‘ধন্য সেই পুরুষ’, ‘যার মাথায় ইতিহাসের জ্যোতির্বলয়’, ‘ইলেকট্রার গান’, ‘তোমারই পদধ্বনি’ প্রধান কবিতা। ‘ইলেকট্রার গান’ বেশ ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত বাঙলাদেশের সঙ্গে: ‘বিদেশি মাটিতে ঝরেনি রক্ত; নিজ বাসভূমে,/ নিজ বাসগৃহে নিরস্ত্র তাকে সহসা হেনেছে ওরা।’Ñ স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে পঁচাত্তরের হত্যাকা-কে। কিন্তু কবিতাটি আদ্যন্ত গীতিময়, জাতিসত্তার বাণীবহ মহাকাব্যিক চারিত্র এর নয়।’ তবে এ কবিতায় এ্যাগামেননের (বঙ্গবন্ধু) হত্যাকা-ের পর নিহত পিতার জন্য কন্যা ইলেকট্রার(শেখ হাসিনা) শোক সার্বজনীন হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে ১৫ আগস্টের পর বঙ্গবন্ধুর জন্য হাহাকার ব্যক্ত হয়েছে। এ কবিতায় বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়াকে নিয়তি বলে ধরে নিতে দেখা যায়। শোকে কবি লুকিয়ে বিলাপ করেন, তাতে মন স্বান্ত¡না মানে না। হত্যাকারীরা নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ায় আর কবির ওপর চোখ রাখে। তবুও কবি অন্তরে শোক লালন করে যাবেন। ‘ধন্য সেই পুরুষ’ কবিতায় উন্মোচিত হয়েছেন বঙ্গবন্ধুর মহিমা। তার নেতৃত্ব ও মানুষের জন্য ব্রতের সমুজ্জ্বল চিত্রণ এখানে অনন্য। (চলবে-৫)
লেখক: অধ্যাপক এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান