চা বাগানে ভূমি রক্ষায় ‘প্রাণের পরব’
মাহফুজ জুয়েল
পরব মানে উৎসব। প্রাণের পরব মানে প্রাণের উৎসব। হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের চান্দপুর ও বেগমখান চা বাগানে হয়ে গেল এই উৎসব। নামে উৎসব হলেও তা ছিল চা শ্রমিকদের ভূমি অধিকার রক্ষার প্রাণান্ত প্রতিবাদ। সর্বপ্রাণ সাংস্কৃতিক শক্তির আয়োজনে বুকে উচ্ছেদ আতংক নিয়ে ১০ মার্চ শুক্রবার ‘প্রাণের পরবে’ মেতেছিল চা বাগান। নাচ, গান, ছবি আঁকা, নাটক পরিবেশনাসহ নানা আয়োজনে, নানা ভাষায় চা শ্রমিকরা তুলে ধরে তাদের প্রাণের দাবি।
উৎসবে বহুল উচ্চারিত সেøাগান ছিল, ‘আমার মাটি আমার মা, কেড়ে নিতে দেব না’। এটা চা শ্রমিকদের প্রাণের সেøাগান। আর এই সেøাগানই ওদের গান, মন্ত্র এবং সঞ্জীবনী শক্তি। এই শক্তিতে আরেকটু প্রাণ দিতে সংহতি জানিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন ঢাকার সচেতন কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা। ছিল চা বাগান ভূমি রক্ষা কমিটি ও চা জনগোষ্ঠী ভূমি অধিকার ছাত্র-যুব আন্দোলনের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা।
উল্লেখ্য, প্রায় দেড় বছর আগে চুনারুঘাটের বেগমখান ও চান্দপুর চা বাগান এলাকায় প্রস্তাবিত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের লক্ষ্যে প্রায় ৫১২ একর ফসলি জমি অধিগ্রহণ করা হয়। চা শ্রমিকরা দাবি করে, এ জমি তাদের মায়ের মতো। প্রায় দেড়শ বছর ধরেই সামান্য আয়ের এসব চা শ্রমিক এ জমিতে ধানসহ অন্যান্য ফসল চাষাবাদ করে জীবিকা রক্ষা করে আসছে। শুরুতেই জমি অধিগ্রহণের প্রতিবাদে তারা আন্দোলনে নামে। সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় অনুষ্ঠিত হলো এই প্রাণের পরব।
শুক্রবার সকাল ১০টায় চান্দপুর চা বাগানের ফুটবল মাঠে জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রাণের পরব। এরপর সূচনা বক্তব্য দেন কবি ও শিল্পী কফিল আহমেদ। চা শ্রমিক পরিবারের শিশুরা মাঠে অভিনয় করে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার চিত্র ফুটিয়ে তোলে। এরপর ওই শিশুরাই তাদের ধানের জমি কেড়ে নেওয়া নিয়ে একটি নাটিকা প্রদর্শন করে। এরপর চান্দপুর চা শ্রমিকদের নাচঘরে শুরু হয় আলোকচিত্র প্রদর্শনী। চা শ্রমিকদের আন্দোলনের ওপর এসব ছবি তোলেন মাহমুদা খাঁ, মোহন রবিদাস, সাইফুল ইসলাম রনি, শিরিন মাহমুদ, মেহেদী হাসান, ফায়হাম ইবনে শরীফ, খায়রুল ইসলাম, জুয়েল শেখ, মোহাম্মদ রফিক, আবদুল্লাহ মাহফুজ অভি, মাহফুজ শাহরিয়ার ও সবুজ সরকার।
অন্যদিকে নাটমন্দির চত্বরে ২০ বাই ১৩ ফুটের বিশাল ক্যানভাসে ছবি আঁকেন একদল শিল্পী। ছবিতে দেখা যায়, আকাশের তারাদের ভিড়ে এক ভয়ংকর প্রকৃতির টাই পরা লোকের দিকে তীর ছুঁড়ে মারছে চা শ্রমিকরা। চা শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে প্রতীকী এ ছবি আঁকেন শিল্পী ধীমান, নাসির, লিসা, মনিরুজ্জামান শিপু, মাহফুজ জুয়েল, সামান্তা, জাহিদসহ ১৫-১৬ জন শিল্পী।দুপুর ১টার দিকে প্রতিবাদী শোভাযাত্রা বের হয়। লস্করপুর ভ্যালির ২৩টি চা বাগানের কয়েক হাজার নারী-পুরুষ শ্রমিক ও শিশু এবং ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা সংস্কৃতিকর্মীদের এ শোভাযাত্রা চান্দপুর চা বাগান এলাকা থেকে প্রস্তাবিত স্পেশাল ইকোনমিক জোন এলাকায় গিয়ে থামে। চা শ্রামিকদের ঐতিহ্যবাহী তীর-ধনুক, নানা বাদ্যবাজনাসমেত এ বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রায় সবাই ভূমি দখল বিরোধী প্রতিবাদী গানে মেতে ওঠে।
বিকেলে রাধামাধব মন্দির মাঠে বসে মূল আসর। এখানেই হয় আলোচনা সভা, গান ও নাটক। নলুয়া চা বাগানের সাবেক শ্রমিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মনু তাঁতীকে শুরুতেই সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সাধন সাঁওতালের সঞ্চালনায় একে একে বক্তব্য দেন চা শ্রমিকদের নেতা অভিরত বাকতি, নৃপেন পাল, স্বপন সাঁওতাল, লক্ষ্মীচরণ বাকতি, সূর্য কুমার রায়, গীতা রানী কানু, মোহন রবিদাস, মুকেশ কর্মকার প্রমুখ। সর্বপ্রাণের পক্ষে বক্তব্য দেন অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম, কবি ও সাংবাদিক ফারুক ওয়াসিফ, মাহা মির্জা, আহমেদ মুনিরুদ্দিন তপু প্রমুখ।
মঞ্চে গান করেন কফিল আহমেদ। এ ছাড়া সমগীত, সহজিয়া, চিৎকার, মনোসরণী, মাদল ও বেতাল প্রতিবাদী গান পরিবেশন করে। নাটক পরিবেশন করে ঢাকার বটতলা, তীরন্দাজ, সিলেটের নগরনাট ও চা বাগানের প্রতীক থিয়েটার। অনুষ্ঠানে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সদস্যরা ঝুমুর, কাটি, সাঁওতাল ও মুন্ডা নাচ এবং নাটক ও সংগীত পরিবেশন করেন। কয়েক হাজার চা শ্রমিক দিনভর উৎসব উপভোগ করে।
আদিবাসী নারী ফোরাম নামের একটি সংগঠনের আহ্বায়ক রিতা রানী কানুন বলেন, ‘আমরা হলাম ৮৫ টাকার শ্রমিক। আমরা এ ভূমি ব্যবহার করে বছরে ৩০-৩৫ হাজার টাকা পাই। কাজেই আমরা অর্থনৈতিক অঞ্চল নয়, এ মাটির অধিকার চাই।’
ভূমি রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক নৃপেন পাল বলেন, ‘আমরা দুই বছর ধরে এখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি। তারপরও প্রশাসন ও সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এটি গঠনের। আমরা রক্ত দেব, তবু এ ভূমি দেব না।’
স্থানীয় ইউপি সদস্য ও চা শ্রমিক লক্ষ্মীচরণ বাকতি বলেন, ‘চা শ্রমিকরা দেশের জন্য যুদ্ধ করে জীবন পর্যন্ত দিয়েছে। আমরা এ দেশেরই মানুষ। এ দেশেই মরব। আমাদের কেবল ভোটের অধিকার আছে। বাস্তুস্থান নেই। খাওয়া-পরারও নিশ্চয়তা নেই। আমরা বিশ্বাস করি, সরকার আমাদের ধানের জমি রক্ষায় সদয় হবে। ’
লেখক: কবি, সাংবাদিক ও আন্দোলনকর্মী
সম্পাদনা: আশিক রহমান