শান্তি তো মানুষের সর্বজনীন বাসে
প্রতীক ইজাজ
আমি এখনো শৈশবের দুর্গাপূজার গন্ধ পাই। স্বপ্নে ঢোল-বাদ্য বাজে; মাটির পুতুল নাচে; ক্যাচক্যাচ শব্দ তুলে সাইকেল যায়। দুর্গাপূজায় কেনা ছাচ, বাতাসা নুকুলÑ এখনো আনন্দে ভাসায়। আর মেলায় পা দিয়েই আমি স্থির দাঁড়াই ম-পের সামনে। মা দূর্গা, গণেশ, কার্তিক, লক্ষী, স্বরসতি, কিংবা বধ অবস্থায় পায়ের নিচে শায়িত মহিষাসুরÑ সবাইকেই আমার ভালো লাগত। ধর্মীয় বিশ্বাস নয়; গড়ার আদলে মুগ্ধ ছিলাম আমি। কি নিখুঁত নাক, ঠোট, চোখ, কপাল! দুর্গার হাসি আমাকে এখনো হাসায়। পরে একটু বড় হয়ে দুর্গাপূজার সময় সুযোগ পেলেই ছুটতাম পালপাড়া, হাড়িপাড়া বা বৈরাগীপাড়ায়; প্রতীমা শিল্পীর কাছে। দেখতামÑ কি যতœ নিয়ে, দক্ষতায় প্রতীমা গড়ছেন তিনি। বড় হয়ে সেই প্রতীমাই ধরা দিল আরও নান্দনিকভাবে, সৌন্দর্যের আধার হয়ে। চট্টগ্রাম চারুকলার এক বন্ধু ছিলÑ ইকবাল। একবার তার নিজের পায়ের গোড়ালির একটি ভাস্কর্য গড়ে আনল। মুগ্ধ হলাম। দনিয়ার বাবু ভাই, ঢাকার চারুকলার বন্ধুরা যখন পাথর কেটে, মাটি ছেনে ছেনে মুখ শরীর একটা পুরো মানুষ গড়ত, আবাক লাগত। বহিঃঅন্তদৃশ্যের ছায়া খেলত চোখে-মুখে। শক্তি পেতাম। আগুন জ্বলত ইচ্ছাশক্তিতে। আমি ওদের মধ্যে, নিজের মধ্যে, ভাঙাগড়ার খেলা দেখতাম। আমার সেই প্রতীমা ও ভাস্কর্যই এখন মৌলবাদীদের রাজনীতির উপজীব্য। বাবা নামাজ পড়তেন। আমরাও। টাকা দিতেন। পূজার মেলায় যেতাম। সন্ধ্যায় পড়তে বসলে, কাছে টেনে বলতেন, কেমন লাগল। কোনোদিন তাকে মায়াবী প্রতীমাগুলোকে অবজ্ঞা করতে দেখিনি; মূর্তি বলতে শুনিনি। মূর্তি বলতে শুনলাম ধর্মীয় মৌলবাদীদের রাজনীতিতে, প্রচ- ঘৃণা নিয়ে।
গুলিয়ে ফেলা হলো প্রতীমা ও ভাস্কর্যকে। ধর্ম থেকে শিল্পকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হলো। সর্বজনীন ভাবনা ও রূপ; রূপ নিল সংকীর্ণতায়, মৌলবাদে। শিল্প ও ধর্ম দাঁড়াল মুখোমুখি। এদেশের অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি ও জীবনাচার, রাজনীতির মোড়কে হয়ে উঠল ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি। আমরা পিঠ পেতে দিলাম; লাল গালিচা পড়ল তাতে। মুখ বুজে সহ্য করলাম। মসনদ তৈরি হলো। কালো ছাপ রেখে গন্তব্যে পৌঁছাল যে যার। সুন্দর সর্বময় কল্যাণের দেশে দেখা দিল ধর্মের রাজনীতি। ধর্মের ব্যবসা। একদিন দেখলাম ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনের গোল চত্বর থেকে লালনের ভাস্কর্যটি সরিয়ে নেওয়া হলো। কচিমতি শিশুদের পাঠ্যবই থেকে সুখকর ছড়াগুলো মুছে গেল। সর্বজনীন পাঠ্যসূচি হলো একমুখী। হামলা হতে থাকল সাঁইজীদের আখড়ায়, লালন মেলায়, রমনার বটমূলে। পহেলা বৈশাখে উৎসবের রঙ মুছে মেয়েটির চোখেমুখে একে দেওয়া হলো কালিমা, বেদনা। ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় হিন্দুদের ওপর নির্যাতন হলো। বাড়িঘরে আগুন জ্বলল। গাইবান্ধায় সাঁওতালপল্লী থেকে উচ্ছেদ হলো সাঁওতালরা। সেখানেও খড়ের ঘরে আগুন। আর এখন হেফাজতে ইসলাম চাইছে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য সরাতে। ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতের তা-ব দেখেছি। গান পাউডার দিয়ে ভবন পোড়াতে দেখেছি। সমুলে বৃক্ষ নিধন ও মানুষকে নির্যাতন করতে দেখেছি। প্রকাশ্যে নারী লাঞ্চনা দেখেছি। আবার সেই হেফাজতকেই রাতের আঁধারে লেজগুটিয়ে সরে পড়তে দেখেছি। পোড়া ভবন থেকে ছড়িয়ে পড়া ধোঁয়ার কু-লি মনের ভিতর জন্ম দিয়েছিল ক্ষোভ ও বিতৃষ্ণা। তার আগুনে তাদের সে বিশ্বাস আজ ভস্ম। এত সাহস হেফাজত পেত না। পাওয়ার কথা না। পাচ্ছে। কারণ রাজনীতি। বারবার ভোটের রাজনীতির জন্য আমরা ওদের দ্বারস্থ হই। তখন আমাদের কাছে ‘প্রগতিশীল’, ‘অসাম্প্রদায়িক’, ‘সর্বজনীন’ কিংবা ‘কল্যাণকর’ ইত্যকার শব্দগুলো তুচ্ছ মনে হয়। মূল্যহীন মনে হয়।
সেবারও তেমনটি হয়েছিল। জামায়াত তো ছিলই; বিএনপি প্রশ্রয় দিল। জাতীয় পার্টি নেতাকর্মীরা সড়কের মোড়ে মোড়ে ধর্মান্ধ হেফাজতিদের শরবত পান করাল। কিছু না বুঝেই চুপ থাকলাম আমরা নাগরিকরা। বুঝলাম; তবে পরে, অনেক দেরিতে। ভাস্কর্য ও মূর্তিÑ এক নয়। ভাস্কর্যÑ সর্বজনীন ভাবনা, চিন্তার ফসল। মূর্তিÑ একটি বিশেষ ধর্মের ধর্মীয় রীতিনীতি, আচরণ। ভাস্কর্য ও মূর্তির আভিধানিক ব্যাখ্যাও রয়েছে। রয়েছে স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি, ভিন্নতা। দুটি-ই নান্দনিক শিল্প, পারিভাষিক অর্থ হিসেবে প্রচলিত। রঙ না মাখালে যে কেউ-ই খুব সহজভাবে এটি বুঝবে ও বুঝেছে। আর ইসলামের কথা বলে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য সরিয়ে নেওয়ার যে দাবি হেফাজত ইসলামের; সেটি ভুল ও ধর্মীয় মূর্খতা। একটি কাপুরুষতা, কপটতা। ভাস্কর্যকে মূর্তি বলে চিরায়ত ও উদার ইসলামি সংস্কৃতির বিরোধিতা করা; ইসলাম রক্ষার নামে অন্ধকার যুগের পৌত্তলিক সংস্কৃতিকে টেনে হিঁচড়ে আবার সামনে আনার অপচেষ্টা। কারণ ইসলামের ইতিহাসে ভাস্কর্য গড়া ও সংরক্ষণের অসংখ্য নজির যেমন রয়েছে; তেমনি ভাস্কর্য বা মূর্তি অপাসারণই যে ইসলাম নয়, তার শিক্ষাও রয়েছে অসংখ্য।
সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে যে গ্রিক দেবীর ভাস্কর্যÑ সেটি কোনো ধর্ম বা গোষ্ঠী নয়, সর্বজনীন সংস্কৃতি ও আদর্শের প্রতীক। সে ভাস্কর্য বহন করছে আইনের সুশাসনের কথা, সমআইনের কথা। বিচারপ্রার্থী থেকে শুরু করে বিচারক, আইন প্রণেতাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেÑ আইনে ধর্ম নয়; মানুষই মূল ও আদি। ইসলাম রক্ষার নামে স্বাধীন সার্বভৌম এই অসাম্প্রদায়িক দেশে ধর্মযুদ্ধ যে সম্ভব নয়, তা হেফাজত নিশ্চয় জানে ও বোঝে। সুতরাং মানুষের যুথবদ্ধ সংস্কৃতি ও আবেগকে, পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতিকে, ধর্মে ধর্মে আলাদা না করে, রাজনীতিতে না টেনে, সবার জন্য সর্বজনীন রাখাই হবে মঙ্গলকর। ধর্মে ধর্মে ভেদ, কখনোই কোনোকালেই শান্তি আনেনি। শান্তি তো কেবল মানুষের সর্বজনীন বাসে।
লেখক: সাংবাদিক, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
সম্পাদনা: আশিক রহমান