ট্যানারি স্থানান্তর নিয়ে জটিলতা এড়াতে করণীয় কী?
রবিউল আলম
ট্যানারি শিল্প-প্রতিষ্ঠান স্থানান্তরের জন্য ইতোমধ্যে ৩২ বার নোটিস দেওয়া হয়েছে, আদালত প্রতিদিন ১ হাজার টাকা জরিমানা করছে, তারপরেও ট্যানারি শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানান্তর হচ্ছে না। চামড়ার দাম কমিয়ে জরিমানার টাকা আদায় করছে জনগণের কাছ থেকে। এর প্রতিবাদে ৬ দিন মাংস ব্যবসায়ীদের ধর্মঘট হয়েছে, সর্বশেষ আদালত গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ট্যানারির মালিকগণ। কি আদেশ দিবেন আপিলে জানি না, কিভাবে ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরিত হবে এবং করবেন তাও জানা নেই। ৪৫ বছর চামড়া ব্যবসার অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে চেয়েছি, সরকার, প্রশাসন ও মিডিয়াকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছি। জীবনকে বাজি রেখে কথা বলতে হয়, কারণ টাকার কাছে বুদ্ধি ও উপদেশ অচল থাকে, লুটেরাদের অনেক শক্তি ও কৌশল জানা আছে, আর যারা কৌশল জানে না তাদের লুটের কৌশল শেখানোর লোকও আছে।
আমার অনেক লেখায় উল্লেখ করেছি ট্যানারি মালিকদের দুইটি সংগঠনÑ ফিনিশড আর টেনার্স। ফিনিশড লেদারের সবাই সফল ব্যবসায়ী, ইতোমধ্যে তাদের সদস্যরা হেমায়েতপুরে ট্যানারি স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছেন, কিছু কিছু ট্যানারি উৎপাদনে আছেন। আর টেনার্সদের সদস্যরা অনেকে হেমায়েতপুরে ট্যানারির কাজ ধরতেও পারেননি, যারা কাজ করতে পারেননি, তাদের হাজার বছর সময় দিলেও ট্যানারি স্থানান্তর করতে পারবেন না। কারণ যিনি শিল্পের মালিক ওয়েট ভুলু চামড়া রপ্তানি বন্ধ হওয়ার পরে পুঁজির অভাবে ট্যানারি চালু রাখতে ব্যর্থ হয়ে ভাড়া দিয়ে দিয়েছেন, তাদের ছেলে-মেয়েরাও এই চামড়া ব্যবসায় ফিরে আসতে পারেননি। অতি আনন্দে ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়েছেন, হেমায়েতপুরে শিল্প প্লট নিয়েছেন, এখন পুঁজিপতি খুঁজছেন। সরকার প্লটের দলিল হস্তান্তর না করায় সে আশা গুড়েবালি, উপায়ন্ত না দেখে যে কটা দিন তালবাহানা করে হাজারীবাগে থাকা যায়, আর ভাড়া দিয়ে খাওয়া যায়, জাতীয় স্বার্থ ওদের কাছে বড় নয়। সফল ব্যবসায়ীরা ওদের কাছে জিম্মি, কারণ ব্যর্থদের সংখ্যাই বেশি। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করতেই হবে, বাংলাদেশে গরু-মহিষের চামড়া এক কোটি বিশ লক্ষ, ছাগল-ভেড়া ৭০-৮০ লাখ। ৫০ থেকে ৬০টি ট্যানারি হলে আমাদের চামড়া রপ্তানিতে কোনো ব্যাঘাত হবে না, ইতোমধ্যে হেমায়েতপুরে ৫৫টি ট্যানারি ওয়েট ভুলু চামড়ার জন্য প্রস্তুত। তবুও হাজারীবাগে ওয়েট ভুলু বন্ধ করা যাচ্ছে না, প্রশাসনের ব্যর্থতার জন্য আদালতের আদেশের প্রয়োজন হলো, আবার আপিলের অপেক্ষায় থাকতে হবে। আইন নিয়ে টাকাওয়ালারা কত সুযোগ নিতে পারে, আইনের শেষ দেখে ছাড়বে, দেশ, জনগণ, পরিবেশ রপ্তানির কি হবেÑ ওরা সেটার ধার ধারে না, যেকোনো ছল-চাতুরি করে টাকা নেওয়া তাদের পেশা। কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা আছে চামড়াওয়ালাদের টাকা নেওয়ার পথ দেখিয়ে দেয়, যে কারণে স্বেচ্ছায় হাজারীবাগে ট্যানারি উচ্ছেদ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। হাজারীবাগ মুক্ত করতে হলে সরকারকেও কিছু ছল-চাতুরি করতে হবে। চামড়া শিল্প স্থানান্তর হলো চারটি বিষয়Ñ ১. ওয়েট ভুলু, ২. ক্রাস, ৩. ফিনিশড, ৪. লেদার গুডস। ওয়েট ভুলু বুড়িগঙ্গার পরিবেশকে নষ্ট করছে, ওয়েট ভুলু চামড়া প্রস্তুত করা অনেক সহজ, ইতোমধ্যে হেমায়েতপুরে যে ৫৫টি ট্যানারির কাজ শেষ হয়েছে তাদের বাধ্যতামূলক ওয়েট ভুলু করতে হবে। এজন্য সরকারের যত সুযোগ-সুবিধা আছে তাদের দিতে হবে, ব্যর্থ ট্যানারি মালিকদের কবল থেকে উদ্ধার করতে হবে, ভাগ করতে হবে ব্যর্থ ও সফল মালিকদের, একদিনের জন্যও ওয়েট ভুলু চামড়া হাজারীবাগে ভুলু করতে দেওয়া যাবে না।
ক্রাস, ফিনিশড ও লেদার গুডসের জন্য ওরা সময় নিলে ক্ষতি কি, যারা ওয়েট ভুলু এক স্থানে আর অন্য কাজগুলো অতিরিক্ত ব্যায়ের জন্য অন্য স্থানে করতে চাইবে না। নিজ প্রয়োজনে স্বেচ্ছায় স্থান ত্যাগ করবেন, আর সবগুলো বিষয় একসঙ্গে চাপ দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে এবং রপ্তানির বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। যেভাবে ট্যানারির মালিকরা সরকার ও জনগণকে জিম্মি করে ফেলেছে, এতে ওদের থেকে উদ্ধার হওয়া কঠিন। ক্ষতিপূরণের টাকা, ব্যাংকের টাকা, কাঁচা চামড়া ব্যাপারীদের টাকা, আড়ৎদার, মাংস ব্যবসায়ীদের টাকাসহ বিভিন্ন খাতের সব টাকা ওদের কাছে, ইচ্ছে করলেও আমাদের কাছে আর কোনো পথ খোলা নেই। আদালত যত খুশি জরিমানা করুক ওদের তাতে কিছুই যায় আসে না। জরিমানা তো সরকার ও জনগণই বহন করবে তা ওরা জানে। ওরা এটাও জানে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে আরও সময় নেওয়া যাবে, আর গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি বন্ধ করে দিলে সবকিছু ফেলে দিয়ে পালিয়ে যাবে পূর্ব পরিকল্পনা তো আছেই। এই শিল্পের মালিকরা দেশের বাড়ি থেকে কিছু নিয়ে আসেনি, সবকিছু ঋণের টাকায়, লোনের টাকায়, গরিব চামড়া ব্যাপারীদের ও মাংস ব্যবসায়ীদের টাকা নিয়ে ট্যানারির মালিকরা আজ শিল্পপতি, তাই সরকারের কৌশল নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ট্যানারি শিল্পে প্রায় দুইশত ট্যানারি হচ্ছে, আমাদের সরকারকে কিছুই করতে হবে না, শুধু ওয়েট ভুলু চামড়া হাজারীবাগ থেকে বন্ধ করে দিন, সবকিছু ট্যানারি মালিকরা ঠিক করে নিবেন। ঐক্য ছাড়া ওরা কিছুই করতে পারবে না, হেমায়েতপুরে যেতেই হবে।
লেখক: মহাসচিব, বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতি/সম্পাদনা: আশিক রহমান