চিকিৎসকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি ভাতা নেই কেন?
ডা. জাকির হোসেন
চিকিৎসকেরা রক্ত চোষা, লোভী, কসাইÑ এখানে এমন অনেক খারাপ বিশেষণেই বিশেষায়িত করা হয় চিকিৎসকদের। অথচ চিকিৎসকেরা দিনরাত পরিশ্রম করেন, প্রতিনিয়তই মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। সেবা দিচ্ছেন, দিনরাত খাটছেনÑ অথচ বদনামের ভাগিদার তাদেরই হতে হয়। এটা কেবল এদেশ বলেই সম্ভব।
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, যখন পুরো পৃথিবীর মানুষ টেলিভিশন পর্দায় একটি দৃশ্য দেখে আবেগে আপ্লুত হয়েছিল, সৃষ্টিকর্তার মহানুভবতা কৃতজ্ঞতাসহ স্মরণ করেছিলÑ মায়ের পেটে গুলিবিদ্ধ নবজাতকের ক্ষেত্রে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকদের চিকিৎসাসেবায় গুলিবিদ্ধ নাজমা বেগমের নবজাতকের সুস্থ হওয়ার ঘটনায়।
প্রতিদিন দেশের হাসপাতাল গুলোতে এমন অনেক অনুকরণীয় ঘটনা ঘটছে যার সাক্ষী চিকিৎসকসমাজ। কিন্তু এ রকম উদাহরণযোগ্য প্রায় প্রতিটি ঘটনাই থেকে যায় আড়ালে আবডালে। দেশের স্বাস্থ্যবিভাগের অনেক কর্মসূচি সফলভাবে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করায় আমাদের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের অনেক পদকে ভূষিত হয়েছেন। কিন্তু যাদের অসীম ত্যাগে স্বাস্থ্য চিকিৎসায় তিলে তিলে উন্নতির শিখরে আহরণের স্বপ্ন দেখছে সেই চিকিৎসক সমাজ আজ সীমাহীন বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।
বাংলাদেশের সরকারি চাকরিরত অনেক পেশার কর্মচারীরা ঝুঁকি ভাতা পান। পুলিশ কর্মরত চাকরিজীবীরা ঝুঁকি ভাতার পাশাপাশি ওভারটাইম ভাতাও পান। এমনকি স্বাস্থ্য সেক্টরে সেবিকারাও ঝুঁকি ভাতা পান। কিন্তু যারা চিকিৎসক তারা সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে কাজ করেও ঝুঁকি ভাতা পান না। হাসপাতালে এইডস, হেপাটাইটিস বি ও হেপাটাইটিস সি আক্রান্ত রোগীদের অপারেশনসহ নানাবিধ চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে বহু চিকিৎসক সংক্রমিত হচ্ছে। সংক্রমিত চিকিৎসকেরা নিজের অজান্তেই এই সকল মরণঘাতী জীবাণুর বাহক হয়ে তার পরিবারের জন্য যেমন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছেন, তেমনি নিজেরাও অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। ক্যান্সার রোগীর রেডিও থেরাপি দিয়ে বহু চিকিৎসক আজ নিজেরাই ক্যান্সারে আক্রান্ত। প্রয়াত বিখ্যাত শিশু চিকিৎসক প্রফেসর এম আর খান চিকিৎসা দিতে গিয়ে নিজেই যক্ষার জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হয়ে বহুদিন চিকিৎসা পেশার বাহিরে ছিলেন।
বাংলাদেশের এমন কোনো সরকারি হাসপাতাল নেই যেখানে রোগী ধারণ ক্ষমতার তিনগুন রোগী থাকে না। এত রোগীর চাপেও কিন্তু চিকিৎসকেরা রোগীদের ফিরিয়ে দেন না। যথাসাধ্য চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করেন। দেশের সবগুলো সরকারি হাসপাতাল রাতদিন ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে সেখানে পর্যায়ক্রমে রোস্টার অনুযায়ী চিকিৎসকেরা ডিউটি পালন করেন। কিন্তু তাদের বিকাল এবং রাতের ডিউটি কর্মঘণ্টা হিসেবে গণনা করা হয় না। যেখানে পুলিশসহ অন্য অনেক পেশায় ওভারটাইম প্রচলিত সেখানে স্বাস্থ্য সেক্টরে চিকিৎসকদের বিকাল এবং রাতের ডিউটিকে কর্মঘণ্টা হিসেবেই ধরা হয় না। একজন চিকিৎসক সারারাত ডিউটি করে তাকে আবার পরের দিন সকালে ডিউটি করতে হচ্ছে। এটা আন্তর্জাতিকভাবে নির্ধারিত শ্রম আইনের চরম লঙ্ঘন। একজন মানুষের পক্ষে একটানা কতক্ষণ কায়িক শ্রম দেওয়া সম্ভব? বাংলাদেশের অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত কর্মচারীরা কত ঘণ্টা একটানা অফিস করে? সেই সকল নিয়মকানুন কেন চিকিৎসকদের বেলায় অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। সরকারি চাকরির তিন বছর পরপর প্রতিটি চাকরিজীবী ১৫ দিনের একটি চিত্তবিনোদন ছুটি পেয়ে থাকেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এই ছুটি কোনো চিকিৎসক ভোগ করতে পারে না।
যুগ যুগ ধরে এই সকল বৈষম্য চিকিৎসক সমাজকে এই পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করছে। মনে রাখতে হবে, চিকিৎসকেরাও আরও দশজনের মতো রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। তাদেরও অন্য দশজন মানুষের মতো আহার, আহলাদ ও চিত্তবিনোদনের প্রয়োজন রয়েছে। তাদেরও পিতা-মাতা, স্বামী-সন্তান নিয়ে একটি সংসার আছে। রাষ্ট্রের অন্য দশজন সাধারণ মানুষের মতো তারও মৌলিক চাহিদাগুলো রাষ্ট্রের ব্যবস্থা করার কথা। চিকিৎসাব্যবস্থার প্রাণ হলো চিকিৎসক। সেই চিকিৎসকদের দেহ ও মন স্বাস্থ্যসম্মত রাখতে না পারলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়ন টেকসই হবে না। সবকিছুর প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে তাই চিকিৎসকদেরও ঝুঁকি ভাতার আওয়াতায় আনা এখন সময়ের দাবি।
লেখক: চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান