শাপে বর!
হাবিবুর রহমান তাপস
মানুষ তার স্বীয় কর্মের মাধ্যমে অমরত্ব লাভ করে। কীর্তিমানের শারীরিক মৃত্যু ঘটলেও কর্মযজ্ঞই তাকে বাঁচিয়ে রাখে এই ধরণীর বুকে। ঠিক একইভাবে একটি দেশের জনগণ তাদের জাতির শত্রুদেরও বাঁচিয়ে রাখে দৃষ্টান্তমূলক উপমা দিয়ে। মীর জাফর থেকে খন্দকার মোশতাক যেন বাঙালির মুখে মুখে! তারা বাঙালির হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছে ইতিহাসের কলঙ্কময় নিকৃষ্ট উদহারণ হিসেবে। বাঙালির মনের অভিশাপের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে আত্মতৃপ্তির কিছুটা স্বাদ নেয় এই নিকৃষ্ট ব্যক্তিদের নাম ধরে গালি দিয়ে। বাঙালি জাতি কখনো ঋণী থাকতে রাজি নয়। সে যেমন কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ হয়ে বিধাতার কাছে নিজেকে উজাড় করে তার জন্য প্রার্থনা করে মঙ্গল কামনা করে, তেমনি জাতীয় শত্রুদেরও তারা স্মরণ করে তাদের দৈনন্দিন খারাপ দৃষ্টান্তের বুলিতে। প্রতিটি মানুষ তার প্রবৃত্তির দ্বারা আক্রান্ত। প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই একজন প্রকৃত মানুষের জন্ম হয়। সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে যেতে না পারলে সে কিসের মানুষ? আর যদি হয় সেটি জাতীয় ইস্যু নিজ স্বার্থ নিয়ে ভাববার প্রশ্ন ওঠার কথা নয়। শুধুমাত্র নিজ স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে স্বীয় জাতির স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে যিনি প্রতারণা করতে কুণ্ঠাবোধ করেন নাÑ সে যেই হোক তাকে জাতীয় শত্রু ছাড়া অন্য কিছু ভাববার অবকাশ থাকে না। প্রতিটি সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কিছু কাঠামো রয়েছে যার মাধ্যমে ওই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হয় যা দেশের সুনির্দিষ্ট আইনের আওতায় আবদ্ধ।
দেশের আইন-কানুনের প্রয়োগ সবার জন্য সমান। কোনো ব্যক্তি বিশেষের জন্য ওই আইনগুলো বদলানো সম্ভব হয় না। যদি সেটি করা হয় তবে তা হয় খুব খারাপ দৃষ্টান্ত। এতে করে দেশের প্রচলিত আইন ও বিচারব্যবস্থা প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। যা মোটেও কাম্য ও গ্রহণযোগ্য নয়। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তি শুধুমাত্র একটি ব্যাংকের নিজের এম.ডি পদ রক্ষার জন্য পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের সাহায্য বন্ধের ষড়যন্ত্র করেন। এটি যদি সত্যি প্রমাণিত হয়, তবে তা হবে ইতিহাসের কলঙ্কজনক ঘটনা। এই দেশের মানুষ যতবার ওই সেতু দিয়ে পার হবে ততবারই তার এই ষড়যন্ত্রের কথা স্মরণ করে তাকে ধিক্কার জানাবে।
ব্রিটিশ শাসনামলে জনগণের চলাচলের পূর্ব পাকিস্তানের অনেক জেলাতে ব্রড গেজ ট্রেনলাইন স্থাপিত ছিল। যশোর থেকে সৈয়দপুর দীর্ঘ ট্রেন লাইনটি ছিল ব্রড গেজ। পরবর্তীতে পাকিস্তান শাসনামলে সেই লাইনগুলোর উন্নতি না করে সেখানে জুজুর ভয় দেখিয়ে উন্নয়ন কাজ বন্ধ রাখা হতো। কারণ হিসেবে বলা হতো যে বাংলাদেশের মাটি নরম, সেখানে ব্রড গেজে বড় ট্রেন দিলে মাটি দেবে যেতে পারে। আসল কথা হলোÑ পাকিস্তানি শাসকেরা ভয় পেত পূর্বপাকিস্তান জুড়ে নদীর উপর ব্রিজ নির্মাণ করে যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটালে পাশাপাশি রেল লাইনের উন্নতি করলে যদি ভারত সরাসরি ওই রাস্তা দিয়ে এসে আক্রমণ করে। তাই বেশির ভাগ নদীর উপর দিয়ে স্থায়ীভাবে ব্রিজ নির্মাণ না করে ফেরির মাধ্যমে অস্থায়ীভাবে যাতায়াত ব্যবস্থা সচল রাখত। আর পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নের টাকা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করত। পাকিস্তানের যেসব সেনাশাসক ও তাদের দোসরেরা পূর্ব পাকিস্তানে তাদের স্বীয় দায়িত্ব পালন করে গেছেন পরবর্তীতে তাদের ভিতর অনেকেই নিজের লেখা বইয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে একটি সাপ-কোপ, নদী-নালা, জ্বিন-পরীর অঞ্চল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অথচ এই অঞ্চলের উন্নয়নের কথা তারা কখনো ভাবেননি। যে কারণে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের সার্বিক যাতায়াত ব্যবস্থা যেমন রাস্তা-ঘাট, নদীর উপর সেতু, কালভার্ট ইত্যাদি না থাকায় দূরের যাত্রায় তিনঘণ্টার স্থলে দুই-তিনগুন বেশি সময় লেগে যেত। নদীর উপর ব্রিজ না থাকায় দুই পারের যানবাহনগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করত ফেরির জন্য। অপর দিকে ফেরিতে আগে কে পার হবে যানবাহনের ড্রাইভারদের মধ্য সেটি নিয়ে পাল্লা লেগে যেত। ফলে প্রায়ই সাধারণ মানুষ দুর্ঘটনার শিকার হয়ে হয় মৃত্যু না হয় চির পঙ্গুত্ব বরণ করত।
স্বাধীন বাংলাদেশে ’৭১ পরবর্তী পরিস্থিতিতে যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু সাড়ে তিন বছরে অনেক চেষ্টা করেছেন। পঁচাত্তর পরবর্তীতে দীর্ঘ একুশ বছর বাংলদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে ছিল। ক্ষমতায় এসেই বঙ্গবন্ধুকন্যা অগ্রাধিকার দিলেন জাতির জনকের স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিকে। পিতার সান্নিধ্যে থেকে তিনি জানতেন বাংলাদেশকে নিয়ে পিতার স্বপ্নের কথা। গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতায় যখন তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতা পেলেন, দেশবাসী সাক্ষী, উন্নয়ন প্রকল্পে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে তিনি কি ঝুঁকি নিয়েছেন। কারণ তিনি জাতির জনকের কন্যা। দেশ মাতৃকার টানে তিনিই তো জাতিকে সঠিক পথ দেখবেন। বঙ্গবন্ধুর রক্ত যে তার শরীরে প্রবাহমান। ১৯ বার যিনি মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। জন্ম যখন হয়েছে মৃত্যুর স্বাদও তাকে একদিন গ্রহণ করতে হবে এ কথা তিন বারবার বলেছেন। কিন্তু কোনো অন্যায়ের কাছে তিনি মাথানত করবেন না। তার সৎ সাহস দেখে নতুন প্রজন্ম সাহসী হয়ে ওঠে। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে একে একে তিনি বাস্তবায়ন করে চলেছেন মেগা প্রকল্পসমূহ। সেই মেগা প্রকল্পের একটি পদ্মা সেতু। যে সেতুটির মাধ্যমে রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৭টি জেলার তিন কোটি মানুষের জন্য সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। বহু আকাক্সিক্ষত এই সেতুটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাবে।
একসময় চীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতায় তারা হোয়াংহো নদীর উপর সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করে। জাতি গঠনে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন চীনকে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও বিশেষজ্ঞ দিয়ে সাহায্য করেছিল। কারণ সে সময়ে চীনের কাছে মাটি কাটার জন্য আধুনিক যন্ত্র পর্যন্ত ছিল না। পরবর্তীতে মতাদর্শগত পার্থক্য উপস্থিত হওয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন সেই সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়। ফলে সেতু নির্মাণ কাজ মাঝপথে থেমে যায়। উপায়ন্তর না দেখে চীনা জনগণ নিজেদের অর্থে সেই সেতু নির্মাণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। চীনের অবিসংবাদিত নেতা মাও সেতুং তখন চীনকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেই অবস্থায় চীনারা নিজেদের যা কিছু আছে তাই নিয়েই শুধুমাত্র মনোবলকে পুঁজি করে সামনে এগিয়ে গিয়েছিলেন। একসময় হোয়াংহো নদীর উপর সেতু নির্মাণের কাজ তারা সফলভাবে শেষ করেছিল। এখনো সেই সেতুর যে অংশ তারা নিজেরা নির্মাণ করেছিল সেটি চিহ্নিত করে রেখেছে। পাশাপাশি ফলকে সেই সেতু নির্মাণের ইতিহাসও তারা লিপিবদ্ধ করে রেখেছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। তারা প্রমাণ করেছে নিজেরা স্বাবলম্বী হলে কারও উপর নির্ভর করার প্রয়োজন হয় না।
’৭৫ পরবর্তী যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে তারাই বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য দাতা সংস্থা থেকে সাহায্য নিয়েছে কঠিন শর্তে। কোনো সরকারই নিজ দেশকে স্বাবলম্বী করবার কথা চিন্তা করেনি। কারণ ক্ষমতা গ্রহণ করেই তারা তাদের বিদেশি প্রভুদের খুশি করতেই ব্যস্ত ছিল। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে জাতির জনক যখন এ দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো মজবুত করবার প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছেন তখন অনেক দেশই খাদ্যসহ অন্যান্য সাহায্য পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু সঠিক সময়ে তারা তাদের দেওয়া কথা রাখেনি। আমরা ইতিহাস থেকে জানতে পারি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সেসব খাদ্য সাহায্য এদেশে এসেছিল। এ থেকেই বোঝা যায় ১৫ আগস্টের নিষ্ঠুর হত্যাকা-ের পর যারাই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে তারা এদেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে কতটুকু আন্তরিক ছিল। যিনি এদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে এই দেশের জনগণকে মুক্ত করেছেন। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা তাকে ধরে রাখতে পারিনি। বর্তমানে তারই সুযোগ্য কন্যা দেশ পরিচালনার জন্য জনগণের রায় নিয়ে ক্ষমতায় বসেছেন। পিতার আদর্শ যার রক্তে মিশে আছে তার কাছে ছাড়া এই দেশ কার কাছে নিরাপদ থাকবে?
নিজেকে আবিষ্কার করতে পারলেই মানুষ আত্মশক্তি অর্জন করে। তখন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এগিয়ে যেতে পারলেই তারা সফলকাম হয়। পরনির্ভরশীলতা জাতিকে পঙ্গু করে দেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুব ভালোভাবেই এটি উপলব্ধি করতে পেরেছেন। যে কারণে শত বাধা পেরিয়ে বিশ্বের দরবারে বাঙালি জাতিকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখাচ্ছেন। এ কারণে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘আমাদের পথ আমাদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে’ ও ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েই হোক আর আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়েই হোক বিশ্বব্যাংকের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে জাতির জনকের কন্য দেশের টাকায় পদ্মা সেতুর মতো একটি মেগা প্রকল্প গ্রহণ করে স্বাবলম্বী হওয়ার যে বিরল দৃষ্টান্তস্থাপন করলেন তা আগামী প্রজন্মের জন্য মাইলফলক হয়ে থাকবে। এখান থেকেই তারা শিক্ষা নিবে দেশ গঠনে স্বাবলম্বী হওয়ার বিকল্প নেই। স্বনির্ভর হয়ে আত্মশক্তি অর্জন করে দেশ গঠনে আগামী প্রজন্মকে এগিয়ে যাওয়ার যে দিকনির্দেশনা তিনি দিয়ে গেলেন পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র যতদিন এই পৃথিবীতে টিকে থাকবে ততদিন এদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুকন্যা, জননেত্রী শেখ হাসিনাকে স্মরণ করবে।
লেখক: সাবেক ছাত্র নেতা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান