আমাদের অর্থনীতিকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে সাবেক সচিব, কূটনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোফাজ্জল করিম সংলাপ-সমঝোতা ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য ছাড়া সংকটের সুষ্ঠু সমাধান কখনোই সম্ভব না
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশিক রহমান
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশবাসীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল, আর যাই হোক, এর পুনরাবৃৃত্তি কেউ চায় না। ওই নির্বাচন জাতিকে সাংঘাতিকভাবে হতাশ, বিক্ষুব্ধ ও একধরনের পশ্চাৎপদ করে ফেলেছিল। মানুষের প্রত্যাশা, এবার আর সে রকম কিছু হবে না। সব দলের অংশগ্রহণে একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবেÑ আমাদের অর্থনীতিকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেন সাবেক সচিব, কবি, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোফাজ্জল করিম।
তিনি বলেন, সন্ত্রাস, সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলামুক্ত নির্বাচন হওয়া সময়ের দাবি। এমন একটা পরিবেশ তৈরি করতে হবে যাতে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে। ভোট দিতে সমর্থ হয়। সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচনই এখন জনদাবি। সেই নির্বাচন হতে পারে নির্বাচন কমিশনের সঠিক নেতৃত্বে, যেখানে তারা কোনো ধরনের পক্ষপাতমূলক আচরণ করবেন না। সরকার ও সব কটি রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা নিয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা তাদের দায়িত্ব। দেশবাসীও এটা চায়। এর ব্যত্যয় হলে নির্বাচন সুষ্ঠু ও সুন্দর হবে না।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে এখন আলোচনা তুমুল। সরকার ও বিরোধী দলগুলো যার যার আগ্রহের জায়গাটা তুলে ধরছেন। এ নিয়ে কথা বলছেন। প্রশ্ন হচ্ছেÑ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কী ধরনের সরকার গঠিত হওয়া উচিত? আমি মনে করি, কোনো দলীয় প্রধান বা কোনো দলের ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় নির্বাচন হলে সেটা নিরপেক্ষ হবে না। অন্তত এদেশে এটা হবে না। কারণ এখনো আমরা সেই রাজনৈতিক পরিপক্কতা অর্জন করতে পারিনি। অতএব নির্বাচনকালীন সময়ে একটি নিরপেক্ষ সরকারÑ সে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তত্ত্বাবধায়ক, সহায়কÑ নিরপেক্ষ থাকতে হবে। কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নয়, নিরপেক্ষ একটা সরকারের অধীনেই নির্বাচন হওয়া উচিত।
মোফাজ্জল করিম বলেন, নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে একটা স্থায়ী সমাধান এখনো না হওয়াটা দুঃখজনক। তবে এই না হওয়ার পেছনেও অনেক কারণ রয়েছে। এ বিষয়ে একটা স্থায়ী সমাধান তো হয়েই গিয়েছিল। ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ আন্দোলন করল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য, তখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। আন্দোলনের মুখে বিএনপি তা মেনে নিতে বাধ্য হলো। দেশবাসীও এই ভেবে খুব খুশি হলো যে, নির্বাচন আর প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারবে না। সেই পদ্ধতি তো ভালোই চলছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হওয়ার পর যে কটি নির্বাচন হয়েছে তা তো মোটামুটিভাবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষই হয়েছে। এই সরকার পদ্ধতি নিয়ে বাদ-প্রতিবাদ কোথাও তেমন হয়নি বললেই চলে। ২০০৮ সালে বিপুল সংখ্যক আসন নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সংবিধানের সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো সংশোধন করে একসময় তাদেরই আন্দোলনের ফসল তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে দিল। এটা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ একটা সংশোধন। প্রশ্ন হচ্ছেÑ কেন সংশোধন করা হয়েছিল সংবিধান? নিশ্চয়ই কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। এই সংশোধনী মানা যায় না।
তিনি বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে সকলকে বসতে হবে। সবকটি রাজনৈতিক দল নিয়ে বসুন, আলাপ-আলোচনা করুন, প্রয়োজনে সংবিধান আবারও সংশোধন করুন। সংবিধান সংশোধন তো ওখানেই থেমে থাকতে পারে না। দেশ, জাতি ও রাষ্ট্রের স্বার্থে আলাপ-আলোচনা করুন। দরকার হলে আবার আইন পাস করুন সবার সম্মতি নিয়ে। আমাদের তো এ ধরনের উদাহরণ নিকটঅতীতেও আছে। এখন নির্বাচন নিয়ে যে জিনিসটা হচ্ছেÑ এটা রাজনীতিকে কলুষিত করছে এবং গণতন্ত্রের পথকে বাধাগ্রস্ত করছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের জন্য সবাইকে একটা ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচন নিয়ে সমঝোতা হবে কি না জানি না। তবে সংলাপ তো অবশ্যই হতে হবে। এরপরেও যদি সমঝোতা না হয় তাহলে সেটা হবে দুর্ভাগ্যজনক। তবে সংলাপে না বসে, আলাপ-আলোচনা না করেই আগে থেকে ধরে নেওয়া যায় না যে কোনোরকমে ঐকমত্যে পৌঁছানো যাবে না, সমঝোতা হবে না। এমন অবস্থান সঠিক হবে না। বসুন, সংকট, সমস্যা নিয়ে আলোচনা করুন। সমাধান বের করুন। কিন্তু আলাপ-আলোচনায় মনে হয় আওয়ামী লীগের প্রচ- অনীহা রয়েছে। কারণ আওয়ামী লীগ জানে, তাদের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে দু-চারটি দল আছে তারা ব্যতীত আর কেউ-ই তাদের এই দলীয় ব্যবস্থায় নির্বাচন মানতে রাজি নয়। সংলাপ নিয়ে তাই তারা শঙ্কিত। কারণ তাদের অনুমান, সংলাপে বসলে বর্তমান দলীয় সরকারের অধীনের নির্বাচনি ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়ে যাবে। আমি মনে করি, সংলাপ-সমঝোতা ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য ছাড়া সংকটের সুষ্ঠু সমাধান কখনোই হবে না।
এক প্রশ্নের জবাবে এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ইতোমধ্যেই বিএনপি তার অবস্থান জাতির সামনে তুলে ধরেছে। আমি তো মনে করি নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে তারা যে অবস্থান তুলে ধরেছে তা ঠিকই আছে। অর্থাৎ বিএনপির প্রথম কথা হচ্ছেÑ আমরা নির্বাচন করতে চাই। নির্বাচনে অংশগ্রহণও করব। তবে হ্যাঁ নির্বাচনে যেতে হলে সকলের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের দাবিÑ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নয়, নিরপেক্ষ সরকার হতে হবে। বিএনপিকে এজন্য আলাপ-আলোচনা, লবিং, জনমত সৃষ্টি করে এগোতে হবে। প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গেলে দাবি আদায় করতে তারা সমর্থ হবে। সম্পূর্ণ না হলেও আংশিক দাবি মানতে বাধ্য হবে সরকার।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে মোফাজ্জল করিম বলেন, বিএনপির রাজপথবিমুখীতা দৃষ্টিকটু। দলটি এখন শুধুমাত্র অফিস কেন্দ্রিক একটা দলে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। রাজপথে যে ৩৬৫ দিন বসে থাকতে হবে তার কোনো মানে নেই। কিন্তু যে বক্তব্য তারা দেশবাসীর কাছে তুলে ধরছেন সেটা অফিসে না বসে রাজপথে গিয়ে বলতে হবে, মিটিং-মিছিল করতে হবে। জনগুরুত্বপূর্ণ সব ইস্যুতে রাজপথে সক্রিয় থাকুন। বাধা-বিপত্তি আসবে, প্রতিকূলতা থাকবে, তাই বলে রাজপথবিমুখীতা? এটা ঠিক হচ্ছে না বিএনপির। শুধু দলীয় অফিসে বসে বক্তৃতা দিলে হবে না, প্রেস কনফারেন্সে কথা বললে হবে না, রাজপথে নামতে হবে। দলের কোটি কর্মী-সমর্থককে সম্পৃক্ত করে আন্দোলন করতে হবে। বিভিন্ন ইস্যুতে জনগণের কাছে যেতে হবে।
তিনি বলেন, সারাদেশে বিএনপির অগনিত কর্মী-সমর্থক ও শুভাকাক্সক্ষী রয়েছে। তারা ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছে। হতাশ হয়ে পড়ছে। তারা যদি একবার হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে তাহলে ২০১৮ বা ২০১৯ যখনই নির্বাচন হোকÑ তাদের তখন উজ্জীবিত করতে বেশ বেগ পেতে হবে বিএনপিকে। আমি মনে করি, এখন থেকেই শুরু করা উচিত দলটির সাংগঠনিক তৎপরতা। বিএনপির নেতৃত্ব বলতে পারেন, আমরা সাংগঠনিক তৎপরতা দেখাব কি করেÑ আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গেলেই তো আমাদের গ্রেফতার হতে হয়। মামলা-হামলার শিকার হতে হয়। গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে ঘুরতে হয়। এটা যেমন সত্য, আবার এটা সবার জানাÑ রাজনীতিতে মামলা-হামলার সংস্কৃতি এদেশে দীর্ঘদিনের। সেটা ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল থেকেই চলে আসছে এবং এখনো তা বর্তমান। মামলা-হামলার ভয় পেলে কি রাজনীতি করা যাবে?
তিনি আরও বলেন, বিএনপির আদর্শিক বা দার্শনিক চিন্তাধারা খুবই উঁচুমানের। কিন্তু তা শুধু বইয়ের পাতার মধ্যে লিখে রাখলেই কি কাজ হবে? বিএনপির আদর্শিক কোনো সমস্যা নেই। দলের নেতৃত্বে যারা আছেন, তারা যদি রাজপথে বের না হয়ে আসেন, কর্মী বাহিনীকে যদি উজ্জীবিত করতে না পারেন, তাদের নিয়ে যদি ময়দানে না যান তাহলে আবারও আওয়ামী লীগকে ওয়াকওভার দিতে হবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে বিএনপির অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক এই সচিব বলেন, আমার মতে, প্রত্যাশিতভাবে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়নি। কমিশনে দলীয় ছাপ রয়েছে। এটা নিয়ে বিতর্ক করে লাভ নেই। অভিযোগ উঠেছেÑ প্রধান নির্বাচন কমিশনার জনতার মঞ্চের লোক। যদিও তিনি তা অস্বীকার করেছেন। অস্বীকার করলে কি হবে, দুনিয়ার লোক এ বিষয়ে জানে। এ নিয়ে যদি বাহাস হয় তাহলে অনেক দলিল উপস্থাপন করা যাবে। যেহেতু মহামান্য রাষ্ট্রপতি তাকে নিয়োগ দিয়েছেন, এ নিয়ে আর কোনো বিতর্ক করা যাবে না। নির্বাচন কমিশনের প্রতি আমার সম্পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। এখন জনমনে যে প্রশ্ন উঠেছে, যে আস্থার কথা বলা হচ্ছেÑ তা প্রধান নির্বাচন কমিশনারকেই নিশ্চিত করতে হবে। মানুষ নতুন নির্বাচন কমিশনারদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করছে। আশা করছি, কমিশনাররা তাদের কাজ দিয়ে নিরপেক্ষতার প্রমাণ করবেন।
অনুলিখন: তানভীন ফাহাদ