অসৎ সমালোচনার একটা উৎকৃষ্ট নিদর্শন হলো হরেদরে সবাইকে এক করা
ফিরোজ আহমেদ
কদিন আগেই একবার লিখেছিলাম, অসৎ সমালোচনার একটা উৎকৃষ্ট নিদর্শন হলো হরেদরে সবাইকে এক করা, তারপর শূলে চড়ানো। পিনাকী ভট্টাচার্যের সাম্প্রতিক একটি লেখায় এই হরেদরে এক করার বিষয়টি আবারও দেখতে পেলাম।
এক. যেমন, তেভাগা আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা। তৎকালীন কংগ্রেসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির শ্রেণিগত সীমাবদ্ধতা নিয়ে বহু লেখা আছে। তেভাগা আন্দোলন এর মতো একটি গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রাম কিভাবে ব্রিটিশ উচ্ছেদের মতো একটি সম্ভাবনায় যেতে ব্যর্থ হলো, সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা পাওযা যাবে বদরুদ্দীন উমর এর ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও বাংলাদেশের কৃষক’ গ্রন্থটিতে। কিন্তু তেভাগা আন্দোলন তার চূড়ান্ত সম্ভাবনা পূরণ করতে পারেনি বলেই কি তা বাংলাদেশের জনগণের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছে! কোনোভাবেই কিন্তু না। পিনাকী ভট্টাচার্য দাবি করেছেন যে, মুসলিম লীগ এবং কৃষক প্রজা পার্টি জমিদারি উচ্ছেদের জন্য আন্দোলন করেছিল। ৪৭ সালের আগেই, তেভাগার আন্দোলন দানা বাঁধার বহু আগেই ১৯৩৭ সালে কৃষক প্রজা পার্টির ফজলূল হক বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হন, মুসলিম লীগের সঙ্গে গাটছড়া বেঁধেই। জমিদারি প্রথা কিন্তু উচ্ছেদ হয়নি, মহাজনি আইনের কিছু সংশোধন হয় শুধু। যদিও এর জন্যও দলের ভিতর থেকে বিপুল চাপ এসেছিল।
বাংলায় কংগ্রেস নিজে ছিল প্রধানত হিন্দু জমিদারদের দল। ফলে যেকোনো কৃষক আন্দোলনের তারা ছিল বিরোধী। আর মুসলিম লীগ! সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আওয়াজ তুলে, কৃষককে জমি দেওয়ার কথা বলে যারা পাকিস্তান কায়েম করেছিল, সেই মুসলিম লীগও ৪৭-এর আগে জমিদারি উচ্ছেদের চেষ্টা চালায়নি এবং ৪৭-এর দেশভাগের পরও তারা জমিদারি উচ্ছেদের বিলের সঙ্গে ক্ষতিপূরণের কথা জুড়ে দেয়। অর্থাৎ, ইতোমধ্যেই ক্ষয়িষ্ণুপ্রায়, আর্থিক দিক দিয়ে অক্ষম ও রাজনৈতিকভাবে প্রায় দেউলিয়া জমিদারদেরও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রস্তাব মুসলিম লীগের প্রধান সারির নেতাদের কাছ থেকেই আসে। কেননা, শ্রেণির প্রশ্নটি প্রায়ই সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নের চেয়েও বড়ো, কেননা উচ্চশ্রেণি এই নৈকট্য অনুভব করে। কেননা, ঢাকার নবাবরাসহ বেশ কজন জমিদার ছিলেন মুসলিম লীগেরই প্রধান নেতা। এর বিরোধিতা করেছিলেন কারা? মুসলিম লীগের ‘বামপন্থি’ অংশ বলে পরিচিতরা।
কিন্তু আসি তেভাগার প্রশ্নে। তেভাগা শুধু জমিদারদের বিরুদ্ধে পরিচালিত আন্দোলন ছিল না। তেভাগা জোতদার-মহাজনসহ গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামোতে সামন্ত এবং কৃষক স্বার্থবিরোধী উপদানগুলোর বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলন। জমিদারদের প্রভাব তখন কিভাবে হ্রাস পাচ্ছিল, জোতদার ও মহাজনরা গড়ে উঠছিল, তার বর্ণনা কিছুটা পাওয়া যাবে যেমন প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের আত্মজীবনীতে, কিছুটা মিলবে জয়া চ্যাটার্জির বেঙ্গল ডিভাইডেড-এ। তো জমিদার-জোতদার-মহাজনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা তেভাগা সকল কৃষকের আন্দোলন ছিল না, প্রধানত ছিল ভাগচাষীর আন্দোলন। এই ভাগচাষীকে আন্দোলনে উদ্দীপ্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় দাবিই কৃষকসভাকে তুলতে হয়েছিল।
কিন্তু, ‘জমিদারি উচ্ছেদে ব্যর্থ’ এই তেভাগা কি বাংলাদেশের মানুষের কোনো দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী? না। বরং, রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিশ্বযুদ্ধ ইত্যাদির প্রভাবে, নিজেদের শ্রেণিগত দুর্বলতার কারণে এবং কৃষক আন্দোলনের চাইতে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার আন্দোলন অনেক বেশি মনোযোগ দখল করার বাস্তবতায় এটার রাজনীতি বিকশিত হতে পারেনি বটে, কিন্তু এই আন্দোলনের প্রভাবে একদিকে বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজকে গণতান্ত্রিক করে, নারীর বিপুল অংশগ্রহণ নারী-পুরুষের ভারসাম্যে একটা ইতিবাচক অগ্রগতি নিয়ে আসে। তারও চেয়ে বড় কথা, এর চাপে মুসলিম লীগের মতো দলেও কৃষকদের দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল দাবি উত্থাপতি হয়।
দুই. পরের দাবিগুলোও নিতান্তই অবিবেচনাপ্রসূত। যেমন, ভারত ভাগ। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি কৃষক শ্রমিকের রাজনীতির লাগাম ছেড়ে দেওয়া মাত্র তার পক্ষে অন্যদের অনুবর্তী না হয়ে উপায় ছিল না। ভারত ভাগের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের প্রস্তাব দলগতভাবে তারা আগে তোলেনি। কিন্তু নিজেদের রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার ওপর ভরসা না থাকায় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের পাকানো দেশভাগেই তারা সম্মতি দিয়েছে। পার্টিভুক্ত কেউ কেউ সমাধান আকারে এটা আগে তুলে থাকলে তার দায় সকলের ঘাড়ে চাপানোর কিছু নেই। বরং, যদি তার কিছুটা দায় থেকে থাকে সেটা নিজেদের ওপর ভরসা না করে সমালোচনাটা এই লীগ ও দল নির্ভরতাতেই। কিন্তু প্রসঙ্গক্রমে আমরা বরং জানতে চাইতে পারি, ভারত ভাগকে যারা দুর্ভাগ্য মনে করেন, তাদের পক্ষেই মুসলিম লীগের প্রশংসা করাটা বাস্তবিকই কি করে সম্ভব হয়।
তিন. পাকিস্তানে ক্ষমতা দখল করার চেষ্টা কেন খারাপ কিছু না, সেটা বুঝতে হলে শতকের ওই সময়টার দুনিয়ার হালচালের দিকে নজর বোলাতে হবে। মুসলিম লীগ অতি অল্পদিনেই পাকিস্তানকে একটা নরকে পরিণত করেছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজীবনীতে তার কিছুটা চিত্র পাওয়া যাবে। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না সামরিকবাহিনীর হস্তক্ষেপ কাম্য, রাজনীতি করতে চাইলে চাকরি ত্যাগ করে মাঠে আসাই কর্তব্য। কিন্তু দেশের ওই দূরাবস্থায় যারা কিছু একটা করতে গিয়েছিলেন কতিপয় বুদ্ধিজীবী আর রাজনীতিবিদকে সঙ্গে নিয়ে, তারা রাষ্ট্রের আইনে বিচারযোগ্য হতে পারেন, কিন্তু তারা জনগণের দুর্ভাগ্য বৃদ্ধি করেছিলেন, এমনটা নয়। কিন্তু যে অভিযোগ পিনাকী ভট্টাচার্য করেছেন সেনা অভ্যুত্থান ঘটবাবার, তা নিতান্তই অমূলক, কোনো সোভিয়েত বা পার্টিগত দলিল এর পক্ষে পাওয়া যাবে না। প্রধানত উৎসাহী সামরিক ব্যক্তিরাই এটা ঘটিয়েছিলেন। পাকিস্তানে সামরিকবাহিনীর ক্ষমতাবান হয়ে ওঠার সঙ্গেও এর সম্পর্ক সামান্যই। বরং এই বিষয়ে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের বক্তব্যই প্রণিধানযোগ্য, এই ক্ষমতার সূত্রপাত পাকিস্তানের অর্থনীতিতে এবং রাজনীতির ভারসাম্যহীনতায় খুঁজতে হবে।
চার. স্বাধীনতা যুদ্ধ বিষয়ে সিপিবির ভূমিকাকে নিন্দা করতে গিয়ে বেমালুম ভুলে যাওযা হলো যে, সিপিবির ওই উদ্ধৃতিতেই হঠকারী হিসেবে চিহ্নিত করা মওলানা ভাসানীও কমিউনিস্টদেরই প্রবলতর অংশের নেতা ছিলেন। হরেদরে সমালোচনার শেষে শূলবিদ্ধ করার আগে এটা খেয়াল করা হয়নি যে, সিপিবি তখন প্রায় স্বাধীন রাজনীতি হারিয়ে আওয়মী লীগের দিকে তাকিয়ে ছিল কর্মসূচির জন্য এটা যেমন সত্য, তেমনি সত্য নানা বিপ্লবী কমিউনিস্ট দল ও গ্রুপের স্বাধীনভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া।
পাঁচ. ভাসানীর আইয়ুব খানকে ত্যক্ত না করার নীতির কোনো সূত্র কিংবা বরাত কখনো পাইনি। পেলে এই বিষয়ে আলোচনা করা যো। যেকোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বই ভুল করতে পারেন, তার যথাবিহিত সমালোচনা এবং পর্যালোচনা রাজনীতির কর্তব্য। কিন্তু ভুল এবং মোটা দাগের সমালোচনা আমাদের অহমকে বিপুল আমোদ দিতে পারলেও কোনো পথ দেখায় না। একই প্রসঙ্গে, বাকশালে সিপিবির অংশগ্রহণ আসলে তেমন কোনো প্রভাব ফেলেনি, কমিউনিস্ট শক্তির তারা গৌণ অংশ ছিল তার আগে থেকেই। বরং আশির দশকে তাদের কিছুটা শক্তিবৃদ্ধি শুরু হয় সোভিয়েত ভর্তুকির কল্যাণে।
সত্যি বলতে কি, বাংলাদেশের কমিউনিস্টদের কোনো কাজ যদি জনগণের জন্য সত্যিকারের দুর্ভাগ্য ডেকে আনে, সেটা ৭০-এর নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার মাঝে পাওয়া যাবে। এই নির্বাচনে অংশ না নিয়ে তারা দেশ স্বাধীন করার যে সশস্ত্র প্রস্তুতি নিতে থাকে, তার পরিণতিতে তারা ৭০-এর নির্বাচনের জনরায়ের ভাগ থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে মুক্তিযুদ্ধে বিপুল আত্মত্যাগ, অন্য যেকোনো রাজনৈতিক ধারার চেয়ে বেশি সংখ্যক কর্মীর মৃত্যু, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নয় শুধু, প্রায় সবগুলো মুক্তাঞ্চলের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও দেশ স্বাধীন হবার পর সাংবিধানিক রাজনীতিতে তাদের কোনো বৈধতা ও প্রতিনিধিত্ব ছিল না। ফলে, প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর ভাষায়, আইয়ুবী সংবিধানই নতুন করে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে কায়েম করতে সক্ষম হয়।
ফলে, পিনাকী ভট্টাচার্যের সঙ্গে একমত হওয়া খুব কঠিন। দেশের অধিকাংশ দুর্ভাগ্যের জন্য তাদের দায়ী করা কঠিন। তবে তাদের দায় একেবারে নেই তা না, কিন্তু সেই দায় বিষয়ে তাদের আত্মসমালোচনা ও পর্যালোচনা নেই এটাও ঠিক না। বরং বলা যায়, পিনাকী ভট্টাচার্যের এই লেখায় সেই অর্থে নতুন কিছু নেই। তবে, পিনাকী ভট্টাচার্যের লেখাতেই বোঝা যাবে, কর্তা হিসেবে এই দায়গুলো কংগ্রসের, মুসলিম লীগের। কখনো কখনো তাদের অনুবর্তী হিসেবে কোনো কোনো বামপন্থি দলের। বলেননি বটে, নিশ্চয়ই তিনি মানবেন, মৌলবাদী দলগুলোরও।
বাকি দলগুলোল সঙ্গে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দলগুলোর একটা অন্তত মৌলিক পার্থক্য আছে। বাকিরা চরিত্রগতভাবেই লুণ্ঠক, দুর্নীতিপরায়ণ এবং জনগণের স্বার্থ তাদের প্রধান বিবেচনার বিষয় না। কমিউনিস্টরাও ভুল করতে পারেন, কিন্তু পরজীবী বৈশিষ্ট্য ঝেড়ে নিজের পায়ে জনগণকে ভরসা করে দাঁড়াবার চেষ্টা করলে সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা নির্বিশেষে তাদের কারণে জনগণের ক্ষতি হবার মতো কিছু নেই।
লেখক: কেন্দ্রীয় সদস্য, গণসংহতি আন্দোলন/ফেসবুক থেকে