‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’Ñ বিবেচনা ও পুনর্বিবেচনা
ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
সারা বছরই নারী তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্বের সকল নারীকে এক বিশেষ দিনে আবদ্ধ করে নারী মুক্তি, নারীর মান, নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি, নারীর ক্ষমতায়ন, নারী নেতৃত্ব, নারী-পুরুষ সমতায়ন, জেন্ডার ইস্যু ইত্যাদি নিয়ে অনেক লেখালেখির সাক্ষাৎ পাওয়া গেল বিগত কয়েকদিন ধরে। বিগত ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদ্যাপিত হলো। এই উপলক্ষে সেমিনার, সমাবেশও হয়েছে। অনেক জায়গায় অনেক ঘটা করে ও উৎসবমুখর পরিবেশে দিবসটি পালিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের নারীরা কি বিশেষ দিনের নাকি বছরের সব দিনের জন্যই তা বিবেচনার দাবি রাখে।
আমাদের নারীরা কিন্তু সারা বছরই কর্মব্যস্ত থাকেন বা রাখা হয়। ঘরে-বাইরে সর্বত্রই তাদের ভূমিকা থাকে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তখন আমাদের এই নারীদের এক বিশেষ দিনের কর্মসূচিতে নারী দিবস পালন করে তাদের মর্যাদা ও অবস্থানকে খাটো করা হয়নিÑ তা ভেবে দেখার বিষয়। নারী দিবসে নারীকে নিয়ে কোনো ভাবনা, কোনো ইস্যুর বিষয় নয়। বরং নারী যেন কোনো সমস্যার বিষয় না হয়ে আবির্ভূত হন সে ব্যাপারে আমাদের সর্বদাই সজাগ থাকতে হবে। তবে নারী উন্নয়ন ঘটনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হওয়া যা কি না আমাদের সময়ের দাবি। সে বিষয়ে মনোযোগী হওয়া নিতান্তই হেলাফেলার বিষয় নয়।
তবে আমার কাছে মনে হয়, নারীদের নারী দিবসে উদ্যাপনের মধ্যে দিয়ে তাদের মহিয়ান করে তোলা হয়। তাদের বিশেষ দিনেই গুরুত্ব দেওয়া যায়, বিশেষ দিনে আটকে দেওয়া হয় বা আবদ্ধ করা হয় বা খাটো করা হয়ে থাকেÑ এ সম্পর্কে মতধারা কোনোক্রমেই ধোপে টিকবে না। তবে অনেকে মনে করেনÑ এই নারী দিবস পালন করে নারীর অবস্থানকে সুউচ্চে আসীন করা হয়ে থাকে। যা শুধু কি না একটা বিশেষ বলয় বা সীমারেখার মধ্যে সীমিত রাখার জিনিস নয়। নারীরা কোনো বিশেষ এলাকা বা অঞ্চল বিশেষের নয়। তারা সর্বকালের সর্বযুগের কামনা-বাসনার চিরায়ত বোধকে একটা সর্বজনীনরূপে চরিতার্থ করে সুন্দর, শান্তি ও মায়াময় জগতের প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন।
একজন নারীর মুখে দেশমাতার ছবি ভেসে ওঠে। একজন নারী যখন মা, তখন তার মধ্যে তার সন্তানের যতœ, লালন-পালন ও সার্বিক সেবা-শুশ্রƒষার জলন্ত মূর্তি ফুটে ওঠে। একজন নারী সেবা ও ভালোবাসার মূর্ত ও বিমূর্ত প্রতীক। নারী আবার বিভিন্ন ছলনায় একটি সাজানো বাগানকে তছনছ করে ফেলতে পারে। ইতিহাসের অনেক উত্থান-পতনের মহানায়িকা হয়ে ইতিহাসকে অনেক উজ্জ্বলতা আবার আধারের ম্লান চিত্রও এঁকে দিয়েছেন।
গ্রহণ-বর্জন, আলো-আঁধারের লীলায় মত্ত থাকেন আমাদের নারী চরিত্র। নারীকে নিয়ে অনেক প্রেম-ভালোবাসার গল্প গাথা রচিত হয়েছে। সাহিত্যের পাতায় তার দ্বার অবারিত। সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় নারী এসে তার প্রবহমানতার হাল ধরেছেন। রবি ঠাকুরের নিম্নের উক্তিতে নারীর অবস্থানগত দিক প্রতিভাত হয়েছেÑ
‘আমি নারী, আমি মহিয়সী,
আমার সুরে সুর বেঁধেছে জ্যোৎসা রাতে নিদ্রাবিহীন শশী
আমি নইলে মিথ্যা হতো সন্ধ্যা তারা উঠা
মিথ্যা হতো কাননে ফুল ফোটা।’
নারী সকল বিতর্ক, সংশয়, দ্বিধা ও দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে, উপরের নারী বন্দনাতে তা প্রশ্নাতীত ও সন্দেহাতীত সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নারী আমাদের শক্তি-সামর্থ্যরে এক প্রতিপক্ষ। নারীকে শুধু অবলা, অসহায়া বলে বিদ্রƒপ করা বা ঠেকিয়ে রাখা কখনোই বাঞ্ছনীয় নয়। বরং তার সুপ্ত প্রতিভার বিকাশে যথাযথ সাহায্য, সহায়তা ও সমর্থন দিয়ে তাকে কাজে লাগালে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রÑ প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইতিবাচক ফলাফল আসবে। নারীর প্রতি এই ইতিবাচক মনোভঙ্গিতে নিঃসন্দেহে এক সোনার সংসারের প্রতিফলন ঘটাবে।
পক্ষান্তরে নারীর কোনো দুর্বল অবস্থাকে কটাক্ষ করে তাকে অনাদর, অবহেলা আর অবজ্ঞায় আপদমস্তক নিপতিত করে নিঃশেষ করে দেওয়ার খারাপ মানসিকতাকে পরিহার করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক আলোচনায় কোনো নারীকে গৃহকর্মী বানিয়ে তার উপর অকথ্য, বর্বর ও পাশবিক নির্যাতন করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাদের শৃঙ্খলিত সেবাদাসী বানিয়ে অত্যাচারের খড়গ চালানো নিছক নৃশংসতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
তাই আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রেক্ষাপটে বলতে চাইÑ ‘নারী তুমি সকল সময়ের কল্যাণধাত্রী। তুমি কোনো বিশেষ দিনের নও। তুমি সকল সময়ের বন্ধু, সহযোদ্ধা, সহযোগী ও সহকর্মী। তুমি হও সকল জাগরণের অগ্রদূত।’
লেখক: সাবেক উপ-মহাপরিচালক ও কমান্ড্যান্ট, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি একাডেমি, গাজীপুর
সম্পাদনা: আশিক রহমান