ত্রিমাতৃক নৌবাহিনী : যেখান থেকে শুরু
সৈয়দ রশিদ আলম
ক্যাপ্টেন নিমো, নিজের ডিজাইন করা সাবমেরিনে ভারত মহাসাগর থেকে আটলান্টিক মহাসাগর পর্যন্ত ঘুরে বেড়াচ্ছেন। নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হচ্ছে, তিনি তার মেধা দিয়ে সেই সব জটিলতা দূর করছেন আর সাগরের গহীনে তার সাবমেরিনকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। উল্লেখিত ঘটনাটি ফ্রান্সের বিশ্বখ্যাত উপন্যাসিক জুলভার্ন রচিত ‘টুয়েন্টি থাউজেন্ডস লিগস আন্ডার দ্য সি’ উপন্যাসের একটি অংশ বিশেষ। যদিও উপন্যাসের অংশ বিশেষ, তারপরও জুলভার্ন এমন সময় সাবমেরিনের বর্ণনা তার উপন্যাসে তুলে ধরেছিলেন যখন সাবমেরিন তৈরিই হয়নি। কোনো বিজ্ঞানী সাবমেরিন তৈরির কথা ভাবার আগেই জুলভার্ন তার উপন্যাসে সাবমেরিনের উপস্থিতি তুলে ধরেছিলেন। পরবর্তীতে বিজ্ঞান এক পর্যায় সাবমেরিন আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়। ১৯৪৫ সাল। জাপানি নৌবাহিনীর একাধিক বোমারু বিমান যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই অঙ্গরাজ্যের পার্ল হারবারে হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শতশত যুদ্ধ জাহাজ ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। জার্মানির শাসক এডলফ হিটলার শত্রুপক্ষের দেশগুলোতে বিমান হামলার সঙ্গে সঙ্গে নৌ হামলাও চালাতেন। তারপর থেকে একাধিক দেশ ত্রিমাতৃক নৌবাহিনীর দিকে মনোযোগ দেয়। এক্ষেত্রে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স ত্রিমাতৃক নৌবাহিনী গড়তে সক্ষম হয়। যদিও তখন অত্যাধুনিক যুদ্ধ জাহাজ, হেলিকাপ্টর জঙ্গিবিমান উপকূল রক্ষীবিমান অতটা উন্নতমানের ছিল না।
১৯৭০ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স এই তিনটি দেশ ত্রিমাতৃক নৌবাহিনীর দিকে মনোযোগ দেয় এবং সাফল্য দেখাতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে রাশিয়া, চীন ও ভারত ত্রিমাতৃক নৌবাহিনী গড়ে তোলে। ত্রিমাতৃক নৌবাহিনী গড়ার মূল উদ্দেশ্য হয়, পানির নিচে, পানির উপর ও পানির উপরে অর্থাৎ সাবমেরিন, উপকূল রক্ষীবিমান, উপকূল রক্ষীহেলিকপ্টার, জাহাজ বিধ্বংসী হেলিকপ্টার ও জাহাজ বিধ্বংসী জঙ্গি বিমান নিয়ে গঠন করা হয় ত্রিমাতৃক নৌবাহিনী। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে তারা চেষ্টা করেছে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে নৌবাহিনীকেও উন্নত করতে। প্রথমদিকে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য ব্রিটেন থেকে যুদ্ধ জাহাজ সংগ্রহ করা হতো কিন্তু সেই সকল যুদ্ধ জাহাজ যুদ্ধ ক্ষেত্রে তেমন সাফল্য দেখাতে সক্ষম ছিল কি না প্রশ্ন ছিল। কারণ, ব্রিটিশ নৌবাহিনীর কাছ থেকে যেই যুদ্ধ জাহাজগুলো সংগ্রহ করা হয়েছিল সেইগুলো বেশির ভাগই ছিল ব্যবহার করা যুদ্ধ জাহাজ। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করার পর বাংলাদেশের বিশাল জলসীমা রক্ষার দিকে মনোযোগ দেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীকে যেমন আধুনিক করা হয়েছে তেমনি বাংলাদেশ নৌবাহিনীকেও আধুনিক করা হয়েছে। অর্থাৎ তিন বাহিনীকে যুদ্ধের উপযোগী সরঞ্জাম দেওয়া হয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা, একটি ত্রিমাতৃক নৌবাহিনীর গড়ার দিকে যখন আগ্রহ দেখালেন তখন অনেকই ব্যাপারটিকে বিশ্বাস করতে পারেননি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ নৌবাহিনী একটি ত্রিমাতৃক নৌবাহিনীতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুটি বিশাল আকৃতির ফ্রিগেট, চীন থেকে দুটি মিসাইল ফ্রিগেট, দুটি কর্ভেট, জার্মানি থেকে দুটি অত্যাধুনিক উপকূল রক্ষীবিমান, ইতালি থেকে দুটি উপকূল রক্ষী হেলিকপ্টার সংগ্রহ করার পর শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে চীনের তৈরি দুটি অত্যাধুনিক সাবমেরিন সংযোজিত হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ নৌবাহিনী যুদ্ধকালীন অবস্থায় তার পারদর্শিতা দেখাতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধান ত্রিমাতৃক নৌবাহিনীর কথা যেখানে স্বপ্নযোগেও ভাবতে পারেননি সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্রিমাতৃক নৌবাহিনী গঠন করে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্মানের চূড়ান্ত স্থানে নিয়ে গেলেন। আগামীতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে চীনের তৈরি চারটি অত্যাধুনিক যুদ্ধ জাহাজ, যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি একটি যুদ্ধ জাহাজ, জার্মানি থেকে দুটি উপকূল রক্ষীবিমান ও ইতালি থেকে মিসাইল সজ্জিত দুটি জাহাজ বিধ্বংসী হেলিকপ্টার নৌবাহিনীতে যোগ দেবে। সেই সঙ্গে খুলনার শিপইয়ার্ডে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য ছয়টি যুদ্ধ জাহাজ নির্মাণ হচ্ছে। ভবিষ্যতে খুলনার শিপইয়ার্ডে নৌবাহিনীর জন্য অত্যাধুনিক যুদ্ধ জাহাজ নির্মাণ করা হবে একই সঙ্গে বিদেশে রপ্তানিও করা যাবে। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ত্রিমাতৃক নৌবাহিনী গঠন করার জন্য আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি জানাই আমাদের সালাম।
লেখক: কলামিস্ট/সম্পাদনা: আশিক রহমান