শিক্ষামন্ত্রীর আশা, আমাদের দূরাশা
মঞ্জুরুল আলম পান্না
কোচিং সেন্টারের আড়ালে দেশের বেশ কয়েকটি স্কুলের শিক্ষকদের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁসের শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়েছে। এটা এখন আর কারোর অভিযোগ নয়, খোদ পুলিশ এবং আদালত সূত্রে মিডিয়ার মাধ্যমে দেশবাসী এরই মধ্যে তা জেনে গেছে। আটককৃতদের কেউ কেউ তাদের জবানবন্দিতেও স্বীকার করেছেন তা।
বিসিএস, মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা, উচ্চ মাধ্যমিক থেকে শুরু করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের এই অভিযোগ বেশ কয়েকবছর ধরেই উঠছে। কিন্তু তাতে কর্ণপাত করেননি শিক্ষামন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয় বা অধিদফতরের কোনো কর্তাব্যক্তি। যদিও এসব অভিযোগে বেশকিছু পরীক্ষা বাতিলও করা হয়েছে। আমরা বুঝতে পারি না, এই অস্বীকারের সংস্কৃতির মধ্যে কোনো মহত্ত্ব লুকিয়ে ছিল কি না? পরীক্ষার দিন সকালে কিংবা আগের দিন বিভিন্নভাবে ফাঁস হওয়া ওইসব প্রশ্ন আবার মোটা অংকের টাকায় কিনতে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলে এক শ্রেণির অভিভাবকের মধ্যে। হাতে পাওয়া সেসব প্রশ্ন পরম মমতায় তারা তুলে দেন সন্তানের হাতে।
অসাধু শিক্ষকদের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস, কর্তৃপক্ষের অস্বীকার, সেই প্রশ্ন হাতে পেতে অভিভাবকদের লম্ফঝম্প এবং ফাঁস হওয়া প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া। আদালতের কাঠগড়া থেকে রেহাই দেওয়া হবে কাকে? এখানেই শেষ নয়। পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হার আর জিপিএ ফাইভ প্রাপ্তির সূচকের কাটা যে আকাশচুম্বি তাতে আতঙ্কিত শিক্ষাবিদরা। এসএসসি আর এইচএসসির দুটোতেই জিপিএ ফাইভ পেয়ে যেখানে অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় দুই নম্বর পান সেখানে শিক্ষাবিদদের কপালের ভাঁজ তো একটু বেশি হওয়ারই কথা। তারা বারবার বলছেন, জিপিএ ফাইভ এবং পাসের হার এত বেশি হওয়ার মতো অবস্থায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো পৌঁছায়নি। তাছাড়া পাসের সংখ্যা বাড়ানোর চেয়ে আগে আমাদেরকে শিক্ষার মান বাড়াতে হবে।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে যেমন অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেছি, একইভাবে পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নের উপরেও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছি অনেক। বিভিন্ন পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করা পরীক্ষকদের অনেকে সরাসরি ক্যামেরার সামনে বলেছেন, সেগুলো টেলিভিশনে প্রচারও হয়েছে। উপর থেকে তাদের প্রতি নির্দেশনা থাকে উত্তরপত্র মূল্যায়নের সময় যেন হাত খুলে নম্বর দেওয়া হয়, পাসের জন্য কেউ প্রয়োজনীয় নম্বর না পেলে তাকে যেনো পাস করিয়ে দেওয়া হয়। তবে এ ধরনের নির্দেশনার কোনো লিখিতপত্র দেওয়া হয় না, বলা হয় মৌখিকভাবে। সত্য কথা বলতে গিয়ে নিজের বিপদের কথা জেনেও শিক্ষকদের অনেকে কেন সরাসরি টেলিভিশনে এমন অভিযোগ জানাচ্ছেন? কারণ তাদের পীঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। এমন অনৈতিক কাজ কোনো সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন শিক্ষক সহজে মেনে নিতে পারেন না। অনেকে নিজের বিবেকের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ফেল করা শিক্ষার্থীকে পাস করিয়ে দিচ্ছেন। এমনটা করতে করতে অনেকে ট্রমায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন, বাড়তি কিছু পারিশ্রমিক অর্জনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অনেকে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করার কাজ ছেড়ে দিয়েছেন।
শিক্ষকদের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে পুলিশের বক্তব্য এবং আদালতে অপরাধীদের জবানবন্দির পর অনেকখানি হতাশার সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী এক অনুষ্ঠানে বললেন, ‘সত্যিকারার্থে আমাদের মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষক বেশি দরকার।’ কিন্তু এই শিক্ষকদের কাছ থেকে সেই মূল্যবোধ আমরা আশাই বা করব কোন সাহসে? পরীক্ষায় পাসের হার আর ফলের মান বাড়াতে পরীক্ষকদের যে অনৈতিক নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে খোদ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা থেকে, সেখানে আদর্শবোধসম্পন্ন শিক্ষক থাকলেও তাতে জাতির উন্নতি হবে কতখানি? এককভাবে শিক্ষকদের উপর দোষ চাপিয়ে কোনো লাভ হবে না যেখানে পুরো শিক্ষাব্যবস্থা এবং পরীক্ষা পদ্ধতি প্রশ্নবিদ্ধ।
একদিকে পরীক্ষায় অস্বাভাবিক ভালো ফলাফল নিয়ে সরকারের অহংকার আর অন্যদিকে বছরের পর বছর প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে অস্বীকার; একদিকে প্রশ্নপত্র হাতে পেয়ে এবং পরীক্ষকের হাত উজাড় করা নম্বর পেয়ে কথিত ভালো ফল করে শিক্ষা জীবনের চূড়ান্ত পর্বে গিয়ে ধ্বসে পরা, আর অন্যদিকে সারাবছর কঠোর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে ভালো ফলা করা শিক্ষার্থীদের মাঝে সৃষ্ট হতাশা। এ সবকিছুর যোগফল শিক্ষার মেরুদ-টাকে কতখানি মজবুত করছে তা হিসেব করতে গেলে আতঙ্কিত হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
সম্পাদনা: আশিক রহমান