শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন কেন দরকার?
মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম
১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানিকর্তৃক এদেশের শাসন ক্ষমতা দখল করার পর প্রায় একশত বছর তারা শাসনদ- পরিচালনা করে ’ফারসি’কে রাজভাষা হিসেবে বহাল রেখেই। বিগত কয়েকশ বছর ’ফারসি’ ছিল দরবার পরিচালনার ভাষা। ’ফারসি’কে মধ্য এশিয়ার তুর্কি-পাঠান-মোঘল শাষকগোষ্ঠী রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রবর্তন করে। তাদের শিক্ষাব্যবস্থা ছিল আব্বাসিয় যুগের মাদ্রাসাভিত্তিক শিক্ষা কারিক্যুলামের আলোকে। ১৮৩৫ সালে ’ফারসি’র স্থলে ইংরেজিকে রাজকার্য পরিচালনার ভাষা হিসেবে প্রবর্তন করে ইংরেজ কোম্পানি। একইসঙ্গে প্রবর্তন করে তারা মাদ্রাসাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার বদলে ইউরোপিয় ধারার শিক্ষাব্যবস্থা। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিদেশি-বিজাতীয় এসব শাসকেরা কি মতলব হাসিল করার লক্ষ্যে শিক্ষাব্যবস্থা কায়েম করেছিল।
লর্ড মেকলে ছিলেন ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের মূলে একজন সুপারিশকারী। তিনি তার সুপারিশে কোম্পানিকর্তৃক এখানে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার ক্ষেত্রে নীতিগত নানা বিষয়ের অবতারণা করেন। তিনি উল্লেখ করেন, ‘এখন এদেশে অবশ্যই আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে এমন একটি শ্রেণি গড়ে তুলতে, যে শ্রেণির লোকেরা হবে আমাদের এবং আমরা যে কোটি কোটি লোককে শাসন করি সেই শাসিতদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদানকারী যারা রক্তে ও রঙে হবে ভারতীয়, কিন্তু রুচিতে, মতে, নৈতিক দৃৃষ্টিভঙ্গিতে ও বুদ্ধিতে হবে ইংরেজ।’ এ বিষয়ে লর্ড মেকলের ভগ্নিপতি চার্লস ট্রেভেলিয়নের বক্তব্য আরও অর্থবহ আমাদের জন্য। তিনি বলেন, ‘ইংরেজি শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের একটা সুফল হিসেবে এদেশের জাতীয় উদ্যোগ পাশ্চাত্যের বিদ্যা আহরণ ও বিস্তারের কাজে ইউরোপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হবে। ফলে, মহাকালের অলক্ষ্য বিধানে ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন একদিন অবসিত হলেও… আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের উত্তরাধিকারী ভারতবর্ষই হবে ব্রিটিশ মহানুভবতার উন্নততম স্মারক স্তম্ভ।
স্বধীনতা লাভের পঁয়তাল্লিশ বছর পর আজকের আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক অবস্থা এবং এই ব্যবস্থার অধীনে তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের বাস্তব অবস্থা দেখে কি মনে করার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে যে, আমরা স্বাধীন দেশে নিজেদের শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছি? জাতি আজ দুই বিজাতীয় ভাবধারায় বিভাজিত। ওয়াশিংটন বা ইউরোপ-আমেরিকা তথা পশ্চিমা ধারা এবং মধ্য এশিয়ার মাদ্রাসাভিত্তিক ধারা-এই দ্বিমুখি ধারার শিক্ষার প্রেষণে জাতি জর্জরিত। এই শিক্ষাব্যবস্থা স্ব-মুখী নয়, পরমুখী ধারার। এই শিক্ষাব্যবস্থা আধিপত্যবাদী, ঔপনিবেশিক, সাম্রাজ্যবাদী, প্রতারণামূলক, পরাধীন, শোষণবাদী, ব্যবসায়িক ধারার। এই শিক্ষা জাতিকে বিজাতীয় মুল্যবোধের ধারায় বিভক্ত করে। এই শিক্ষায় শিক্ষিতেরা স্বার্থপর, আত্মদরসর্বস্ব, শেকড় বিচ্ছিন্ন-দালাল প্রকৃতির হয়ে ওঠে। এই শিক্ষাব্যবস্থা দায়িত্বশীল, দেশপ্রেমিক, জাতীয়তা বোধসম্পন্ন নাগরিক সমাজ গড়ে তোলে না। এই শিক্ষা জাতিকে স্বকীয় বিকাশের ধারায় স্বাধীনতার পথে নয়Ñ পরাধীনতার দিকে ধাবিত করে। নিজেদের জীবন সংগ্রামের স্বকীয় ঐতিহ্যভিত্তিক প্রকৃত শিক্ষার সন্ধান এখানে পাওয়া ভার। ফলে বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে এদেশের মানুষের রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা যাচ্ছে না।
নতুন প্রজন্মকে এ বিষয়ে সম্যক সচেতন করে গড়ে তুলতে হবে এবং স্বাধীন জাতি গঠনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। জাগরণী শান্তিসংঘ সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সকলের প্রতি এই ধারায় কাজে যুক্ত হতে, সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসতে উদাত্ত আহ্বান জানাই।
লেখক: সাবেক এমপি, আহ্বায়ক জাগরণী শান্তিসংঘ
সম্পাদনা: আশিক রহমান