‘সব মৌলিক রচনাই অবিরাম সংশোধনযোগ্য’
স্বকৃত নোমান
সেদিন রাত করে বাসায় ফেরার পর পড়তে কিংবা লিখতে ইচ্ছে করছিল না। ক্লান্ত ছিলাম খানিকটা। আমার কোনো বই প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর সাধারণত পড়ি না। পেছনে ফিরে তাকাতে ইচ্ছে করে না। কী ভেবে আলমিরা থেকে ছয় বছর আগে লেখা ‘রাজনটী’ উপন্যাসটি নামিয়ে পড়তে শুরু করলাম। বছরখানেক আগেও একবার পড়তে চেষ্টা করেছিলাম, হতাশ হয়ে রেখে দিয়েছি। কিন্তু বছরখানেক পর, সেদিন রাতে, প্রথম তিন পাতা পড়ার পর এমন মেজাজ খারাপ হলো, বইটিকে ধরে জোরসে একটা টান মেরে ছিঁড়ে দুই টুকরো করে ফেললাম। ছিঃ! শব্দপ্রয়োগে ও বাক্যগঠনে এত দুর্বল এবং বাহুল্য কথায় ভরপুর এমন একটি উপন্যাস আমি লিখেছি! ভাবতেই কষ্ট হচ্ছিল খুব। লেখালেখির প্রতি কেন যেন হতাশা চলে এলো। কী লাভ এত এত আবর্জনা তৈরি করে? হতাশা কাটাতে ঠিক তখনই, মধ্যরাতে, ফোন দিলাম হাসান আজিজুল হক স্যারের নম্বরে। রিসিভ করলেন না। হয়তো শুয়ে পড়েছেন।
ভিতরে দহন চলতে লাগল আমার। এই উপন্যাস কি বাতিল ঘোষণা করব, নাকি পুনর্লিখন করব? পুনর্লিখন করতে গেলে তো নতুন লেখার ক্ষতি হবে। কী করি? প্রচ্ছদটার দিকে তাকিয়ে মায়া লাগল। খুব দরদ দিয়ে এঁকেছিলেন শিল্পী নিয়াজ চৌধুরী তুলি। প্রচ্ছদে আঁকা সেই নৃত্যরতা নটী যেন আমাকে বলল, ‘তুমি বরং এটি আরও এডিট কর।’ কম্পিউটার অন করে বসে গেলাম। শুরু করলাম এডিট। রাত গভীর থেকে গভীর হয়, আমি থামি না। কিছুই থাকছে না, সব ফেলে দিচ্ছি। শেষ রাতে দেখি পঞ্চাশ হাজার থেকে শব্দসংখ্যা কমতে কমতে তেতাল্লিশ হাজারে দাঁড়িয়েছে! এ তো আরেক বিপদ! এভাবে এডিট করতে গেলে তো কিছুই থাকবে না। হাল ছেড়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন ছিল শুক্রবার। বেলা করে ঘুম থেকে উঠে আবারও ফোন দিলাম হাসান স্যারকে। রিসিভ করলেন। কী করব উপন্যাসটি নিয়ে, পরামর্শ চাইলাম তার। বললাম, এমন বাজে উপন্যাস আর কোনোদিন কোনো পাঠকের হাতে না পৌঁছাক। স্যার বললেন, ‘আমি তা মনে করি না।’ বলে তিনি চুপ করে রইলেন। বললাম, তাহলে আমি কী করব স্যার? এই বইটি তো আমাকে অস্থিরতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। স্যার হয়তো আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারলেন। বললেন, ‘ওভাবেই রেখে দাও। যদি কখনো প্রয়োজন মনে করো, আবার নতুন করে লিখো।’
আমি আবার শুরু করলাম এডিট। হয় এটিকে চিরকালের জন্য বাতিল করব, নয় এডিট করে মোটামুটি একটা পর্যায়ে নিয়ে যাব। বন্ধু অঞ্জনকে ফোন দিলাম। ভিতরের অন্তর্দহনের কথা জানালাম তাকে। হয়তো সে আমার দহনটা ধরতে পারেনি। নিস্তেজ কণ্ঠে বলল, ‘মন চাইলে এডিট কর।’ হ্যাঁ, এডিট আমাকে করতেই হবে। লেখালেখির পথে একটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে উপন্যাসটি। লেখালেখির প্রতি হতাশা তৈরি করছে। তাই আবার শুরু করলাম এডিট। সারাদিন এডিট চলল। সন্ধ্যায় কিছুক্ষণের বিরতি দিয়ে আবার বসলাম। চলল রাত দেড়টা পর্যন্ত। আর বসে থাকতে পারছিলাম না, মাথা ঘুরাচ্ছিল খুব। শুয়ে পড়লাম।
পরদিন ছিল শনিবার। সকালে আবার বসলাম এডিটে। সারাদিন চলল। বিকেলে কিছুক্ষণের বিরতির পর আবার। চলল রাত দুটো পর্যন্ত। ভেবেছিলাম, রাতেই গোটা পা-ুলিপির এডিট শেষ করব। কিন্তু শরীরে কুলোচ্ছিল না আর। শেষের কয়েকটি অধ্যায় বাকি রয়ে গেল। আজ শেষ করলাম। একটু আগে। এখন মনে হচ্ছে কিছুটা দাঁড়িয়েছে। এবার কিছুটা হলেও লজ্জা আর হতাশা ঢাকতে পারব। উপন্যাসটির তৃতীয় মুদ্রণ এখন বাজারে। আশা করি আগামী এক বছরের মধ্যে প্রকাশিত হবে ‘রাজনটী’র দ্বিতীয় সংস্করণ। হোর্হে লুইস বোর্হেস ঠিকই বলেছিলেন, ‘যা কিছু আমি প্রকাশ করি তা সবই খসড়া। সব মৌলিক রচনাই অবিরাম সংশোধনযোগ্য।’
লেখক: কথাসাহিত্যিক
ফেসবুক থেকে