বাংলাদেশের কবিতা ও রাজনৈতিক চেতনায় ৭ মার্চ
মিল্টন বিশ্বাস
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়ী হয়ে দীর্ঘদিনের শোষণ বঞ্চনা থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন জনগণের মুক্তির স্বপ্নে বিভোর ঠিক তখনই পাকিস্তানি শাসকচক্র ষড়যন্ত্র করে ১ মার্চ ঘোষণা দিয়ে ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে। কারণ পাকিস্তানি পিপলস পার্টির নেতা ভুট্টো বলেছিল, তাদের দল বাদ দিয়ে অধিবেশন বসলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত জীবনযাত্রা নীরব নিথর করে দেওয়া হবে। ইয়াহিয়া তার হুমকির কাছে মাথানত করে। আর তার ঘোষণার পরে বাংলাদেশ অগ্নিগর্ভ উত্তাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়।
‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’, ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো সোনার বাংলা মুক্ত করো’, ‘পি-ি না ঢাকা, ঢাকা-ঢাকা’, ‘পাঞ্জাব না বাংলা, বাংলা-বাংলা’, ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মারো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ এসব সেøাগান কণ্ঠে নিয়ে ঢাকাসহ সারাদেশ তখন মিছিলের সমুদ্র। বঙ্গবন্ধু জানান বিনা চ্যালেঞ্জে তিনি কোনোকিছুই ছাড়বেন না। ছয়দফার প্রশ্নে আপস না করারও ঘোষণা আসে। ২ থেকে ৫ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল ঘোষিত হয়। ছাত্রলীগ আর ডাকসুর সমন্বয়ে ‘স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। চলমান অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। গণজাগরণের এই পরিস্থিতিতে ৭ মার্চ ছিল স্মরণীয় দিন। কবির ভাষায়Ñ ‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্তপায়ে হেঁটে অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন। তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল, হৃদয়ে লাগিল দোলা জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা কে রোধে তাহার বজ্রকণ্ঠ বাণী? গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালো তার অমর কবিতাখানি ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সেই থেকে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি আমাদের।’ ৭ মার্চ ভাষণের মধ্যে কলকাতার অধুনালুপ্ত দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার এককালের সম্পাদক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় দেখেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং উপমহাদেশের দুটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ধারার দর্শনের প্রভাব অর্থাৎ গান্ধীজির নিরস্ত্র নৈতিক যুদ্ধের আহ্বান এবং নেতাজী সুভাষচন্দ্রের সশস্ত্র সংগ্রামের রাজনৈতিক দর্শন। এছাড়া স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তী ধাপেরও নির্দেশ রয়েছে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণে। উপরন্তু ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বাক্যটি সারা দুনিয়ার নির্যাতিত মানুষের কাছে মুক্তিমন্ত্রতুল্য। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ ও ‘মুক্তির সংগ্রামে’র ব্যাখ্যা দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম বলতে আমি বুঝিয়েছি, বিদেশি শাসন অবসানের যুদ্ধ। কিন্তু বিদেশি শাসনের অবসান হলেই দেশের মানুষের মুক্তি অর্জিত হয় না। তাই স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তী ধাপ হচ্ছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি অর্জনের লড়াই। যে মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে আমার বাকশাল গঠন এবং দ্বিতীয় বিপ্লবের লক্ষ্যে যাত্রা।’ বাকশাল গঠনের পরে ১৯৭৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সারাদেশ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের মুখের ভাত জোটাতে হবে, মুখে হাসি ফোটাতে হবে। কত বড় দায়িত্ব বুঝতে পারছ?…’ মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য জাতির পিতা রাজনৈতিক জীবনের প্রথম দিন থেকেই মানবকল্যাণমূলক কর্মকা-ে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে, জাতির জনক হিসেবে প্রথাবদ্ধ, ধর্ম-শাসিত সংস্কারাছন্ন জীবন তিনি পছন্দ করেননি। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ার জন্য ধর্মের গ-ি ভেঙে প্রগতির পথে অগ্রসর হওয়ার পক্ষে ছিল তার নীতিআদর্শ। বাঙালি সংস্কৃতির চিরায়ত রূপটিকে ধরতে চেয়েছেন তিনি তার রাষ্ট্র পরিকল্পনায়, সংবিধান প্রণয়নে। আর এ কারণেই আজকের প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধু চিরস্মরণীয় একটি নাম। এজন্য ৭ মার্চ বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ভাষণ স্মরণে রাখলে তার পরবর্তী চিন্তাধারা বুঝতে সুবিধা হবে।
প্রথমে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেও ৭ মার্চের ভাষণেই বঙ্গবন্ধু সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দেন। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান ছিল এ রকমÑ ‘তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছুইÑ আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ একই বক্তৃতায় তিনি হানাদার পাকিস্তানিদের প্রতি শান্তি প্রস্তাব দিয়েছেন; বলেছেন, ‘তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না।’ এই প্রস্তাবে সাড়া না দিলে ‘আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব’ অর্থাৎ নিরস্ত্র প্রতিরোধের ডাকও দিয়েছেন তিনি। ৭ মার্চের ভাষণ বিশেষণ করে সকলেই স্বীকার করেছেন এটি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত কিন্তু সুচিন্তিত এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এর প্রভাব ছিল প্রত্যক্ষ। মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক ছিল বঙ্গবন্ধুর সাময়িক কৌশল; বিশ্বাস নয়। তার বিশ্বাস ছিল সুভাষচন্দ্রের সশস্ত্র যুদ্ধের রাজনৈতিক বিশ্বাস। লক্ষ্যণীয় তার ভাষণজুড়ে রয়েছে সামরিক প্রসঙ্গ। পাকিস্তানিদের তিনি নির্দেশ দিয়েছেনÑ ক) সামরিক আইন বা মার্শাল ল প্রত্যাহার করতে হবে। খ) সামরিক বাহিনীর সমস্ত লোকদের ব্যারাকের ভিতর ঢুকতে হবে। গ) যে ভাইদের সেনাবাহিনী হত্যা করেছে তার তদন্ত করতে হবে। তার এই নির্দেশ ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালিদের জন্য ‘গ্রিন সিগন্যাল’। এজন্যই ২৫ মার্চের হানাদার বাহিনীর আক্রমণের পরে দ্রুত বাঙালি সেনা অফিসাররা প্রতিরোধ যুদ্ধে নেমে পড়েন। ৭ মার্চের পরেই ছাত্রজনতা এবং আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কর্মীরা সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের ডামি রাইফেল নিয়ে সামরিক ট্রেনিং শুরুর সেই চিত্র সকলেই মনে থাকার কথা। পূর্ববাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ১৫ মার্চ কর্মীদের মধ্যে এক বিশেষ গোপন সার্কুলার প্রচার করেছিল। সেটির একটি অংশ- ‘জাতি আজ বুঝিতে পারিয়াছে যে, একমাত্র সশস্ত্র সংগ্রামেই সে স্বাধীনতা অর্জন করিতে পারে এবং সেইজন্য নিজস্ব উদ্যোগে সশস্ত্র হইবার চেষ্টা করিতেছে।… আমরা আজ এক যুদ্ধকালীন অবস্থার মধ্যে রহিয়াছি। এ যুদ্ধ জাতীয় যুদ্ধ। এই যুদ্ধে আমরা অংশগ্রহণ করিতেছি এবং জয়যুক্ত হইতে চাই।…’ ১৮ মার্চ বিমানবাহিনীর সাবেক জওয়ানরা ঢাকায় শহীদ মিনারে এক সমাবেশ করে বাংলার মুক্তিসংগ্রামকে ভিয়েতনামের মুক্তিসংগ্রামের মতো রূপ দেওয়ার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেন। স্বাধীন বাংলা বিমানবাহিনী গঠনের লক্ষ্যে তাদের সমাবেশ ছিল ৭ মার্চের প্রত্যক্ষ ফল। ১৯ মার্চ সামরিক কর্তৃপক্ষ জয়দেবপুরে অবস্থানরত এক ব্যাটালিয়ন বাঙালি সৈন্যকে অস্ত্রসমর্পণের নির্দেশ দেয়, কিন্তু বাঙালি সৈন্যরা এ নির্দেশ মানতে অস্বীকার করেন। অন্যদিকে একইদিনে বঙ্গবন্ধু ও কর্নেল ওসমানী ঢাকায় এক গোপন বৈঠকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বিভিন্ন খুঁটিনাটি দিক পর্যালোচনা করেছিলেন। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অনেক অফিসারও এ সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গোপনে দেখা করে নির্দেশাবলি গ্রহণ করেন। ২০ মার্চ ছাত্র ইউনিয়নের ট্রেনিংপ্রাপ্ত শতশত গণবাহিনীর ঢাকার রাজপথে ডামি রাইফেল কাঁধে নিয়ে মার্চপাস্ট ছিল মানুষের কাছে নতুন উদ্যমের দৃষ্টান্ত। পাকিস্তানি দিবস হিসেবে পালন করে আসা ২৩ মার্চকে বঙ্গবন্ধু ‘লাহোর প্রস্তাব দিবস’ ঘোষণা করেন এবং দিনটি ছুটি ঘোষিত হয়। সেদিন পল্টন ময়দানে সকাল ৯টায় ‘জয় বাংলা বাহিনী’র কুচকাওয়াজ ও মহড়া অনুষ্ঠিত হয় এবং কুচকাওয়াজ শেষে সারা শহর ঘুরে মার্চ করে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে তার অভিবাদনের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়। আর এসব আয়োজনই সম্ভব হয়েছিল ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর প্রদীপ্ত ভাষণের পরে। সেজন্য কামান, মর্টার ও রাইফেল নিয়ে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী ২৫ মার্চ বাঙালিদের ওপর অতর্কিত ঝাঁপিয়ে পড়লে প্রাথমিক প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়েছে তাদের। ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে ফার্মগেটে এসে পাকিরা যেমন বাঁধা পেয়েছে তেমনি পিলখানায় ইপিআর আর রাজারবাগে পুলিশের প্রতিরোধের মধ্যে পড়েছে। গ্রেফতার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু এই সংবাদ পেয়ে ওয়ারলেস, টেলিগ্রাফ ও টেলিফোনে ‘সমস্ত শক্তি জড়ো করে প্রতিরোধ আর স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি নিতে’ নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চের রাতে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ‘এই-ই হয়তো তোমাদের জন্য আমার শেষ বাণী। আজকে থেকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। (চলবে-৭)
লেখক: অধ্যাপক এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান