দুধ-চিনি মিশ্রিত চা-কে ‘না’ বলুন
ইকতেদার আহমেদ
লেখক: সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
চা প্রাচীনকাল হতে দক্ষিণ-পূর্ব চীনে ভেষজ পানীয় হিসেবে সাধারণ মানুষের নিকট প্রিয় ছিল। সে সময় তারা প্রত্যুষে কাজের উদ্দেশ্যে ঘর হতে বের হওয়ার সময় কাচের বোতলে বা মাটির পাত্রে পানীয় হিসেবে সঙ্গে চা রাখত এবং তারা একটু পরপর কাজের ফাঁকে ফাঁকে দিনব্যাপী তা পান করত। সে সময় তাদের মধ্যে চা নিয়ে এ বিশ্বাসটি কাজ করত যে, চা পান করলে ক্লান্তি দূর হয়ে শরীরে সতেজতা আসে। দক্ষিণ-পূর্ব চীনের জনমানুষ সে সময় যে চা পান করত তা ফুটন্ত পানিতে শুকনো চা পাতা হতে নির্গত নির্যাস। দক্ষিণ-পূর্ব চীন হতে ক্রমান্বয়ে চা চীনের অপরাপর অংশসহ কোরিয়া, জাপান, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড প্রভৃতি অঞ্চলের মানুষের নিকট ভেষজ পানীয় হিসেবে মানবদেহের জন্য উপকারি বিবেচনায় পরিচিতি লাভ করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এসব অঞ্চলের সাধারণ মানুষ যে পদ্ধতিতে তাদের পূর্ব-পুরুষরা চা পান করত তা এখনো তাদের মধ্যে অক্ষুণœ রেখেছে। এসব অঞ্চলের কর্মজীবী খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ তাদের পূর্ব-পুরুষদের ন্যায় সকালে ঘর হতে বের হওয়ার সময় প্লাস্টিকের বোতলে করে পানীয় হিসেবে চা সঙ্গে নিতে কখনো ভুল করে না। তারা যে চা পান করে তা ফুটন্ত পানির মধ্যে চা পাতার নির্যাস ছাড়া অন্য কিছু নয়। ভেষজ পানীয় হিসেবে চা পান করার কারণে ধারণা করা হয় চীন, জাপান, কোরিয়া প্রভৃতি দেশের কর্মজীবী খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের মধ্যে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের সমশ্রেণির মানুষের তুলনায় রোগ বালাইয়ের প্রকপ অনেক কম।
পর্তুগিজ যাজক ও বণিকদের মাধ্যমে ষোড়শ শতকে ইউরোপের বাজারে চায়ের প্রবেশ ঘটে। এরপর সপ্তদশ শতকে ব্রিটিশদের মধ্যে ব্যাপকভাবে চা খাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। ব্রিটিশরাই সর্বপ্রথম বৃহদাকারে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে তাদের তৎকালীন উপনিবেশ ভারতে চায়ের চাষ শুরু করে। আরবের বণিকদের মাধ্যমে চা আরব দেশসমূহে প্রবেশ করে। পর্তুগিজ ও আরব বণিকরা স্ব স্ব দেশে চা নিয়ে যাওয়ার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে এটিকে জনপ্রিয় করার জন্য এর মধ্যে চিনি, লেবু, মসলা প্রভৃতির সমারোহ ঘটায়। ব্রিটিশরা তাদের চেয়েও আরও একধাপ এগিয়ে চায়ের সঙ্গে চিনি ও দুধ মিশিয়ে এটিকে অধিকতর সুস্বাদু পানীয় হিসেবে প্রচলনের প্রয়াস নেয়। ব্রিটিশদের এ প্রয়াসের অংশ হিসেবে দেখা যায় আমাদের উপমহাদেশে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে চা উৎপাদন পরবর্তী ব্রিটিশরা ভেষজ পানীয় হিসেবে সাধারণ জনমানুষের মধ্যে চা-কে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে কোনো সফলতা পায়নি। অতঃপর তারা চায়ের প্রতি মানুষের আসক্তি সৃষ্টির জন্য বিনা পয়সায় দুধ ও চিনি মিশ্রিত চা বিভিন্ন হাট-বাজারে সাধারণ মানুষের পানের ব্যবস্থা করে। এতেও যখন তারা চায়ের প্রতি সাধারণ মানুষের আসক্তি সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয় তখন তারা এক কাপ চায়ের সঙ্গে বিনামূল্যে একটি করে বিস্কুট দেওয়ার প্রচলন ঘটায়। তাদের এ উদ্যোগ স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সফলতা পায়। এ সফলতাকে পুঁজি করে ব্রিটিশরা এশিয়া ও আফ্রিকায় তাদের বিভিন্ন উপনিবেশে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে চা চাষ করে ব্যাপকভাবে লাভবান হয়। কিন্তু তারা এশিয়া ও আফ্রিকার সাধারণ জনমানুষের মধ্যে যে পদ্ধতিতে অর্থাৎ দুধ ও চিনি মিশ্রিত চা পানের অভ্যাস গড়ে তুলেছে তাতে ভেষজ চা পানের মাধ্যমে মানুষ যে উপকার লাভ করত তার পরিবর্তে অপকারের প্রবণতা দেখা দেয়। আমাদের দেশে এমন অনেক মানুষ আছে যারা কোনো ধরনের কায়িক পরিশ্রম করে না অথচ দিনে বেশ কয়েক কাপ দুধ ও চিনি মিশ্রিত চা পান করে। এসব মানুষের মধ্যে শরীরের ওজন ও মেদ বৃদ্ধির প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যা তাদের জন্য বিভিন্ন রোগের উপসর্গ হিসেবে দেখা দেয়। এমনকি যারা কায়িক পরিশ্রম করে এমন মানুষের জন্যও দিনে একাধিক কাপ দুধ ও চিনি মিশ্রিত চা পান করা নিরাপদ নয়। কিন্তু যথাযথ সচেতনতার অভাবে আমাদের দেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষকে কিছুতেই প্রতিদিন দুধ ও চিনি মিশ্রিত একাধিক কাপ চা পান করা হতে নিবৃত রাখা যাচ্ছে না।
আমাদের দেশে গৃহে বা অফিসে অতিথি আসলে তাদের অন্যূন চা দ্বারা আপ্যায়ন একটি সাধারণ রেওয়াজ। বন্ধু-বান্ধবের ক্ষেত্রেও দেখা যায় চলাফেরায় একে অপরকে বিভিন্ন স্থানে আপ্যায়নের সময় অপর কিছু থাকুক বা না থাকুক চা যেন না থাকলেই নয়। আজ হতে তিন যুগেরও অধিক সময় আগে চা দ্বারা আপ্যায়নের ক্ষেত্রে সর্বত্র দুধ ও চিনি মিশ্রিত চায়ের প্রাধান্য ছিল। দুধ ও চিনি মিশ্রিত চায়ের ক্ষতিকারক প্রভাব বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি পরবর্তী দেখা যায় ধীরে ধীরে মানুষ প্রথমে দুধ মিশ্রিত চা পানের পরিবর্তে চিনি মিশ্রিত চা পান শুরু করে এবং এরপর চিনি মিশ্রিত চা পান ত্যাগ করে শুধুমাত্র লিকার চা পান করার অভ্যাস গড়ে তোলে। বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি বা আধাসরকারি খুব কমই অফিস পাওয়া যাবে যেখানে অতিথিদের দুধ চা দ্বারা আপ্যায়নের প্রচলন রয়েছে। এমনকি বিভিন্ন সভা ও মতবিনিময়ের ক্ষেত্রেও দেখা যায় বানানো চা পরিবেশনের ক্ষেত্রে সচরাচর তা লাল চা বা লিকার চা হয়ে থাকে। এখানে চায়ের সঙ্গে একজন ব্যক্তি চিনি মিশিয়ে চা পান করবেন কি করবেন না তা তার একান্ত ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। একজন মানুষের একান্ত ইচ্ছা যাতে কোনোভাবে প্রভাবিত না হয় এ কারণে বিভিন্ন বড় অনুষ্ঠানে চা পরিবেশন ব্যবস্থায় গরম পানি, টি ব্যাগ, চিনি ও দুধ আলাদাভাবে দেওয়া থাকে। এ ধরনের পরিবেশনায় দেখা যায় অধিকাংশ মানুষ দুধ ও চিনি মিশ্রণ ব্যতীত লিকার চা পানে স্ব-সচেতনতা হতে অধিক আগ্রহ দেখায়।
দেশে বর্তমানে অধিকাংশ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে প্রতিদিন সকাল ও বিকালে দুকাপ চা পান যেন জীবনের একটি অংশে পরিণত হয়েছে। এ দুকাপ চা পানের ক্ষেত্রেও অনেকের মধ্যে লিকার চা বা লাল চা পানের প্রতি আগ্রহ স্বাস্থ্য সচেতনতা দিক হতে উৎসাহব্যঞ্জক হলেও চিনিবিহীন লিকার চা যে অধিক ফলপ্রদ সে বিষয়টি নিয়ে সকলের ভাববার প্রয়োজন রয়েছে।
দেশের সাধারণ জনমানুষের মধ্যে চা পানের প্রতি যে প্রবণতা তা বোধকরি এত অধিক হতো না যদি না বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে উপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসক কর্তৃক এ উপমহাদেশে চা আবাদের প্রচলন না ঘটত। উপনিবেশিক ব্রিটিশ আমলে আমাদের এ অঞ্চল অর্থাৎ আগেকার পূর্ব-পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশে যে সংখ্যক চা বাগান ছিল তাদের বিদায় পরবর্তী বাগানের সংখ্যা না বাড়লেও উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে যদিও সে উৎপাদন বৃদ্ধি জনসংখ্যার বৃদ্ধির সঙ্গে তালমিলিয়ে উঠতে পারছে না।
বাংলাদেশ অভ্যুদ্বয় পূর্ববর্তী পূর্ব-পাকিস্তান হতে ব্যাপকহারে চা রপ্তানি হতো। বাংলাদেশ অভ্যুদ্বয় পরও সে প্রবণতা অব্যাহত আছে যদিও অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির কারণে ক্রমান্বয়ে চা রপ্তানি সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। আধুনিক চাষ পদ্ধতি প্রবর্তন পরবর্তী অন্যান্য ফসলের উৎপাদন যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে চায়ের ক্ষেত্রে তা এখনো প্রত্যক্ষ করা যায়নি; তবে বিজ্ঞানীদের আশাবাদ অচিরেই তারা অধিক উৎপাদনশীল চা গাছ উদ্ভাবনে সফলতা পাবেন যা চা উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাবে।
বর্তমানে সারাবিশ্বে চা এমন একটি পানীয় যার সঙ্গে বয়স নির্বিভেদে সকলের পরিচয়ের পাশাপাশি পানের অভিজ্ঞতা রয়েছে। দুধ ও চিনি মিশ্রিত চা-কে ভেষজ পানীয় হিসেবে আখ্যা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ভেষজ চা যেখানে বিভিন্ন রোগের উপসমের কারণ ঠিক এর বিপরীত দুধ ও চিনি মিশ্রিত চা পান দুঃশ্চিন্তা, অনিদ্রা, স্নায়ুবিক দুর্বলতা, উচ্চ রক্তচাপ, ওজন ও মেদ বৃদ্ধির পাশাপাশি মূত্র বৃদ্ধিকারক। দুধ ও চিনি মিশ্রিত চা ক্ষতিকরভাবে স্নায়ু উদ্দীপক অপরদিকে ভেষজ চা ক্ষতিহীনভাবে স্নায়ু উদ্দীপক। চায়ের মধ্যে যে উপাদানের কারণে উদ্দীপনার সৃষ্টি হয় সেটিকে বলা ক্যাফেইন। ক্যাফেইনের সঙ্গে দুধ ও চিনির মিশ্রণ সবসময়ই ক্ষতির কারণ অপরদিকে ভেষজ চা হিসেবে তাতে ক্যাফেইনের উপস্থিতি ক্ষতিকর প্রভাব হতে মুক্ত। সার্বিক বিবেচনায় দুধ ও চিনি মিশ্রিত চা ভেষজ চা বা লিকার চায়ের তুলনায় ক্ষতিকর বিধায় কালেভদ্রে দুয়েক কাপ পান করা যেতে পারে। কিন্তু এ দুয়েক কাপ যেন কোনোভাবেই আসক্তি হিসেবে দেখা দিয়ে অভ্যাস গড়ে না তোলে সে বিষয়ে সকলের সজাগ হওয়া জরুরি। আর এর গুরুত্ব অনুধাবন করেই আমাদের সকলকে দুধ-চিনি মিশ্রিত চা-কে ‘না’ বলতে হবে।
সম্পাদনা: আশিক রহমান