হোলির রঙ, রিপুর দহন ও রোবট সাংবাদিকতা
কাকন রেজা
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
‘ভবিষ্যতে সাংবাদিকতা করবে রোবট?’ এমন শিরোনামে অনলাইনের একটি খবর চোখ কাড়ল। মন্দ কী, সাংবাদিকতা যদি রোবট করে। এমনিতেই সাংবাদিকতায় যারা থাকেন তাদের হতে হয় ‘নির্মোহ’। গণমাধ্যমে কাজ করতে হয় ব্যক্তিগত আবেগের জায়গা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে। যন্ত্রের কোনো আবেগ থাকে না, ফলে নিয়ন্ত্রণেরও ঝামেলা নেই। কিন্তু মানুষের থাকে, কারও কারও মধ্যে বেশি মাত্রায়ই থাকে। অনিয়ন্ত্রিত আবেগের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঘর, সংসার, সমাজ ও রাষ্ট্র। আর এই অনিয়ন্ত্রিতদের গ্রুপে যদি সাংবাদিকরা থাকেন তাহলে অবস্থা তো পুরোই ‘কেলো’। সমাজ ও রাষ্ট্রের বেজে বারোটা।
‘নির্মোহ’ শব্দটি যে কটি পেশার জন্য অন্তত প্রয়োজনীয় তার মধ্যে অন্যতম হলো সাংবাদিকতা। আবেগ যখন গতিময় তখন স্বভাবতই বিবেক গতি হারায়। আবেগ ও বিবেক একসঙ্গে কোনোদিনই চলেনি। আবেগ হলো ভুল করার আর বিবেক শুধরে নেবার। যন্ত্রের যেহেতু আবেগ নেই সুতরাং ভুল হবার সম্ভাবনাও নেই। তাই ‘রোবট’ সাংবাদিকতা করলে সেটা অন্তত নির্মোহ হতো। অন্তত সাংবাদিকতার সঙ্গে ‘কুত্তা’ পোষার তুলনা হতো না।
কথাগুলো বলা এক ধরনের দুঃখবোধ থেকে, কষ্টের তাড়ন থেকে। একজন ভালো মানুষ কতটা খারাপ হলে মন্দলোকেরা তাকে নিয়ে সমালোচনা করে, তামাশা করে তা বলাবাহুল্য। সাংবাদিকতা কতটুকু পথভ্রষ্ট হলে, ‘কুত্তা’ পোষার সঙ্গে সাংবাদিক পোষার তুলনা আসতে পারে তা ভেবে দেখা উচিত। সাংবাদিকতা কতটুকু নষ্ট হলে একজন পচে যাওয়া রাজনীতিক সাংবাদিকদের সমালোচনা করতে পারে তাও বোধে আনা উচিত।
‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ যখন প্রথম লেখা হয় তখন একশ্রেণির সাংবাদিক, লেখক ও সৃষ্টিশীল দাবিদার মানুষ যত্রতত্র তা ব্যবহার করতেন। আজ সেসব সাংবাদিক ও সৃষ্টিশীলরা মিলে রীতিমতো ‘সুশীল’! এখন তাদের মুখে কোনো ‘রা’ নেই! অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ‘সবকিছু আজ তাদের অধিকারে’, না হলে প্রতিবাদ নেই কেন! ‘মেরেছ কলসীর কানা তাই বলে কী প্রেম দেব না’ জাতীয় মনোভাব আমাদের কোথায় নিয়ে গেছে, কতটা নিচে নামিয়েছে, ভাবতেই মাথানত হয়ে আসে। মাঝেমধ্যে মনে হয় ‘উচ্ছিষ্ট ভোগের আয়োজনে, আমরা সবাই শারমেয়’।
সামাজিক মাধ্যমে একজনের লেখা পড়লাম। সম্ভবত বেচারা গণমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত। দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মুসলমানরে ছাত্রদের হোলি উৎসবে যোগ দিতে নিষেধ করেছেন, এমন একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন তিনি। সঙ্গে সেই চাকুরেকে ‘সাম্প্রদায়িক’ আখ্যায়িত করে আগাপাশতলা ধুয়ে দিয়েছেন। বেচারা বিস্ময়করভাবে নিজ প্রকাশিত, প্রচারিত বিক্ষুব্ধতা দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, সে কতটা ‘অসাম্প্রদায়িক’ কতটা ‘ধর্মনিরপেক্ষ’। অবশ্য ইংরেজিতে ‘সেক্যুলার’ শব্দটির বাংলা কি ‘ধর্মনিরপেক্ষ’? কিংবা ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র সামগ্রিক ব্যাখ্যাটা কী? এসব বিষয়ে ওয়াকিবহাল না হলে পুরো বিষয়টিই গুবলেট হয়ে যেতে পারে। যেমন গুবলেট হয়ে যেতে পারে ধর্ম আর উৎসবের পার্থক্য না বুঝলে ‘ধর্ম’ ও ‘উৎসব’ দুটোই।
এবার গণ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সনাতনীদের ধর্মাচার ‘হোলি’ নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। অনেকে বলতে চাচ্ছেন ‘হোলি’ ঠিক ধর্মীয় নয় সামাজিক উৎসব। রঙ মাখিয়ে সে ছবি প্রকাশ করে ‘হোলি’কে সার্বজনীনতার রূপ দেওয়ার প্রকট প্রচেষ্টাও চোখে পড়েছে। কেউ এর বিপক্ষে বললেই তাকে ‘সাম্প্রদায়িক’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে, হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ‘ঈদ’কে তুলনায় টেনে আনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ঈদের আনন্দে তো সবাই অংশগ্রহণ করে তাহলে ‘হোলি’তে আপত্তি কেন, এমন কথাও।
যারা বলছেন, তাদের যদি প্রশ্ন করি ঈদে ‘ধর্ম’ কতটুকু আর ‘উৎসব’ কতটুকু? তারা কী জানেন, ইসলাম ঈদের নামাজের জন্য অযুও ফরয করেনি। ঈদের নামাজ মূলত সবার সম্মিলন। সাম্যের প্র্যাকটিস, ধনী-গরিব এক কাতারে দাঁড়ানো। কিন্তু এই অংশে মুসলিম ছাড়া, অন্যেরা অংশগ্রহণ করেন না, করা এবং করার জন্য জোর করাও উচিত নয়। সকালের অল্প সময়ের নামাজ শেষে পুরো দিনটাই উৎসবের। দিনব্যাপী এ উৎসবে ধর্মীয় কোনো আচার-অনুষ্ঠান নেই। সুতরাং এমন উৎসবে অন্য ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু নেই, কারও ধর্ম আক্রান্ত হবারও কারণ নেই।
কিন্তু হোলি? যারা বলছেন সার্বজনীনতার কথা তারা কী ‘হোলি’র উৎপত্তি এবং উৎসবের তাৎপর্য বুঝে বলছেন? বুঝে দেখেছেন, হোলিতে কতটা ধর্ম আর কতটা উৎসব? ধর্ম আর উৎসবের পার্থক্য কি সত্যিই তারা বোঝেন? ধর্ম নিরপেক্ষতার মানে কি অন্যের ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া! ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র মানেই হলো ‘যার যার ধর্ম তার তার’। ইসলামও তাই বলে, ‘যার ধর্ম তার কাছে, ধর্মে কোনো জোর জবরদস্তি নেই’। ধর্মনিরপেক্ষতা হলো অন্যের ধর্মকে নির্বিঘœ পালনে সহায়তা করা, সেই ধর্মকে পালন করা নয়।
‘এক্সট্রিম’ জিনিসটি সবক্ষেত্রেই খারাপ। সে হোক ধর্মের ক্ষেত্রে, হোক ধর্ম নিরপেক্ষতার ক্ষেত্রে, হোক আনন্দ ও উৎসবের ক্ষেত্রে। ধর্ম নিরপেক্ষ প্রমাণ করতে মুখে রঙ মাখতে হবে কেন! রঙ মাখা শরীরে কী সব পরিচয় মুছে যায়? যায় না। যার রঙ মাখতে ইচ্ছে করছে মাখুন, কিন্তু অন্যকে মাখাতে প্ররোচিত করা কেন! না মাখলে তাকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেওয়া কেন! কেন এমন ‘ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলে’র অন্যায় চেষ্টা! অন্যের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করাটাও তো ‘এক্সট্রিম’। আপনি যখন জোর করে কিছু করাতে চাইবেন, তখন অন্যেরাও জোর প্রয়োগ করতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। নিউটনের তিন নম্বর সূত্র তো তাই বলে, না কি?
ভারতে দেখলাম এ ধরনের ‘এক্সট্রিম’ওয়ালাদের। গরুর মাংস নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে গরুর মাংস খেয়ে তাদের প্রতিবাদ। কেন বাবা তোদের গরুর মাংস খেতে হবে! তোরা না খেয়ে মুসলমানদের গরুর মাংস খাওয়া, তোরা পাহারা দে। বাজারে গরুর মাংস বিক্রি করার ব্যবস্থা কর, তোরা পাহারা দে। মুসলমানদের সাহস দে, ‘আমরা আছি, তোমরা তোমাদের মতো চলো, নির্বিঘেœ ধর্ম পালন কর, নিশ্চিন্তে গরুর মাংস খাও’। তা না করে জোশ করে মাংস খেয়ে প্রতিবাদ! এই প্রতিবাদ যত না ‘অসাম্প্রদায়িক’ তার থেকে বেশি ‘রাজনৈতিক’, এ জিনিস কবে যে দুদেশের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ও ‘ধর্মের ধ্বজাধারীদের’দের মাথায় ঢুকবে! বলবেন কীসের মধ্যে কী আনলেন, কোথায় ‘রোবট’, কোথায় ‘সাংবাদিকতা’ এর মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন ‘হোলি’ আর ‘ধর্ম’! বিস্মিত হবার কিছু নেই। এসবই সাংবাদিকতার উপকরণ। আবেগ বাদ দিয়ে সত্যিকার নির্মোহ বিশ্লেষণ ও উপস্থাপনের চেষ্টা। এটাই সত্যিকার সাংবাদিকতা। আর এটা পারছি না বলেই সৃজনশীল অন্য পেশার ক্ষেত্রে ‘রোবট’কে না বলা হলেও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ‘রোবট’কে নিরুৎসাহিত করা হয়নি।
ফুটনোট: মুখ ফসকে কেউ বলে উঠতে পারেন, বর্তমানে সাংবাদিকদের অনেকের আচরণগত অবস্থান তো ‘রোবটে’র মতোনই। প্রোগ্রামাররা যা প্রোগ্রাম দিয়ে দিচ্ছেন সে অনুযায়ীই কাজ করছেন তারা। কথাটা আংশিক সত্যি। আবেগের একটি অংশ হলোÑ ‘পাওয়ার ইচ্ছা’ সংক্ষেপে ‘লোভ’। ‘ষড়রিপু’র সব ‘রিপু’ দমন করা কি সবার পক্ষেই সম্ভব?
পুনশ্চ: লেখাটি যখন শেষ করছি তখন সেলফোনে আমার এক ভাইপোর নোটিস, ‘হোলি নিয়ে কিছু বলবেন না’। কী বলি, যা বলার তো ফেসবুকের কমেন্টই বলছে, টেলিভিশন দেখাচ্ছে। হোলির নামে, আমাদের সংস্কৃতির বিপরীত একটি সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় কী পরিমাণ অসভ্যতা হয়েছে তা তো চর্মচক্ষে দৃশ্যমান। ‘রিপু’র এমন নির্লজ্জ দহন দর্শনেও কিছু মানুষের সচকিত ‘সার্বজনীন’ উচ্চারণ সত্যিই বিস্ময়কর! সত্যিই সেল্যুকাস! সাংবাদিকতার আদর্শ পুরুষ, ইতিহাসবিদ, লেখক, রাজনীতিক মরহুম আবুল মনসুর আহমেদ তার ‘বাংলাদেশের কালচার’ বইটিতে পরিষ্কারভাবে জানিয়েছেন, ‘মানুষের সংস্কৃতির আশি ভাগ আসে ধর্ম থেকে’। সে অনুযায়ী আমাদের দেশের শতকরা নব্বই ভাগ মানুষই ‘হোলি’র বিপরীত সংস্কৃতির। সুতরাং যারা এদেশে ‘হোলি’কে সার্বজনীন করতে চাইছেন, তাদের উদ্দেশ্যটাও গবেষণার বিষয় বৈকি। তারা কী কোনো না কোনোভাবে দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষকে উস্কে দিতে চাইছেন!
সম্পাদনা: আশিক রহমান