দারুল উলুম ওয়াকফ দেওবন্দ : দুই সেতুর একই বন্ধন
মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
বাদ আসর, সূর্যটাকে মাথায় করে ফেরারী হলাম। ঈদগাহমাঠ পেরিয়ে মিনিট পাঁচের ভেতর হাজির হলাম ‘ওয়াকফ’ খ্যাত জায়গাটিতে। মূল গেটের ওপরে লেখা ‘বাবে আনোয়ার শাহ কাশ্মিরি’। ঢুকতেই হাতের বাঁয়ে নজর আটকালো একটা নব নির্মিত ইমারতে। নাম ‘দারুল কোরআন’। উচ্চতর আইনবিভাগের পাশঘেঁষে খানিকটা এগোতেই হাতের ডানে একটি দ্বিতল ছাত্রাবাস। বৃত্তাকারের ভবনটির একেক অংশের একেক নাম। দক্ষিণপাশটি ‘বাবে মাহমুদ’ বলে খ্যাত, উত্তরটি ‘জাওয়ায়ে রশিদ’ লেখায় ঝলমল করছে, পশ্চিমটা ঠিক ‘রোয়াকে ইমাম কাসেম’ নামে চোখের পর্দায় ভেসে ওঠছে; আর নাক বরাবর অংশের নাম এখনও টাঙানো হয়নি, নির্মাণাধীন বলে। আমার ঠিক পেছনে রয়েছে জ্বলজ্বল করা আরেকটি ইমারত। ‘দারুল হাদিস ভবন’ বলে লোকমুখে যার প্রসিদ্ধি। লাল-খয়েরি পাথর খচিত ইমারতটি দেখতে অভিনব। প্রতিষ্ঠানটির সৌন্দর্যের অনেকটাই একে ঘিরে। ভবনটির চারপাশে রয়েছে সারি সারি ফুলগাছের বহর। রক্ত লাল, নীলচে হলুদের মিশেলে বাহারি লতাপাতায় ঘেরা আশপাশ। দেখতেই চোখদুটো জুড়িয়ে গেলো। হাঁটতে হাঁটতে পা এসে পড়লো উত্তরপথে। মাথার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটি আধুনিক ভবনের কাজ চলছে। নাম ‘হুজ্জাতুল ইসলাম একাডেমি’। বিশ্বখ্যাত গবেষণাগারটির পুরোনো কার্যালয় রয়েছে পাশের লাইব্রেরি লাগোয়া। লাইব্রেরি ভবনটাও দেখতে বেশ। প্রাচীন, আধুনিক ইসলামি বইপত্রে ঠাসা পাঠাগারটির নাম ‘মাকতাবায়ে কাসেমিয়্যাৎ’। ভেতরে রয়েছে সমৃদ্ধ কিতাবের বহর। হাকিমুল ইসলাম হজরত মাওলানা কারি তৈয়্যব কাসেমি (রহ.)-এর হাতে লেখা ‘খুতুবাতে হাকিমুল ইসলাম’-এর মূল কপিটা গ্লাসের ফাঁক গলে নজরে পড়লো। পাঠাগারটির ভেতরাংশে বইপাঠের অভিনব সিস্টেম রয়েছে। সাধারণ লাইব্রেরি থেকে আলাদা ও অনেকটা পরিপাটি। কুড়ি-পঁচিশেক বইপোকাকে এই পড়ন্তবেলায়ও মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়তে দেখা গেলো। ওদের পাশঘেঁষে কদম বাড়ালাম দক্ষিণ দিকটায়। হাত দুই রাস্তা পেরোতেই কম্পিউটার বিভাগ, ইন্টারনেট বিভাগসহ সাধারণ সব বিভাগের কক্ষ, দরোজা। চোখের দেখা দেখে এগোতেই দুজন শিক্ষার্থীর মুখোমুখি হলাম। পাশের ফুলবহরের মধ্যকার বেঞ্চিতে বসে আলাপে আলাপে গড়ালাম বহু সময়। আলোচনায় উঠে এলো প্রতিষ্ঠানটির সূচনা কথা।
১৮৬৬ খিস্টাব্দের ৩১ মে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বখ্যাত মাদরাসা দারুল উলুম দেওবন্দ। যার প্রতিষ্ঠার মূল নায়ক ছিলেন হুজ্জাতুল ইসলাম হজরত মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতাবি (রহ.)। তাঁর পরবর্তীতে তাঁরই সুযোগ্য দৌহিত্র হাকিমুল ইসলাম হজরত মাওলানা কারি মুহাম্মদ তৈয়্যব কাসেমি (রহ.) ১৩৪৮ হিজরি থেকে ১৪০৩ হিজরি অবধি প্রতিষ্ঠানটির মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু গোলযোগ দেখা দেয় দারুল উলুম দেওবন্দের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এশিয়া উপমহাদেশের ঐতিহাসিক মহাসম্মেলনের পর। দারুল উলুম দেওবন্দকে কখনও তিনি রাজনীতির ব্যানারে নেয়াটাকে পছন্দ করতেন না। তাঁর পরিচালিত মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ডটিও কোনো রাজনৈতিক সংগঠন ছিলো না, বরং ভারতীয় মুসলমানদের অধিকার আদায়ের একটা অন্যতম প্লাটফর্ম হিসেবে কাজ করতো। এসবের সঙ্গে রাজনৈতিক কিছু ইস্যু যোগ হয়। তাঁর বিরুদ্ধে মজলিসে শূরায় কথা ওঠে। সে সময় আরও বহু অপ্রীতিকর ঘটনার সূত্রপাত ঘটে। ফলে প্রতিষ্ঠানটির দেড় শতাধিক দায়িত্বশীল তাঁর সঙ্গে স্বেচ্ছায় ইস্তফা দেন। পড়াশুনো বন্ধ থাকে প্রায় মাস ছয়েক। শেষমেষ ১৯৮২ খিস্টাব্দ মোতাবিক ১৪০২ হিজরিতে তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁর সুযোগ্য সন্তান হজরত মাওলানা সালেম কাসেমি প্রতিষ্ঠা করেন দারুল উলুম ওয়াকফ দেওবন্দ। এরপর দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যকার মতনৈক্য বিভিন্ন আকার ধারণ করে। খোদ মুসলমানদের অনেকের ভাবনায়ই বিষয়টি খানিকটা ভুল পথে মোড় নেয়। কিন্তু হজরত কারি সাহেব (রহ.) স্পষ্ট করে দিলেন, ‘ইখতিলাফ বাত সে হোতা হ্যায় আওর খেলাফ জাত সে হোতা হ্যায়।’ তাই ভুল বোঝাবুঝির কিচ্ছু নেই। উলামায়ে দেওবন্দ সবসময়ই ঐক্যবদ্ধভাবে থাকবে, ইনশাআল্লাহ। আর সেই বাস্তব রূপ জাতির সামনে এলো ২০০৪ সালে। দু’পক্ষের দুজন তথা মূল দেওবন্দ হতে হজরত সাইয়্যিদ আসআদ মাদানি (রহ.) ও ওয়াকফ হতে হজরত মাওলানা সালেম কাসেমি এগিয়ে এলেন। গড়ে ওঠলো আবার এক অনন্য মেলবন্ধন। আজ অবধি তা পূর্ণ বহাল রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান পরিচালক হাকিমুল ইসলাম হজরত মাওলানা কারি মুহাম্মদ তৈয়্যব কাসেমি (রহ.)-এর দৌহিত্র হজরত মাওলানা সুফিয়ান কাসেমি। সার্বিক নির্দেশনায় এখনও রয়েছেন কারি সাহেব (রহ.)-এর যোগ্য উত্তরসূরী ও তাঁর প্রিয় পুত্র হজরত মাওলানা সালেম কাসেমি। কথায় কথায় এসে দাঁড়ালাম মাদরাসাটির মসজিদপ্রাঙ্গনে। ওপরে লেখা ‘আতইয়াবুল মাসাজিদ’।
দু’রাকাত নামাজ পড়তেই ঘোষণা শুনলাম হজরত মাওলানা সালমান নদবির আগমনের কথা। কেবল ভারতীয় উপমহাদেশ নয়, দারুল উলুম দেওবন্দের সঙ্গে যেমনিভাবে আরব-মাশায়েখদের ওৎপ্রোত সম্পর্ক, সারাবিশ্বের ধর্মীয় অঙ্গনে ততোখানি ঐক্যবন্ধন এখন ওয়াকফের সঙ্গেও। পশ্চিমের সূর্যটা হঠাৎ ডুবতে বসলো। পাশের ‘বাবে তৈয়্যব’ ফটক ধরে ফের দারুল উলুম দেওবন্দের পথ ধরলাম। লেখক : শিক্ষার্থী, উচ্চতর হাদিস বিভাগ, দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারত