স্বাধীনতা যুদ্ধ ও আলেমসমাজ
মাহমুদুল হক জালীস
মানুষের দাসত্ব, শোষণ-বঞ্চনা, আর বৈষম্য-গোলামি থেকে মুক্ত হওয়ার নামই স্বাধীনতা। এটা আল্লাহর মহান নেয়ামত। স্বাধীনতা প্রতিটি মানুষের জন্মগত অধিকার। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে যে সকল অধিকার দিয়ে সৃষ্টি করেছেন সেই অধিকার খর্ব হওয়ার নামই পরাধীনতা। মানবজাতি শুধুমাত্র ভিন্নজাতের উপনিবেশের দ্বারাই পরাধীন হয় না; স্বজাতীয় বা স্বগোত্রীয়দের দ্বারাও মানুষের স্বাধীনতা হরণ হয়। মানুষ যখন মানুষের দ্বারা অধিকার বঞ্চিত হয় তখনই মানুষ পরাধীন হয়। মানুষকে গোলামীর যে জিঞ্জিরে আবদ্ধ করে কিছু মানুষ সে জিঞ্জিরকে ছিন্ন করে স্বকীয়তায় মূর্ত হওয়ার নামই চিরায়ত স্বাধীনতা ।
উপমহাদেশের ইতিহাসে বৃটিশ শাসন যেভাবে জনগনের নিকট নাভিস্বাস হয়ে ওঠে, সেভাবেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তান । তাদের নানাবিধ বৈষম্য-যুলুমে পূর্ব পাকিস্তানিদের জনজীবন দূরভিসন্ধি হয়ে পরে। নির্যাতিত জনগণ তাদের শোষণ-নিপীড়ন থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম শুরু করে। এ সংগ্রাম ও যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এ দেশের আলেমসমাজও। মুক্তিকামী বাঙালিদের পাশে থেকে সবরকমের সহযোগীতাসহ স্বশরীরে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আলেমের সংখ্যা নিতান্তই কম নাই। তারা স্বৈরচারী সরকারের বিপক্ষে প্রাণপণ বাজি রেখে যুদ্ধ করে ছিলেন ।
স্বাধীনতা যুদ্ধে আলেমদের থেকে যারা জোরালো ভূমিকা রেখেছেন, তাদের নামের আংশিক উপস্থাপন করছি। তাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীর যুদ্ধকালীন সঙ্গী ছিলেন মাওলানা শেখ উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী । এমনেভাবে আলেম মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী । চাঁদপুরের মনপুরা সিনিয়ার মাদরাসার সুপারিন্টেনডেন্ট মাওলানা হাবিবুর রাহমান । সিলেটের মাওলানা আবুল কালাম । কুমিল্লা দেবিদ্বার মাওলানা আবদুর রহমান । হাতিয়া দ্বীপের সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা মোস্তাফিজুর রহমান । চট্টগ্রামের পটিয়া থানার ফাজিলখাঁর হাটের স্বনামধন্য মুহাদ্দিস মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা আবদুস সোবহান । রাঙুনিয়ার মাওলানা আবু ইসহাক ও মাওলানা আবুল কালাম । চন্দঘোনার প্রখ্যাত আলেম মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা দলিলুর রহমান । রানীরহাটের মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা মতিউর রসুল । চট্টলার সাহসী বীর গেরিলা মৌলভি সৈয়দ আহমদ চৌধুরী । পটিয়ার মাওলানা নোমান । ছাগলনাইয়ার দুঃসাহসিক মুক্তিযোদ্ধা মৌলভি মাকসুদ আহমদ ভুঁইয়া । কুমিল্লা চৌদ্দগ্রামের মাওলানা আবদুল মতিন মজুমদার । পটিয়া মাদরাসার শিক্ষক মরহুম আল্লামা দানেশ । মালিবাগ মাদরাসার সম্মানিত প্রিন্সিপাল কাজী মুঈতাসিম বিল্লাহ । এছাড়াও হযরত হাফেজ্জি হুজুর রহ.এর নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন মাওলানা এমদাদুল হক আড়াইহাজারী রহ. । চরমোনাইয়ের পীরের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তার জামাতা মাওলানা ইউসুফ আলি খাঁন । এরা ব্যতীত আরো নাম জানা-অজানা হাজারও আলেম স্বাধীনতার জন্য শরীরের তাজা রক্ত বিসর্জন দিয়েছেন । বর্বর পাকিস্তানিদের মোকাবেলা করেছেন । পান করেছেন শাহাদতের অমিয় সুধা ।
যা-ই হোক, বাংলার স্বাধীনতার পিছনে আলেম ওলামাদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা অনস্বীকার্য । তারপরও সবাই আলেমদেরকে স্বাধীনতাবিরোধী মনে করার কারণ আমাদের বোধগম্য নয় । এ ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার আবদুল জলিলের কথাটি প্রণিধানযোগ্য । তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনে একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও হাফেজ্জী হুজুরের মতো লোকের শিষ্যত্ব বরণ করলেন কেন? তখন তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন -হাফেজ্জী হুজুর কখনো রাজাকার ছিলেন না । স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন, একত্তরের যুদ্ধ এটা ‘জালেমের বিরুদ্ধে মাযলুমের লড়াই’ । তারপর তিনি বলেন, আমরা জালেমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি, ইসলামের বিরুদ্ধে নয় । সুতরাং হাফিজ্জীকে যারা রাজাকার বলবে তাদের দাবি সম্পূর্ণ হঠকারিতা ও অমূলক । তারপরও আলেম সমাজকে একশ্রেণির গোষ্ঠী বিভিন্ন কৌশলে কোণঠাসা করে রাখছে । আখ্যা দিচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী হিসাবে। বঞ্চিত করছে রাষ্ট্রের সুযোগসুবিধা থেকে । স্বাধীনভাবে চলা-ফেরা করতে বাধা দিচ্ছে প্রতিনিয়ত । দাড়ি-টুপি দেখলেই হয়রানি করছে পথেঘাটে । চাকরি-বাকরিসহ ইত্যাকার নানা ক্ষেত্রে তাদেরকে নতজানু করে রাখছে । এর জন্যই আমাদের এ দেশটি স্বাধীন হয়নি। দেশটির প্রতিটি নাগরিককে স্বাধীনতা দিতে পারলেই মিলবে প্রকৃত স্বাধীনতা। লেখক : কবি গল্পকার ও প্রাবন্ধিক