শিক্ষার বিস্তারে তিনি ছিলেন সংকল্পবদ্ধ
বাহালুল মজনুন চুন্নূ
লেখক: সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
শিক্ষার সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যে দেশের মানুষ বেশি শিক্ষিত, সে দেশ আর্থসামাজিক দিক দিয়ে বেশি শক্তিশালী; এটা পারিসংখ্যানিকভাবেই কেবল নয়, হাতে-কলমেও প্রমাণিত। শিক্ষা যে সর্বোৎকৃষ্ট বিনিয়োগ তা তথ্য প্রমাণ দিয়ে উপস্থাপন করেছিলেন নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ থিয়োডর শুলজ। বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও শিক্ষাকে বিনিয়োগ হিসেবে দেখেছেন। এই বিষয়ে সত্তরের নির্বাচনি ভাষণে জাতির পিতা যে বক্তব্যে দেন তা স্মরণযোগ্য। তিনি সেদিন বজ্রনিনাদ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে পুঁজি বিনিয়োগের চাইতে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর হতে পারে না।’ বঙ্গবন্ধু তার সেদিনের ভাষণে শিক্ষাকে বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তিনি রাজনীতির কবি, তাই তার রাজনৈতিক কাব্যের পরিসীমায় ব্যষ্টিক মানুষ থেকে শুরু করে মানবগোষ্ঠী ও রাষ্ট্রের কল্যাণ ছিল অন্তর্ভুক্ত; এবং তিনি উপলব্ধি করেছেন এই কল্যাণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হচ্ছে শিক্ষা।
যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন দেশের সর্বত্র ছিল নানাবিধ সংকট। অভাব আর হাহাকারের ভারি বাতাসে মানুষ যখন হাঁসফাঁস করছিল, তখন জাতির পিতা দেশে ফিরে হাল ধরলেন দক্ষ নাবিকের মতো। চারিদিকে বইয়ে দিলেন শান্তির সুবাতাস। নিদারুণ সংকট থেকে মুক্তির জন্য ব্যাপকভিত্তিক প্রশাসনিক উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। সেই উদ্যোগের মাঝে শিক্ষাখাত ছিল অগ্রবর্তী। বিধ্বস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠনের জন্য বাহাত্তরের ২০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে একান্ন কোটি টাকা বরাদ্দের ঘোষণা দেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী। বাহাত্তরের ১২ ফেব্রুয়ারিতে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম বাংলার ঘোষণা দেওয়া হয়। বাংলাদেশের প্রথম বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতের চেয়ে তিন কোটি বাহাত্তর লাখ টাকা বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয় শিক্ষাখাতে। গণশিক্ষার প্রসারে অর্থাৎ নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য জরুরি ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু বরাদ্দ করেছিলেন আড়াই কোটি টাকা। তিনি এক ভাষণে গণশিক্ষা নিয়ে বলেছেন, গণশিক্ষা ছাড়া অর্থনৈতিক সমস্যার কার্যকর সমাধান সম্ভব নয়, সম্ভব নয় সমাজতন্ত্রের বাস্তবায়ন। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রীদের বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন তিনি, যা ছিল নারী শিক্ষা অগ্রযাত্রায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। জাতির পিতা যথাযথভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, শিক্ষার প্রাথমিক স্তরের ভিত যদি মজবুত করা না যায় তাহলে দেশে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি হবে না, দেশকে উন্নয়নের দিকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। এজন্য প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে শিশুদের মাঝে বিনামূল্যে বই, খাতা, পেনসিল, দুধ, ছাতু, বিস্কুট বিতরণ কার্যক্রম গ্রহণ করেছিলেন। তবে তার দুঃসাহসী ও চ্যালেঞ্জিং পদক্ষেপ ছিল ৩৬১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা। সেটা তিনি বেশ সাফল্যের সঙ্গেই সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন। বৃত্তিমূলক শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ জনগোষ্ঠী দেশের অর্থনৈতিক ভিতকে মজবুত করে তুলবে, এজন্য তিনি মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করে দেশে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। উচ্চশিক্ষার প্রসারের জন্য তার নির্দেশে ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স ঘোষণা করা হয়েছিল, যার মূল উদ্দেশ্যে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিন্তার স্বাধীনতা ও মুক্ত-বুদ্ধিচর্চার পরিবেশ সৃষ্টি করা। এই অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল যা মুক্তিবুদ্ধি চর্চার পথকে সুগম করেছিল। সেই থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে।
শিক্ষা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা, দর্শন এবং শিক্ষার উন্নয়নমূলক কর্মকা-ের প্রতিচ্ছবি প্রতিবিম্বিত হয়েছে তার নির্দেশে প্রণীত কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই ড. মুহাম্মদ কুদরত-ই-খুদাকে সভাপতি করে শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। সেই কমিটিকে বঙ্গবন্ধু তার শিক্ষাসংক্রান্ত ধ্যান-ধারণার কথা জানিয়েছিলেন, নির্দেশনা দিয়েছিলেন। যা অনুসরণ করে কমিশন ১৯৭৩ সালের ৮ জুন অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট এবং ১৯৭৪ সালের ৩০ মে চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করেন। কমিশন দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা এবং সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের উপর ভিত্তি করে রিপোর্ট প্রণয়ন করেছিল। এই রিপোর্টে সমসাময়িক বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতও বিবেচনায় আনা হয়েছিল। এই রিপোর্টে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছিল। বঙ্গবন্ধু বলতেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এ যাবৎ শুধু আমলা সৃষ্টি করেছে, মানুষ সৃষ্টি করেনি। এখানে মানুষ বলতে তিনি প্রাণ ও কর্মশক্তিতে বলীয়ান মনুষ্যত্ব অর্জনকারী মানুষের কথা বলেছেন। তাই কমিশন সেই রকম মানুষ সৃষ্টি করার উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ণের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছিল। কমিশন শিক্ষাখাতে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ যেমন মোট জাতীয় আয়ের সাত ভাগ শিক্ষাখাতে ব্যয় করা, বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার, পাঁচ বছরের মধ্যে সাড়ে তিন কোটি নিরক্ষরকে অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন করা, শিক্ষকের মর্যাদা ও আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধি, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের শিক্ষকের বৈষম্য দূর করা, নারী শিক্ষার প্রসার, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালুকরণ, শিক্ষার সকল স্তরে বাংলা মাধ্যম প্রবর্তন, পাঠ্যক্রম পুনর্বিন্যাস, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, উচ্চশিক্ষায় গবেষণাসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্র্ণ সুপারিশ করে। এই সুপারিশগুলো করা হয়েছিল জাতীয় আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে। বঙ্গবন্ধু কমিশনের রিপোর্টটিকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন এবং তা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক সৃজনশীল শোষণমুক্ত সমাজ নির্মাণের এই বিশাল কর্মযজ্ঞ পরিপূর্ণতা পাওয়ার আগেই পাকিস্তানি ভাবধারা লালনকারী ঘৃণ্য চক্রান্তকারী ও তার দোসররা পনেরোই আগস্টের ভয়াল রাতে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম ঘটনা ঘটাল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্যদিয়ে। তারা দেশকে আবারো পাকিস্তানি যুগের অন্ধকার অতল গহবরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। দীর্ঘ একুশ বছর তারা সুকৌশলে বাঙালিকে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করার প্রয়াস চালিয়েছিল, বাঙালিকে ভুল পথে চালিত করতে পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাসকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। অন্যান্য সকল ক্ষেত্রের মতো শিক্ষাক্ষেত্রেও যে অরাজকতা, যে অমানিশার অন্ধকার ঘিরে ধরেছিল, তা থেকে পরিত্রাণের যাত্রা শুরু হয়েছিল ছিয়ানব্বই সালে বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসীন হওয়ার মধ্যদিয়ে। আর ২০০৯ সাল থেকে আঘাত করা হতে থাকে সাম্প্রদায়িক ও সনাতনি ধ্যান-ধারণায় লালিত শিক্ষাব্যবস্থার বেদিমূলে। কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদনের আলোকে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সময় প্রণীত ও বাস্তবায়িত হচ্ছে। এতে কেবল দক্ষ মানবসম্পদই তৈরি নয়, আমলার পরিবর্তে প্রকৃত মানুষ সৃষ্টি করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে এমডিজির লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে সমর্থ হয়েছে। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ১৬.৮ শতাংশের সাক্ষরতার হার এখন পৌঁছেছে ৭১ শতাংশে। শিক্ষায় অভিগম্যতা বৃদ্ধির ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার ফলে প্রাথমিক স্কুলে মোট ভর্তির হার ১০০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। নারী শিক্ষার হার ৭৪% এ উন্নীত হয়েছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় সর্বাগ্রে পরিমাণগত উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে, আর এখন জোর দেওয়া হচ্ছে গুণগত উন্নয়নের দিকে। এজন্য শিক্ষায় ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হয়েছে। বিনামূল্য পাঠ্যবই বিতরণের মধ্যে বিশাল কর্মযজ্ঞ সরকার অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করছে। পরিকল্পিতভাবে সুসম্পন্ন করা হচ্ছে শিক্ষার প্রতিটি স্তরের পরীক্ষা ও ফল প্রকাশ কার্যক্রম। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হচ্ছে। শিক্ষার মানউন্নয়নে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ এবং প্রশিক্ষণের জন্য নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। শিক্ষানীতি প্রণয়ন, পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সংযোজন, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু, বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ, অবকাঠামো উন্নয়নসহ শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য যে বিশাল কর্মযজ্ঞ গ্রহণ করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, তার ফলশ্রুতিতে শিক্ষার আলোয় আলোকিত দেশপ্রেমিক মানুষ তৈরি হচ্ছে। দক্ষ জনসম্পদ তৈরি হচ্ছে। এই দক্ষ জনশক্তি ইতোমধ্যে এই দেশের অর্থনীতির ভিত্তিকে করেছে টেকসই, দেশকে এনে দিয়েছে বিশ্বের বুকে ভিন্ন এক পরিচিতি, যে পরিচিতিতে দেশের মানুষ গর্বিত। তারপরও যে প্রশ্নটি থেকেই যায় তা হলোÑ বাংলাদেশ কি শিক্ষার গুণগত মানের দিক দিয়ে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনো লক্ষ্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বেশকিছু প্রতিকূলতা রয়ে গেছে। প্রশ্ন ফাঁসসহ যেসব বির্তকিত ইস্যু লক্ষ্য পৌঁছানোর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে, সেই সব প্রতিকূলতাকে চিহ্নিতকরণ ও তা নিরসনের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজš§কে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশা অনুযায়ী কর্ম ও প্রাণশক্তিতে বলীয়ান মনুষ্যত্ব অর্জনকারী প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। আর তাহলেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জš§দিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানো স্বার্থক হবে।
সম্পাদনা: আশিক রহমান