সাগর যাহার বন্দনা রচে শত তরঙ্গভঙ্গে
অজয় দাশগুপ্ত
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমাদের ভাবাবেগের প্লাবণ চলছে। তার গড়া দলটি দেশের শাসনভারে থাকায় এই জোয়ার এখন দেখার মতো। তিনি যদি আমাদের দেশে না জন্মে আমাদের সমাজে না জন্মে তিনি যদি কোনো উন্নত নামে পরিচিত কোনো দেশে জন্মাতেন আজ তার কথা থাকত দুনিয়ার ইতিহাসে। সেদিন বিশ্বের সেরা ভাষণগুলোর প্রনিধানযোগ্য একটি বই পড়ে দেখি কোথাও তিনি নেই। তার ঐতিহাসিক ভাষণহীন এই গ্রন্থে নেহেরু এমনকি পাকিস্তানি নেতার ভাষণও আছে। কেন নেই জাতির জনকের ভাষণ? কারণ আমরা বাঙালি, পদ্মাপাড়ের বাংলাদেশি।
নানা উজ্জ্বলতায় বাংলাদেশ ও বাঙালি বিশ্বে তার জায়গা করে নিলেও, কলহপ্রিয়তা দীর্ন করে রেখেছে আমাদের। আমি বলি আমাদের জাতীয় পরিচয় অনেকটা কমলালেবুর মতো। বাইরে এক মনে হলেও ভিতরে বহুধা বিভক্ত। প্রত্যেক কোষ স্বতন্ত্র এবং একটি আরেকটি থেকে বিচ্ছিন্ন। এই জাতিকে বঙ্গবন্ধু যে কিভাবে একত্রিত করতে পেরেছিলেন সেটাই আসলে আশ্চর্যের বিষয়। এই মানুষটি তার জীবনকে উপভোগ করারও সময় পাননি। যতবছর কারাবাস করেছেন তার সিকিভাগ করলেও আজকের নেতাদের খুঁজে পাওয়া যেত না। তার কারাবাসমুক্তির চমৎকার একটি গল্প মনে পড়ছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তির পর তিনি একবার হাসত হাসতে বলেছিলেন, আমি জানতাম আমার মুক্তির দিন ঘনিয়ে এসেছে। সবাই অবাক হয়ে জানতে চাচ্ছিল কিভাবে তিনি এতটা নিশ্চিত ছিলেন? হাসতে আসতে তিনি বলেছিলেন, কারাগারে তাকে পড়ার জন্য তখনকার খবরের কাগজ দেওয়া হতো এবং তা কর্তিত। অর্থাৎ যেটুকু জুড়ে আন্দোলন ও তার মুক্তির খবর ততটা কেটে পাঠানো হতো তার কাছে। তিনি বলেছিলেন, গোড়ার দিকে ওই কাটা জায়গাটুকু দিয়ে আঙুল ঢোকানো গেলেও একসময় বঙ্গবন্ধু দেখলেন তার মাথাও বেরিয়ে আসছে পত্রিকা ফুঁড়ে। যার মানে কাগজে তার মুক্তি ছাড়া আর কোনো খবর নেই। এমন চমৎকার মনোভাব ও রসিকতার নেতাকে আমরা বজ্রকণ্ঠে পাকিস্তানের মতো দানবকে শাসিয়েছেন তিনি। দেশ স্বাধীনের পর নিজের বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞা দিয়ে তিনি স্বদেশকে পরিচিত করাতেন বিশ্বে। সত্যিকারার্থে তার মৃত্যুর পর এইদেশ পড়েছিল ভয়াবহ ইমেজ সংকটে। এমনকি তার জীবদ্দশায়ও দেশের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছিল একদল লোক। সঙ্গে ছিল আমেরিকা-পাকিস্তান-চীনের মতো শক্তি। তারা সুবিধা করতে না পেরে তাকে হত্যার ভিতর দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিশোধ নেবার পর তাকে মুছে ফেলার দীর্ঘ চক্রান্ত চলেছিল এইদেশে। তারা শেষ পর্যন্ত আজ ইঁদুরের মতো গর্তে ঢুকতে বাধ্য হয়েছে।
কিন্তু বেরিয়ে এসেছে অজস্র নতুন ইঁদুর। যারা তাকে জানে না তাকে মানে না তার অসাম্প্রদায়িক মুক্ত স্বদেশ বোঝে না তারাই আজ নাম ভূমিকায়। দলে দলে নতুন নতুন মানুষ আর তাদের খামখেয়ালিপনায় বঙ্গবন্ধুর কোনো লাভ লোকসান নেই। থাকবেও না। কিন্তু সাময়িকভাবে এরা মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার জায়গায় আঘাত আনছে। আমাদের মতো রাজনৈতিক দল না করা বাঙালি তাকে যেকোনো দল বা সম্প্রদায়ের বাইরে সমগ্রজাতির ভাবলেও এদের জন্য তা ভাবতে পারছি না।
এই বাংলার নীলাকাশে, এই জনপদের সাগর কল্লোলে, এই মাটির সবুজ শ্যামলে যিনি অমর অজেয় তাকে নিয়ে এসব কোলাহল বা হালকা কাজগুলো বন্ধ হোক। বহু পূণ্যের ফলে এদেশ তার মতো একজন নেতা পেয়েছিল। যিনি জীবনকে উৎসর্গ করতে জানতেন। আমরা বরং আমাদের কর্ম আর চেতনাকেই উৎসর্গ করি তার জন্যে। তার জন্যে আর কোনো আনুষ্ঠানিকতার আসলেই দরকার নেই। জয়তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। শুভ জন্মদিন জনক।
লেখক: সিডনি প্রবাসী, কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষক
সম্পাদনা: আশিক রহমান