খোকা থেকে জাতির জনক
ফরিদুন্নাহার লাইলী
‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং শেখ মুজিবুর রহমান এ দুটো যমজ শব্দ, একটা আরেকটার পরিপূরক এবং দুটো মিলে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের উজ্জ্বল-প্রোজ্জ্বল এক অচিন্তিত পূর্ব কালান্তরের সূচনা করেছে।’ শেখ মুজিবুর রহমান নামক প্রবন্ধে এমনটাই লিখেছেন স্বনামধন্য লেখক আহমদ ছফা।
ইতিহাসের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেছিলেন সবুজ শ্যামল এই বাংলায়। তার জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন ফরিদপুর জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। তার পিতার নাম শেখ লুৎফুর রহমান, মাতা সায়েরা খাতুন। তিনি পিতা-মাতার তৃতীয় সন্তান ছিলেন। পরিবারের সবাই ‘খোকা’ নামে ডাকতেন। কেউ কি ভেবেছিল শেখ পরিবারের আদরের ছোট্ট খোকা একদিন বিশ্বনন্দিত নেতা হবেন কিংবা স্বাধীনতায় নির্যাতিত-নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর ত্রাণকর্তা? গভীর দেশপ্রেম, সীমাহীন আত্মত্যাগ ও অতুলনীয় নেতৃত্বে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। তার বীরত্বপূর্ণ নেতৃত্বে একটি দেশ স্বাধীন হয়েছে। বাংলার শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ে নেতৃত্বের জন্য জনগণ তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনে তার সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা, জেল-জুলুম, নির্যাতন-কারাবন্দির কারণে ইতিহাসে তাকে জাতির পিতার অভিধায় অভিষিক্ত করা হয়।
বঙ্গবন্ধু কখনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতেন না কিংবা অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি। তাই তো তিনি বাংলার জনগণের কাছ থেকে স্বীকৃতি পেয়েছেন হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে। তিনি যে একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে ভূষিত হবেন তার প্রমাণ পাওয়া যেত বাল্যকাল থেকে। কারও সঙ্গে অন্যায় করা হচ্ছে বা কারও অধিকার হরণ করা হচ্ছে দেখলে প্রতিবাদীরূপে তিনি সেখানে আবির্ভূত হতেন। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী পাঠের মধ্যদিয়ে এই ঘটনাগুলো বারবার আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। অসহায় মানুষ দেখলে তিনি ব্যাকুল হয়ে যেতেন। একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করতে চাই, ‘এই সময় শহীদ (সোহরাওয়ার্দী) সাহেব লঙ্গরখানা খোলার হুকুম দিলেন। আমিও লেখাপড়া ছেড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অনেকগুলো লঙ্গরখানা খুললাম। দিনে একবার করে খাবার দিতাম। মুসলিম লীগ অফিসে, কলকাতা মাদ্রাসায় এবং আরও অনেক জায়গায় লঙ্গরখানা খুললাম। দিনভর কাজ করতাম, আর রাতে কোনোদিন বেকার হোস্টেলে ফিরে আসতাম, কোনোদিন লীগ অফিসের টেবিলে শুয়ে থাকতাম।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী/ শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা ১৮)
মার্চ মাস একটি ঐতিহাসিক মাস। এই মাসেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। এই মাসেই তিনি জাতিকে মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। এই মাসেই তিনি নিজেদের একটি স্বাধীন ভূ-খ-ের জন্যে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধু আজ বেঁচে থাকলে আমরা একটি সুখী সুন্দর সোনার বাংলা অনেক আগেই অর্জন করতে পারতাম। বিজয় অর্জনের পর সরকার গঠন করে তিনি একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে যেভাবে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেটাই তার প্রমাণ বহন করে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত ‘বঙ্গবন্ধু-সমতা-সাম্রাজ্যবাদ’ নামক তার বইতে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে ১৯৭৩ থেকে ২০১১ সাল নাগাদ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মোট দেশজ উৎপাদনের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াত ৯ শতাংশ। এ হিসেব নিরূপণে বিভিন্ন যৌক্তিক অনুসিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ধরে নিয়েছি যে বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে ২০১১ সাল নাগাদ (তখন বঙ্গবন্ধুর বয়স হতো ৯০ বছর) তিনি মোট ৭টি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার পূর্ণ সময়সহ অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রথম ৩ বছর সময় পেতেন।’
স্বাধীনতার বিরুদ্ধ শক্তি এবং তাদের দোসররা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে সেই পথ রুদ্ধ করে দেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধ্বংস করা এবং এই দেশকে বিশ্ব দরবারে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করে তোলা। অথচ বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসূরি তারই কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে দেশ তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববাসীকে অবাক করে। সেই বিরোধী চক্র নিজেরাই আজ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে গেছে।
সেই কারণেই হয়তো আহমদ ছফা লিখেছেন, ‘একজন ব্যক্তির শারীরিক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক মিশনকে হত্যা করা যায় না। কারণ ব্যক্তির মৃত্যু ঘটতে পারে; কিন্তু আদর্শের মৃত্যু নেই।’ আজকে সবার কাছে এটাই মনে হয়, বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে আমরা লাল-সবুজের একটি পতাকা পেতাম না। নিজেদের স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিতে পারতাম না। তাই তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক: কৃষি ও সমবায় সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং সাবেক সংসদ সদস্য
সম্পাদনা: আশিক রহমান