জাতির পিতার জন্মদিনে
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি রাষ্ট্রপিতা এবং বাংলাদেশ ভূ-সীমার বাঙালিদের জন্য নিজস্ব আবাস ভূমির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বাঙালি জাতির জনক তিনি। ইতিহাসেরÑ বাঙালির ইতিহাসের এক অনন্য অসাধারণ ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিবুর রহমানের পরিচয় এটাই। বলা হয়ে থাকে তিনি সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাঙালি। বাস্তবে তিনি আবহমান বাঙলার মহত্তম ও শ্রেষ্ঠতম বাঙালি। বাঙলা ভাষাভাষিগণ ইতিহাসের স্তরে স্তরে বহু অনন্য অসাধারণ মানুষকে নিজেদের কা-ারী হিসেবে পেয়েছেনÑ রাষ্ট্রীয় জীবনে, সাংস্কৃতিক জীবনে, আর্থ-সামাজিক জীবনে এবং ভবিষ্যতেও বহু অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্বÑ নারী ও পুরুষÑ বাঙালি জীবনে অসাধারণ গুণাবলী নিয়ে আবির্ভূত হবেন, কিন্তু, বাঙলা ভাষাভাষিদের জন্য একটি নিজস্ব আবাসভূমি গঠনে এবং বাঙালি জাতিসত্তার জন্য স্বাধীন বিকাশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়ার প্রশ্নে শেখ মুজিবের তুলনা তিনি নিজেই। শেখ মুজিব ছাড়া স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা সম্ভব ছিল কি না তা নিশ্চিত নয়। হয়তোবা ইতিহাসের প্রয়োজনে একদিন বাঙালি স্বাধীনতা পেত, কিন্তু কবে (?) তা কি কেউ বলতে পারবেন? এই প্রশ্নটিই হলো কেন্দ্রীয় বিষয় ও প্রশ্ন। ভারত বিভক্তির পূর্ব থেকেই একজন ছাত্রকর্মী হিসেবে রাজনীতিতে মুজিবের প্রবেশ এবং ভারত বিভক্তির পূর্বেই বাঙালি মুসলমান ছাত্র-যুবাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি হিসেবে তাঁর অবির্ভাব। ভারত বিভাগের পর পাকিস্তানের পূর্বদেশ পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে সক্রিয় হলেন এবং সরকারি নির্যাতনের শিকার হয়ে যাত্রা শুরু করলেন। ১৯৪৬ সনে ছাত্র-যুবকর্মী মুজিব যে যাত্রা শুরু করলেন শেখ মুজিব হিসেবে, অচিরেই হয়ে উঠলেন তিনি মুজিব ভাই এবং মুজিব ভাই থেকে শেখ সাহেব (বাংলাদেশে এখনও শেখ সাহেব বলতে সাধারণ মানুষ বঙ্গবন্ধুকেই বুঝে থাকেন এবং শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা মিশ্রিত এই শেখ সাহেব সম্বোধন রয়ে যাবে অনন্তকালব্যাপী)। মুজিব ভাই থেকে শেখ সাহেব হয়ে-উঠার সময়টা বঙ্গবন্ধুর জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
টুঙ্গিপাড়ার হাওড়-বাঁওড় আর নদী-খালের তীরে তীরে অবারিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে শৈশব আর কৈশোর কেটেছে তাঁর। এভাবেই শেখ মুজিবের মাঝে গড়ে উঠে এক উদার বিশাল আর বৈচিত্রপূর্ণ চারিত্রিক দৃঢ়তা যা পরবর্তী জীবনে তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে লক্ষ্যবস্তুতে। মফস্বল শহর গোপালগঞ্জের ক্ষুদ্র গ-ি পেরিয়ে মহানগর কলকাতার বিশাল বৈশ্বিক পরিবেশে সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা ফজলুল হক আর আবুল হাশিমের মতো আধুনিক মানুষের সাহচর্য তাঁর প্রকৃতির মাঝে গড়ে উঠা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে সুশৃঙ্খল জীবনবোধে পরিণত করে বৈশ্বিক (টহরাবৎংধষ) দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে সহায়তা করেছিল। গ্রামীণ প্রকৃতি আর কসমোপলিটন নগরীর বিশাল পরিবেশ থেকে শিক্ষা নিয়ে তিনি ক্ষুদ্রতা আর কূপম-ুকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন এবং আর দশজন সাধারণ ছাত্রের ন্যায় সাধারণ ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গ-ি অতিক্রম করে সময়ের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন। একটি জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য যে বিশ্ববীক্ষণ ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রয়োজন তা তিনি অর্জন করেছিলেন জীবনের পথ পরিক্রমায়। বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন কীভাবে বিশ্বনেতৃত্ব গড়ে উঠছে। তিনি দেখেছিলেন কীভাবে প্রতিশ্রুতিশীল নেতৃত্ব আর আন্দোলন মার খেয়ে যাচ্ছে আর মাঝপথে মুখ থুবড়ে পড়ছে। এসব থেকে তিনি শিক্ষা নিয়েছিলেন।
সময়টা ছিল অন্যরকম। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা তখন দুনিয়াব্যাপী নেতৃত্বে উঠে এসেছেন অথবা আসছেন। স্ট্যালিন, মাও সে তুং, মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, সুভাষ বসু, মাওলানা আযাদ, চার্চিল, হিটলার, রুজভেল্ট, আইজেন হাওয়ার, সুকর্ন, নাসের, নক্রুমা প্রমুখ নেতৃত্ব দিয়েছেন বিশ্বের। সুবিশাল বিশ্বের এসব কুশলী নেতার জীবন-সংগ্রাম ছিল তাঁর চোখের সামনে। তিনি শিক্ষা নিয়েছেন তাঁদের জীবন থেকে। সময় তাঁকে পথ দেখিয়েছে। সময়ের হাত ধরে তিনি পথ চলেছেন অকুতোভয়ে। তিনি স্থির করেছিলেন তাঁর লক্ষ্য এবং লক্ষ্যার্জনে এগিয়ে গেছেন দৃঢ় পদবিক্ষেপে। পেছন ফিরে তিনি হয়তো দেখেছেন, তা শুধু সামনে চলার পাথেয় সংগ্রহে। যাঁরা পেছন ফিরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে, তিনি তাদের দলের নন।
শেখ মুজিবকে দলের ভেতরের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি এবং হঠকারীদের সাথে নিরন্তর সংগ্রাম করে এগুতে হয়েছে। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুতে অনেকেই মনে করেছিলেন যে মুজিবের রাজনীতির অবসান সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু তা নয়। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুতে তিনি অভিভাবকহীন হয়ে নিজেই নিজের অভিভাবক হয়ে যান। তাঁর মধ্যে যে স্বাধীন স্বতন্ত্র সত্তার নেতৃত্ব ঘুমিয়েছিল তা জেগে উঠে। সোহরাওয়ার্দীর ভাবশিষ্য শেখ মুজিব ইতিহাসের পাতায় উঠে আসেন এক অসাধারণ বাগ্মী হিসেবে, যা তাঁকে স্থাপন করে এডম- বার্ক, কামাল আতাতুর্ক, আব্রাহাম লিংকন আর বিপিন চন্দ্র পালের কাতারে। তাঁর এই অসাধারণ বাগ্মিতা সমগ্র বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সাহায্য করেছিল।
১৯৭১ সনের ৭ মার্চের অভিভাষণ তাঁকে ইতিহাসের চূড়ায় তুলে দেয়। তিনি উঠে আসেন বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কদের কাতারে (এর আগে ৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ের পর বিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শন করে ঢাকায় এসে তদানিন্তন শাহবাগ হোটেল (বর্তমানে যেটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি) যে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন, তাও এক অনন্য সাধারণ দলিল আমাদের মুক্ত সংগ্রামের ইতিহাসের)। বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে তাঁর ভূমিকা হয়ে উঠে একক ও অদ্বিতীয়। আশপাশে আর কেউ রইলেন না। জাতির নেতৃত্বের চূড়ায় তিনি বৃত হলেন। সমগ্র জাতি তাঁর ডাকে ঐক্যবদ্ধ হলো। এ এক অভূতপূর্ব অবস্থা। ১১ দফার আন্দোলন, ৬৯-এর গণআন্দোলন (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বিরোধী আন্দোলন), ৭০-এর নির্বাচন আর ৭১-এর অসযোগ আন্দোলনের সময়কাল যারা দেখেছেন তাঁরা জানেন কীভাবে আন্দোলন সংগ্রামের গর্ভ থেকে পূর্ববঙ্গ হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ আর শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু আর জাতির জনক। এ সময়টা বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তা আর বাংলার নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের সোনালি সময়।
শেখ মুজিবুর রহমান এক অন্য মানুষ। জীবনের প্রতীক তিনি। আর জীবন হচ্ছে সামনে পথ চলা। পশ্চাৎগামীতা তাঁকে কখনো ছুঁতে পারেনি। একজন এজিটেটর থেকে একজন পূর্ণাঙ্গ জাতীয় নেতায় তাঁর সফল উত্তরণ বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল তেমনি তা ছিল বাঙালির ইতিহাসের আবহমান কালের বাঁক বদলের মাহেন্দ্রক্ষণ।
স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি শোষণহীন ক্ষুধামুক্ত ও অগ্রসর গণতান্ত্রিক সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন। আজকের বাঙালি ও বাংলাদেশের নাগরিকরা তাঁর সে স্বপ্নকেই বাস্তবে রূপ দিতে এক নবতর আন্দোলনের মধ্যদিয়ে অগ্রসর হচ্ছে তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। বাঙালির এই সংগ্রাম তার স্মৃতির বেদীতে প্রতিদিনকার শ্রদ্ধাঞ্জলি।
‘যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান
ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’
লেখক একজন মুক্তিযোদ্ধা, সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্য নির্বাহী কমিটির সদস্য।