গৃহযুদ্ধপীড়িত সাউথ সুদানবাসীর পথে পথে কাঁটা
আনোয়ার সাত্তার, ইউ এন কম্পাউন্ড, বোর, সাউথ সুদান থেকে
১০ ডিসেম্বর, ২০১৬ সাল। সকালে প্রতিদিনকার নিয়মিত প্রাতঃকালীন মিটিংয়ে বোর ইউ এন পুলিশ চিফ ইউক্রেনের দিমিত্র শেস্তাকভ আমার টিম কমিউনিটি পুলিশিংকে একটি দায়িত্ব দিলেন। জাতিসংঘ বোর ফিল্ড অফিসের হিউম্যান রাইটস ইউনিট, বোর টাউন সেন্ট্রাল প্রিজনের কারাবন্দিদের জন্য একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে, বোর ইউ এন পুলিশ-এর প্রতিনিধি হিসেবে আমার টিমকে সেটিতে অংশ নিতে হবে এবং মনিটর করতে হবে। হিউম্যান রাইটস ইউনিট অনুষ্ঠানটি আয়োজন করেছে ৬৮তম আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উদযাপনের অংশ হিসেবে।
প্রতিবছর ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস পালিত হয়। ১৯৪৮ সালের এইদিনে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মানবাধিকারবিষয়ক সার্বজনীন ঘোষণাপত্র গৃহীত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পর। এই দিনটির স্মৃতিস্বরূপ মানবাধিকার দিবস পালিত হয় বিশ্বজুড়ে। ২০১৬ সালে দিবসটির থিম ছিলÑ ‘স্ট্যান্ড আপ ফর সামওয়ানস রাইটস টুডে’।
সকাল ১০টায় কমিউনিটি পুলিশিং টিম থেকে আমি ও গাম্বিয়ান মহিলা সহকর্মী ফাতু বোজাং এবং বোর ইউএন পুলিশের ডেপুটি চিফ নাইজেরিয়ার ক্রিস্টোফার এমিনিকেÑ আমরা ৩ জন একটি গাড়িতে রওয়ানা দিলাম। খানাখন্দে ভরা কর্দমাক্ত রাস্তা পেরিয়ে আধা ঘণ্টা পর সেন্ট্রাল প্রিজনে গিয়ে পৌঁছালাম। বোর শহর এবং শহরের বাইরে সড়ক এবং মহাসড়ক বলে যা আছে তা সবই কাঁচা মাটির রাস্তা। বর্ষাকালে এবং ভারী বৃষ্টিপাত হলে এই সড়কগুলোর অবস্থা হয় করুণ, কোমর সমান পানি জমে যায় এবং অনতিক্রম্য হয়ে পড়ে। সাউথ সুদানে দুইটি ঋতু, গরমকাল আর বর্ষাকাল। সেপ্টেম্বর মাস থেকে বর্ষাকাল শুরু হয়ে নভেম্বর পর্যন্ত থাকে আর বছরের বাকিটা সময় গরমকাল।সেন্ট্রাল প্রিজনে পৌঁছে বেশ কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকি ও গেট পার হয়ে কারাভ্যন্তরে ঢুকলাম। সেখানে আগে থেকেই বোর হিউম্যান রাইটস ইউনিটের চিফ আলফ্রেড জুলুসহ অন্যরা ছিলেন। জাতিসংঘর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডঋচ), শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (টঘঐঈজ)সহ জাতিসংঘ বোর ফিল্ড অফিসের বিভিন্ন ইউনিটের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। ইউ এন বেইজ থেকে ইন্ডিয়ান আর্মির একটা দল এলো অনুষ্ঠানটির লজিস্টিক সাপোর্ট দেওয়ার জন্য। কোনো কোনো কারাবন্দিদের হাতে পায়ে শেকল লাগানো। কারাবন্দিদের মধ্যে ২০০ পুরুষ আর ১০ জন মহিলা ছিল। সবাইকে টি-শার্ট, সাবান, শুকনো খাবারের গিফট প্যাক দেওয়া হলো। মহিলা বন্দীদের জন্য বিশেষ গিফট প্যাক দেওয়া হলো, যেটিকে বলা হচ্ছিলÑ ডিগনিটি কিটস গিফট প্যাক। কারাবন্দিদের বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল, তাদের চোখে মুখে খুশি উপচে পড়ছিল।
বোর হিউম্যান রাইটস ইউনিটের চিফ আলফ্রেড জুলু স্থানীয় একটি রেডিওতে ইন্টারভিউ দিচ্ছেন। গাম্বিয়ান ও নাইজেরিয়ান সহকর্মীদের পাশে আমি। টি-শার্ট পেয়ে বন্দীরা খুব খুশি। কারাবন্দিরা অনুষ্ঠান উপভোগ করছে। বন্দীদের সঙ্গে আমি ও গাম্বিয়ান সহকর্মী। বিতরণ অনুষ্ঠানের পর কারাভ্যন্তরে একটি খোলা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হলো সব বন্দীদের। সেখানে ইন্ডিয়ান আর্মি ৩টি তাঁবু টানিয়ে চেয়ার পেতে সবার জন্য বসার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বোর ইউ এন ফিল্ড অফিস প্রধান মিসেস ডেবোরাহ শেইন, যিনি মার্কিন নাগরিক এবং ইতোপূর্বে বিভিন্ন ইউএন মিশনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। বিশেষ অতিথিবৃন্দের মধ্যে ছিলেন বোর হাইকোর্টের একজন বিচারপতি এবং বোর সেন্ট্রাল প্রিজনের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলফ্রেড মায়াং। প্রধান অতিথি মিসেস ডেবোরাহ তার বক্তব্যে বলেন, কারাবন্দিদেরও অধিকার রয়েছে, সুষ্ঠু এবং দ্রুত বিচার পাওয়ার। স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ পরিবেশে থাকার। আদালতে প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের অপরাধী বলা যাবে না। তিনি বলেন বোর ইউএন ফিল্ড অফিস নিয়মিত বন্দীদের সুষ্ঠু এবং দ্রুত বিচার পাওয়ার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করবে এবং কারাগারের উন্নতির জন্য সম্ভব সকল সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে। বক্তব্য রাখছেন ইউএন বোর ফিল্ড অফিস প্রধান মিসেস ডেবোরাহ শেইন।
ভারপ্রাপ্ত কারা পরিচালক তার বক্তব্যে বলছিলেন, এখানের কারাবন্দিদের খাবারের জন্য কোনো সরকারি বরাদ্দ তারা পান না। স্থানীয়ভাবে তারা কিছুটা ব্যবস্থা করেন আর বন্দীদের স্বজনদের দেওয়া খাবার দিয়ে কোনো রকমে চালিয়ে নেন। এ স্বীকারোক্তি শুনে উপস্থিত সবাই যুগপৎ বিস্মিত ও দুঃখিত হন। এই স্বীকারোক্তিতেই স্পষ্ট বোঝা যায়, এখানকার বন্দীরা কেমন মানবেতর অবস্থায় থাকেন। তিনি আরও বলেন, কারাগারের প্রায় সব ভবনই জরাজীর্ণ এবং পুরনো, যেকোনো সময় ধসে পড়ার মতো দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। আরেকটি আতঙ্কিত হওয়ার মতো স্বীকারোক্তি।
আসলে এটিই এখনকার গৃহযুদ্ধপীড়িত সাউথ সুদানের বাস্তব চিত্র। যুদ্ধ, মুদ্রাস্ফীতি আর দারিদ্র্যের কষাঘাতে র্জরিত সাউথ সুদান সরকারের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ নেই। মাসের পর মাস শিক্ষা বিভাগ, স্বাস্থ্য বিভাগসহ বিভিন্ন সরকারি দফতরের কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করতে পারে না সরকার। যে কারণে বিভিন্ন সরকারি কর্মচারীদের ধর্মঘট এখানে নিয়মিত ঘটনা। লাখ লাখ লোক ঘর-বাড়ি ছেড়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে উদ্বাস্তু জীবনযাপন করছে। কেউ জাতিসংঘের আশ্রয় শিবিরগুলোতে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হয়ে আছেন আবার কেউ প্রতিবেশী দেশ উগান্ডা, কেনিয়া ও সুদানে উদ্বাস্তু জীবনযাপন করছে। এর মধ্যে বেন্টিউতে জাতিসংঘের আশ্রয় শিবিরে এক লাখেরও বেশি উদ্বাস্তু রয়েছে। যেটিকে বলা হয় বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উদ্বাস্তু শিবির। আমি যেখানে কাজ করি বোর আশ্রয় শিবিরে প্রায় আড়াই হাজার উদ্বাস্তু রয়েছে। এই উদ্বাস্তুরা জাতিসংঘের আশ্রয়ে এবং নিরাপত্তায় অনেকটা বন্দী জীবনযাপন করে। কারণ প্রতিপক্ষ গোত্রের হামলার ভয়ে তারা মুক্তভাবে শিবিরের বাইরে চলাচল করতে পারে না, করলেও খুব সীমিতভাবে। আশ্রয় শিবিরগুলোতে জাতিসংঘ বাহিনী ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে।
সাউথ সুদান জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ পুলিশ সাউথ সুদান জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ পুলিশ থেকে বর্তমানে ২৭ জন কর্মকর্তা পুলিশ অ্যাডভাইজার হিসেবে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে বিভিন্ন দায়িত্বে কর্মরত আছেন। সাউথ সুদান যুদ্ধপীড়িত পৃথিবীর সর্বকনিষ্ঠ দেশ দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ৯ জুলাই, ২০১১ সালে সুদান থেকে স্বাধীনতা লাভ করে পৃথিবীর সর্বকনিষ্ঠ রাষ্ট্র সাউথ সুদান। সাউথ সুদানের রাজধানী জুবা। সুদান, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, উগান্ডা, কঙ্গো এবং সেন্ট্রাল আফ্রিকা রিপাবলিক সাউথ সুদানের প্রতিবেশী দেশ। কিন্তু স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরও শান্তি বেশিদিন স্থায়ী হলো না। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রেসিডেন্ট সালভা কির যিনি ডিঙ্কা গোত্রের এবং তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. রিয়েক মাচার যিনি নুয়ের গোত্রের, তাদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। প্রেসিডেন্ট সালভা কির ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. রিয়েক মাচার এর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনেন। তাদের উভয়ের অনুগতদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এই রক্তক্ষয়ী, ভয়াবহ ও নৃশংস গোত্র সংঘাত। প্রতিবেশী দেশ উগান্ডা প্রেসিডেন্ট সালভা কিরের সমর্থনে তাদের সেনাবাহিনী পাঠায়। এই সংঘাতে ২১ জন উগান্ডান সৈনিক, ৫ জন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী সদস্যসহ ৩ লাখ সাউথ সুদানীজ মারা যায়। ১০ লাখ লোক ঘর-বাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে এবং ৪ লাখ লোক পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে পালিয়ে যায়। শুরু হয় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়।
২০১৫ সালের আগস্ট মাসে আন্তর্জাতিক চাপ ও মধ্যস্থতায় প্রতিবেশী দেশ ইথিওপিয়ার রাজধানী আদিস আবাবায় উভয়পক্ষের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই মধ্যস্থতায় আফ্রিকান ইউনিয়ন, জাতিসংঘ, চীন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও নরওয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের মার্চ মাসে ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. রিয়েক মাচার দেশে ফিরে আসেন শান্তির আশা জাগিয়ে। কিন্তু জুলাই ২০১৬ সালে আবার তার দেহরক্ষীবাহিনীর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট সালভা কিরের অনুগত বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। এতে ৩০০ লোকের প্রাণহানি হয়, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর ২ জন চীনা সৈন্যও এই সংঘাতে নিহত হয়। নতুনভাবে বহু লোক ঘর-বাড়ি হারায় এবং উদ্বাস্তু হয়ে যায়। ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. রিয়েক মাচার অনুসারীসহ দেশ থেকে পার্শ্ববর্তী দেশ কঙ্গোয় পালিয়ে যান। সেখান থেকে তিনি সুদান যান এবং প্রেসিডেন্ট সালভা কিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এমনই প্রেক্ষাপট সাউথ সুদানে যেখানে যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান। নেচে-গেয়ে স্কুলশিশুরা বন্দীদের বিনোদিত করছে। মহিলা কারারক্ষীদের সঙ্গে লেখক। বক্তৃতা পর্ব শেষে স্কুলের শিশুরা নেচে-গেয়ে বন্দীদের বিনোদিত করে। বন্দীরাও একটি নাটিকা পরিবেশন করে শান্তি ও ঐক্যবদ্ধ সাউথ সুদানের আকুতি জানিয়ে। মনে মনে আমিও কামনা করলাম শান্তি আসুক এই দেশে। লাখ লাখ মানুষের দুঃখ দুর্দশা লাঘব হোক।
লেখক: চড়ষরপব অফারংড়ৎ ধঃ টঘ গরংংরড়হ রহ ঝড়ঁঃয ঝঁফধহ(টঘগওঝঝ), ওহংঢ়বপঃড়ৎ ড়ভ ইধহমষধফবংয চড়ষরপব.
সম্পাদনা: আশিক রহমান