দুর্নীতির মূলোৎপাটন কেন জরুরি?
মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম
সমাজে ঘুষ-দুর্নীতির উপস্থিতি থাকবেই। তবে সমাজ ভেদে কম-বেশি হয়ে থাকে এই ব্যাধির প্রকোপ। যে সকল সমাজে মানুষ বানানোর প্রক্রিয়া যতবেশি কার্যকর সেসব সমাজে ঘুষ-দুর্নীতির হার হয়ে থাকে তত কম। আমাদের দেশে দুর্নীতি মহামারির মতো ভয়াবহ। এখানে দুর্নীতি ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করার বহুবিধ কারণ রয়েছে। তবে এর জন্য একটি বিশেষ ঐতিহাসিক বাস্তবতা বিশেষভাবে দায়ী। আর সেটা হলোÑ উপনিবেশিক সূত্রেপ্রাপ্ত শিক্ষাব্যবস্থা। ব্রিটিশরা এদেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা কায়েম করে গেছে সেই শিক্ষায় শিক্ষিতদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় অর্থবিত্ত অর্জন করা, ভোগ-বিলাসী জীবনের সন্ধান করা। জনগণের সেবা প্রদান করা নয়। উপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর কায়েমীস্বার্থ হাসিল করাই ছিল এদেশে শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের মূল উদ্দেশ্য। তাদের শাসনকার্য পরিচালনার প্রাথমিক এবং মূল লক্ষ্য ছিল খাজনা আদায় করা। তাদের গৃহীত এই নীতি বাস্তবায়ন করার জন্য তারা নিজ দেশ থেকে কর্মচারীদের এখানে উচ্চ পর্যায়ে নিয়োগ দিত। এদের খাজনা আদায়ের এই কাজে সহায়তাদানের জন্য তাদের শিক্ষায় শিক্ষিত নেটিভদের নিয়োগ দিত।
নিয়োজিতরা যে বেতন-ভাতাদি পেত তা ছিল ব্রিটিশদের নিজস্ব অর্থনীতির শক্তি-সামর্থ্যরে সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। নেটিভ শিক্ষিত চাকরিজীবীরা এই বেতন কাঠামোর অধীনে যে বেতন-ভাতাদি পেত তার পুরোটা স্থানীয় বাজারে খরচ হতো না। উদ্বৃত্ত অর্থ সঞ্চয় করে তারা নতুনরূপে তাদের ঘর-বাড়ি বানাতে পারত, জমি-জমা ক্রয় করতে পারত। ফলে অচিরেই তাদের পরিবারে ফিরে আসত সার্বিক সচ্ছলতা এবং ঘর-বাড়ি ও চলা-ফেরায় ফিরে আসত এক ধরনের আভিজাত্যের ভাব যা দৃশ্যতই ছিল আবহমান বাংলার দারিদ্র্যক্লিষ্টতার তুলনায় উন্নততর। পুরো গ্রাম এমনকি চারপাশের এলাকার গ্রামীণ জনপদের মানুষের কাছে এই পরিবর্তন চোখ ধাঁধানো মনে হতো। যারা শিক্ষা গ্রহণপূর্বক ডিগ্রি লাভ করত তাদের মনে করা হতো ভাগ্যের বরপুত্র। চারিদিকে ডাক পড়ে যেত। তাদের চলা-ফেরা, পোশাক-আশাক ইত্যাদিতে প্রদর্শিত আধুনিকতা ও চাকচিক্য জনগণকে যার পরনাই প্রলুব্ধ করত। এই ধারাতেই জাতে উঠার প্রবণতায় আকৃষ্ট হয়েই বাংলার মানুষ শিক্ষার প্রতি মনোযোগী হয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষা অর্জন বলতেই মূলত আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া মনে করে এদেশে শিক্ষাগ্রহণে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়। জ্ঞানার্জন কিংবা মানুষ হওয়া ইত্যাদি ছিল শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে কথার কথা মাত্র। যারা কিছুটা বয়ষ্ক বা যাদের গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে তারা আশা করি একটু খেয়াল করলে বিষয়টি অনুধাবন করবেন।
পাকিস্তান আমলে প্রায় একই ধারা বিদ্যমান থাকে। স্বাধীন বাংলাদেশেও আজ স্বাধীনতার পঁয়তাল্লিশ বছর পরও শিক্ষা বিষয়ে একই ধারার প্রণোদনা বজায় রয়েছে। এখন চাকরিজীবীদের বেতন কাঠামো নির্ধারিত হয়ে থাকে জাতীয় অর্থনীতির শক্তি সামর্থ্যরে উপর ভিত্তি করে। ফলে প্রাপ্ত বেতনাদি নিয়ে বাজারে গেলে তাতে সংসার চলে নাÑ সবার মুখে এক কথা। কারণ বেতন নিজ দেশের অর্থনীতিভিত্তিক হলেও এ বেতন নিয়ে যে বাজারে প্রবেশ করে তা স্বদেশ নিয়ন্ত্রিত নয়, বাজার চলে পশ্চিমা জগতের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণে। বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বজন-আত্মীয়ের প্রত্যাশা ছেলে শিক্ষিত হয়ে পরিবারের হাল ধরবে, সংসারের অসচ্ছলতা দূর করে সম্পদ অর্জন করে দিন ফিরাবে। ফলে শিক্ষিত এই যুবক পড়ে যায় সংকটের গ্যাঁড়াকলে। না পারে শহরে নিজ সংসার চালাতে, না পারে তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে থাকা পরিবারের দিকে তাকাতে। তাই সে হন্যে হয়ে ছুটে বাড়তি রোজগারের দিকে, উপরি পাওয়ার নেশায়। নীতিনৈতিকতা তার কাছে তুচ্ছ। যেভাবেই পারো অর্থ জোগাড় করো, নীতি-দুর্নীতির ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন তার কাছে নিতান্তই বাহুল্য। এইভাবে শিক্ষিতসমাজ যে আমলাতান্ত্রিক সংগঠনের সদস্য হয় তার অর্থ দাঁড়ায় ঘুষ-দুর্নীতির কায়েমিচক্রের সদস্য হওয়া। ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপার নয়, এটাই হয়ে দাঁড়ায় অমোঘ নিয়ম। সরকারি প্রতিষ্ঠানের এরূপ বাস্তবতার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বেসরকারি অফিস-আদালতসহ সর্বত্র। বাস্তব এই অবস্থার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা শিক্ষিতসমাজ অধ্যুষিত সামাজিক-রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরিত্রবল বলে কিছুই থাকে না। পুরো সমাজে তৈরি হয় দুর্নীতির অভয়ারণ্য।
ফলে জাতির চরিত্র গঠন ও নেতৃত্ব সৃষ্টিতে বড় বাধা রাষ্ট্রের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানটির গণবিরোধী চরিত্র। ‘গণসেবক’ না হয়ে ‘গণপীড়ক’ রূপে আবির্ভূত এই প্রতিষ্ঠানটির কায়েমিবাদিতা দুর্নীতি উৎপাদনের কারখানা হিসেবে কাজ করছে। ঘুষ-দুর্নীতি আজকে আর কোনো সামাজিক ব্যাধির পর্যায়ে নেই। আজ এটি হয়ে দাঁড়িয়েছে অলিখিত অভিনব এক অলংঘনীয় প্রথা। এর বিষাক্ত ছোবল সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনে বিস্তার লাভ করে এমনভাবে শেকড় গেড়ে আছে যে, শুভসৃষ্টির কোনো উদ্যোগ সমাজে মাথা তুলতে পারছে না। ঐতিহাসিক সূত্রে প্রাপ্ত এই অপধারা আজও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানটিতে অনবরত কায়েমি আমলাতান্ত্রিকতার বীজবপণ করে চলছে, সমাজে কলুষ ছড়াচ্ছেÑ যার প্রভাব মুক্ত হয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানাদি কোনোক্রমেই সৃষ্টিশীল শুভধারা অবলম্বন করে বিকশিত হতে পারছে না। রাষ্ট্রযন্ত্র ও এনজিও-সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলা হয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল আমলা সংগঠনসহ বিভিন্ন বিভাগ, উপ-বিভাগের দুর্নীতির হিসাব তুলে ধরে থাকে। তাদের উদ্দেশ্য দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা। কিন্তু বাস্তবে তাতে দুর্নীতির কোনো গতি হচ্ছে কি? দুর্নীতির বিষাক্ত থাবা কি সংকুচিত হচ্ছে? মনে হয় না এ প্রশ্নে জনমনে ইতিবাচক কোনো জবাব আছে। এখানে গেড়ে বসা পশ্চিমা ধারার শিক্ষাব্যবস্থাসহ সামগ্রিক ব্যবস্থায় দুর্নীতির বীজ লুকায়িত সেই ব্যবস্থাদি বহাল তবিয়তে বিদ্যমান রেখে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা কিংবা নির্মূল করার চেষ্টা বৃথা প-শ্রম ছাড়া কিছুই না। আমরা সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনে শুভবুদ্ধির উন্মেষ ঘটাতে চাই। সর্বগ্রাসী দুর্নীতির মূলোৎপাটন চাই। নতুনধারার সুস্থ রাজনীতি ও নেতৃত্ব গড়ে তুলতে চাই। আসুন নবধারার এই জাগরণী আন্দোলনে যোগ দিয়ে বাংলাদেশকে জাগিয়ে তুলি, জাতীয় চরিত্র গঠনে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করি।
লেখক: সাবেক এমপি ও আহ্বায়ক জাগরণী শান্তিসংঘ
সম্পাদনা: আশিক রহমান