ভাস্কর্য অপসারণের দাবি রাজনৈতিক
গোলাম মাওলা রনি
সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গন থেকে ভাস্কর্য অপসারণের যে দাবি তুলেছে হেফাজত, তা রাজনৈতিক। কারণ বিচারঙ্গনকে যদি ইসলামাইজেশন করতে হয় তাহলে তো শরিয়াহ্ আদালত লাগবে, শরিয়াহ বোর্ডও লাগবে। শরিয়াহ্্ আদালত যে দেশে প্রতিষ্ঠা করা হয়, সেখানে মুসলিম প্রজাতন্ত্র ছাড়া শরিয়াহ্ আদালত হবে না। এখন আমাদের বিচারালয় পরিচালিত হচ্ছে ল্যাটিন, রোমান এবং বৃটিশ আইনের ভিত্তিতে। ব্রিটিশরা দুইশ বছর আমাদের শাসন করেছিল।
এখন যারা হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দ, তাদের ওস্তাদের ওস্তাদ ছিলেন মাওলানা রশীদ আহমেদ গাঙ্গুরি। তার মতো লোক দেওবন্দের ছিলেন। অত্যন্ত কেতাদূরস্থ আলেম ছিলেন। এখনকার হেফাজত ইসলামের নেতারা কি দেখাতে পারবেনÑ ব্রিটিশ কোর্টের নিয়মনীতির বিরুদ্ধে মাওলানা রশীদ আহমেদ গাঙ্গুরি একটা বিবৃতি দিয়েছেন? তাদেরই তো নেতা ছিলেন তিনি। এখন যারা এখানে কাজ করছেন তারা সবাই দেওবন্দের ছাত্র। মাওলানা রশীদ আহমেদ গাঙ্গুরি সহ অনেকেই ছিলেন দেওবন্দেকর্তৃক বড় বড় আলেম ওলামা। তারা কিন্তু কখনোই ব্রিটিশ বিচারব্যবস্থা নিয়ে ওইভাবে কখনোই কথা বলেননি। কারণ এটা একটা ঐতিহ্য।
ছবি, ভাস্কর্য, মূর্তি যে ফর্মেই থাক না কেন, যা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা ইসলামে নিষিদ্ধ। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছেÑ শুধুমাত্র ভাস্কর্য সরিয়ে নিলেই কি কোর্টে ইসলামাইজেশন হয়ে যাবে? অবশ্যই না। এখন তারা যদি ইসলামাইজেশন করতে চান সেই আন্দোলনের সঙ্গে মূর্তি বা ভাস্কর্য অপসারনের আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই। সুপ্রিম কোর্টের প্রাঙ্গনে স্থাপিত ভাস্কর্য যদি মূর্তি হয় তাহলে অপরাজেয় বাংলাকে তারা কিভাবে মূল্যায়ন করবে? পাকিস্তান আমল থেকে সব জায়গাতেই তো লেখা ছিলÑ ‘রাব্বি জিদনি ইলমা অর্থ্যাৎ হে প্রভু আমাকে জ্ঞান দাও। সেখানে এখন ‘শিক্ষাই শক্তি’ চলে এসেছে। তা নিয়ে তো তারা কোনো কথাবার্তা বলছে না। ঢাকা শহরে অসংখ্য ভাস্কর্য রয়েছে। বিখ্যাত সব মানুষের ভাস্কর্য। সেসব বিষয়ে তাদের কোনো বক্তব্য নেই। এমনকি বঙ্গবন্ধুর মূর্তির সম্পর্কেও তাদের কোনো বক্তব্য নেই। ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর মূর্তিতে মাল্যদান করা হয়, সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত ভাস্কর্যে তো কেউ মাল্যদান করছে না। জিয়াউর রহমানের মাজারে গিয়েও মাল্যদান করা হচ্ছে। সবাই গিয়ে ফুলের মালা দিয়ে আসছে। অযু, গোসল, পবিত্রতা অর্জন ছাড়াই কবরের কাছে গিয়ে জোরে জোরে সেøাগান দিচ্ছে। ফুল দিচ্ছে। কোথায় এ বিষয়গুলোতে কোনো কথা তারা বলছে না। এটা কি তাদের দ্বিমুখীতা নয়?
২০১৩ সালে হেফাজতের হঠাৎ উত্থান হলো। গণজাগরণ মঞ্চও খুব জনপ্রিয়তা পেল। কিন্তু এখনকার প্রেক্ষাপটে হেফাজত এবং গণজাগরণ মঞ্চের সেই মার্কেট আর নেই। ফলে যেকোনো একটা ইস্যুতে আওয়াজ দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চায় তারা। দেশের বেশিরভাগ মুসলমান ধর্মের প্রতি প্রচ- অনুভূতিপ্রবণ। সেই মানুষগুলোর ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে হেফাজত নিজেদের অবস্থানটা জানান দিতে চায়। ভাস্কর্য নিয়ে বড় কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে বলে মনে হয় না। এটা হলো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য একটা পলিটিক্স। নিজেদের অবস্থান জানান দেওয়ার জন্যই এ বিষযটাকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করছে তারা। হেফাজতকে হয়তো দমন করা গেছে, কিন্তু সত্যিকারার্থে তারা এখন এখানে একটা পাওয়ার ফ্যাক্টর। কারণ তাদের ৪০ লাখ ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। যারা অন্ধভাবে হেফাজতের নেতৃবৃন্দকে বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা করে। এই ৪০ লাখ মানুষের সমর্থনকে ছোট করে দেখার কোনো উপায় নেই। এই ৪০ লাখ শিক্ষার্থীর পরিবারও হেফাজতকে কোনো না কোনোভাবে সমর্থন করে, তাদের কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত। এক থেকে দেড় কোটি লোক সরাসরি হেফাজতের সঙ্গে প্রতিবাদ গড়ে তুলবে। হেফাজতের এই পাওয়ার বাংলাদেশের জন্য খুবই বিপজ্জনক।
দেশের সুশীল সমাজের প্রধান দায়িত্ব হলো হেফাজত কর্মী-সমর্থকদের দূরে না রেখে কাছে নিয়ে আসা। বসে তাদের যত কথা, দাবি-দাওয়া রয়েছে তা শোনা। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে নামাজ-কালাম পড়ে এমন কেউ কথা বললে, বোঝালে তা শোনার সম্ভাবনা রয়েছে। যতদিন পর্যন্ত দেশের অসাম্প্রদায়িক বুদ্ধিজীবী মহল এবং সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো এক টেবিলে বসতে না পারবে ততদিন পর্যন্ত একটা উন্নয়নশীল, প্রগতি ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠন করা খুবই কঠিন হবে। দুই পক্ষকেই গোড়ামি ত্যাগ করতে হবে। এই দেশটা শুধু আমাদেরই নয়, তাদেরও। তারা যেমন এই দেশের নাগরিক, শাহরিয়ার কবিররাও এদেশেরই সন্তান। কেউ যেন তাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য না করি। তাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য বা কাফের বলা যাবে না। কারণ এতে তারা বিক্ষুব্ধ হয়। তাতে অসন্তোষ বাড়ে। বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি সম্ভাবনা প্রবল হয়। তাই কিভাবে তাদের ভুল সংশোধন করে মূল জায়গায় নিয়ে আসা যায় তা নিয়েই সবাইকে কাজ করতে হবে।
পরিচিতি: সাবেক সাংসদ, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
অনুলিখন: সাগর গনি/সম্পাদনা: আশিক রহমান