রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারকে অ্যামনেস্টির আহ্বান
এম রবিউল্লাহ ও কামরুল আহসান: জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান ৯ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্তকারী দল নিয়ে গত নভেম্বর মাসে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ পরিদর্শনে যান। এর মধ্যে ৬ জনই মিয়ানমারের। রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তাকর্মীদের যৌথ নির্যাতন দেখে তিনি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে কফি আনান সহিংসতায় রাখাইন রাজ্যে পুনরায় অস্থিরতা বিরাজ করছে বলে জানান। নতুন করে গৃহহীন হওয়ার ঘটনা ঘটছে। সব সম্প্রদায়েরই উচিত সহিংসতা পরিত্যাগ করা। আমি নিরাপত্তা বিভাগকে আইনের শাসনের প্রতি আনুগত্যশীল থেকে পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ করছি। এখন সময় হয়েছে শরণার্থী শিবির থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে আনার। আর সেই সাথে তাদের নাগরিকত্বের বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেবার। কফিন আনানের নেতৃত্বাধীন কমিশন ১৬ মার্চ একটি বিশেষ তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেখানে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমার সরকারকে জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়। তার এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে শুক্রবার ১৭ মার্চ এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক চম্পা প্যাটেলও সমর্থন জানান। আনান কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশের পর এক প্রতিক্রিয়ায় চম্পা এ আহ্বান জানান।
চম্পা বলেন, অবশ্যই মিয়ানমার সরকারকে এ সমস্যা সমাধানে জরুরী ব্যবস্থা নিতে হবে। এটাকে তিনি চরম মানাবধিকার লঙ্ঘন। প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করতে হবে। কোনো অবহেলা ছাড় দেওয়া হবে না।’ চম্পা প্যাটেল বলেছেন, মিয়ানমার সরকার প্রতিবারই সুষ্ঠু তদন্তে ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসংঘের উচিত মিয়ানমার সরকারের উপর আরো কঠিন চাপ প্রয়োগ করা। এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশলের গত ডিসেম্বরের প্রতিবেদনে এসব উঠে এসেছে। জাতিসংঘের বর্তমান প্রতিনিধিদলও তার প্রমাণ পেয়েছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান ইয়াঘি লি গত ১৯ ফেব্রুয়ারিও রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনিও নির্যাতন বন্ধে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধ করতে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী অবশ্য শুরু থেকেই সুষ্ঠু তদন্তে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আসছে। তারা রোহিঙ্গাদের ঢালাওভাবে ইসলামী জঙ্গি সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করছে। রাখাইন প্রদেশ থেকে তাদের তাড়াতে গণহত্যা চলছে। চলছে গণধর্ষণ। দেশ ছেড়ে পালিয়ে তারা আশ্রয় নিচ্ছে বাংলাদেশে। এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে অতিদ্রুত তদন্ত দল পাঠানোর বিষয়ে জাতিসংঘকে আহ্বান জানিয়েছে।
মিয়ানমারে মানবতাবিরোধী অপরাধ হচ্ছে বলে এর আগে জাতিসংঘের যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, তার ভিত্তিকে আরো কঠোরভাবে এই পরামর্শ দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে ওই খসড়া প্রস্তাবটি দেওয়া হয়েছে। ২৩ মার্চ ওই প্রস্তাবের উপর ভোটাভুটি হতে পারে। আনান কমিশন নামে পরিচিত এই কমিশন রাখাইন রাজ্যের দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা দূর করতে কিছু সুপারিশ করেছে। তাতে জোর দেওয়া হয়েছে, উপদ্রুত এলাকায় সাংবাদিক এবং ত্রাণকর্মীদের যাতে অবাধে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় সে বিষয়ে। রোহিঙ্গাসহ রাখাইন রাজ্যের সব জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব নিশ্চিতে দেশটির সরকারের কাছে একটি সমন্বিত ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবও রাখা হয় রিপোর্টে। দেশটিতে ১ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা সাময়িক আশ্রয় কেন্দ্রে রয়েছে। তাদেরও বাড়িতে ফেরত পাঠিয়ে এসব ক্যাম্প বন্ধের সুপারিশ করেছে কমিশন।
জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন বিশেষ কমিশন যখন তাদের অন্তর্র্বর্তীকালীন রিপোর্টটি প্রকাশ করেছেন তখনও কয়েক লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান শরণার্থী হিসেবে অবস্থান করছে বাংলাদেশে।
মিয়ানমারের পররাষ্ট্র দফতরের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আই আই সোয়ে বলেছেন, মিয়ানমান সরকার আনান কমিশনের প্রতিবেদনটি দেখেছে এবং দ্রুত এ বিষয়ে জবাব দেবে। মিয়ানমারের নেত্রী অং সাং সু চি বেশিরভাগ সুপারিশই বাস্তবায়নের পথে বলে জানিয়েছে। ২০১২ সালে প্রথম বৌদ্ধদের সাথে সংহিসতায় সংখ্যালঘু বহু মুসলিম রোহিঙ্গা নিহত এবং ঘরছাড়া হয়। এরপর ২০১৫ সালের অক্টোবরে ৯ বর্ডার গার্ড পুলিশ নিহতের ঘটনায় রোহিঙ্গাদের ওপর দমন নিপীড়ন চালায় দেশটির সরকারি বাহিনী।
বাংলাদেশের সীমান্তের লাগোয়া রাখাইনের সব জনগোষ্ঠীর অবস্থা, সেখানকার সহিংসতা, বাস্তচ্যুতি এবং উন্নয়নে পিছিয়ে থাকার কারণ খুঁজে নিয়ে তা বিশ্লেষণের জন্য মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলের অং সাং সু চি ওই কমিশন গঠন করেন। আগস্টের শেষে কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার কথা রয়েছে। এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন ও বিবিসি অবলম্বনে