বাংলাদেশের কবিতা ও রাজনৈতিক চেতনায় ৭ মার্চ
মিল্টন বিশ্বাস
যে যেখানেই থেকে থাকো, যে অবস্থায় থাকো, হাতে যার যা আছে, তাই দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবে, যতদিন পর্যন্ত না দখলদার পাকিস্তানিদের শেষ সৈনিকটি বাংলাদেশের মাটি থেকে বহিষ্কৃত হচ্ছে এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হচ্ছে।’ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণেই তিনি স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। ২৫ মার্চ বললেন, ‘বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ’। বঙ্গবন্ধু ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা থেকে শুরু করে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পূর্বদিন পর্যন্ত দেশের গণমানুষের উন্নয়নের কথা বলেছেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে ছিল তার রাষ্ট্রনীতি। তিনি সবসময় শোষিতের মুক্তিকামনা করেছেন। আজীবন সংগ্রামে যেমন তিনি অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি; তেমনি স্বাধীন দেশের সমাজকে সব অপশক্তির কবল থেকে মুক্ত করার জন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিল তার বলিষ্ঠ ভূমিকা। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা এবং ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের ৬ দফা কর্মসূচিতেও শোষণের বিরুদ্ধে অবস্থান ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির কথা বলেন। তিনি দীপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেন, ‘আওয়ামী লীগের মাথা কেনার মতো ক্ষমতা পুঁজিপতিদের নেই।’ সদ্য স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালে ১৬ জানুয়ারি তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু ব্যবসায়ী জিনিসপত্রের দাম বাড়াবার চেষ্টা করছে।’ এসব মুনাফাখোর কালোবাজারীদের কঠোর ভাষায় হুঁশিয়ারি করে দেন তিনি। এ সময় তিনি শোষণহীন সমাজ গড়ার জন্য ধৈর্য ধরে কাজ করার কথাও বারবার উল্লেখ করেন। অন্যদিকে সাতচল্লিশের দেশভাগের আগেই শেখ মুজিবুর রহমান অসাম্প্রদায়িক চেতনায় স্নাত হন। তিনি তার আত্মজীবনী লেখার ডিকটেশন দেওয়ার সময় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে বলেছিলেন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন থেকে ফজলুল হক, ফজলুল হক থেকে সুভাষচন্দ্র, সুভাষচন্দ্র থেকে আবুল হাশিম-শরৎচন্দ্র (সুভাষ বসুর ভাই) এবং দেশ ভাগের পর ভাষা আন্দোলন ও ছয়দফা পর্যন্ত যদি বাংলার রাজনীতির গতিধারা বিশ্লেষণ করো, তাহলে দেখবে অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন বাংলার সুপ্ত চেতনার জন্ম সাতচল্লিশের বাংলাভাগের আগেই এবং সেই চেতনারই প্রথম বহিঃপ্রকাশ আটচল্লিশ সালেই অসাম্প্রদায়িক ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে। আর ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এভাবে ঐতিহাসিক কালানুক্রমিক ঘটনাধারা মনে রাখলে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্ব সহজেই অনুধাবন করা সম্ভব। একাত্তরের ১৩ মার্চে কূটনৈতিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কিসিঞ্জার মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে এক স্মারকে জানিয়েছিলেন, ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দান থেকে নিবৃত্ত থাকাটা দৃশ্যত কৌশলগত। আর এই স্মারকেই কিসিঞ্জার বঙ্গবন্ধুর প্রতি একটা গভীর শ্রদ্ধাপূর্ণ মন্তব্য করেন। শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে তার নেতিবাচক মন্তব্যগুলো অনেক বেশি প্রচার পেয়েছে কিন্তু যেটি পায়নি সেটি হলো কিসিঞ্জার নিজেই নিক্সনকে বলেছিলেন, শেখ মুজিব যেভাবে গান্ধীর মতো অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পরিচালনা করছেন, তাতে সেখানে দমন-পীড়ন চালানোর যথার্থতা দেওয়া কঠিন। কিসিঞ্জারের নিজের ভাষায়, …রহমান হ্যাজ এমবার্কড অন এ গান্ধিয়ান টাইপ নন-ভায়োলেন্ট নন-কো-অপারেশন ক্যাম্পেইন হুইচ মেকস ইট হার্ডার টু জাস্টিফাই রিপ্রেশন। ১-৭ মার্চ-বিষয়ক নথির একটি পৃষ্ঠা ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে কিসিঞ্জারের ঘনিষ্ঠ সহকারী জোসেফ সিসকো ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে ‘সব ইঙ্গিত স্পষ্ট করেছে যে ৭ মার্চে শেখ মুজিবুর রহমান তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবেন এবং সম্ভবত সেটা হবে স্বাধীনতার সমতুল্য।’ আগামী প্রজন্ম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক ইতিহাসের পটভূমিতে বঙ্গবন্ধু ও তার ৭ মার্চের ভাষণে উল্লেখিত স্বাধীনতার তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারবে বলে আমাদের বিশ্বাস। কারণ পৃথিবীর কোথাও এ রকম ভাষণ শোনা যায়নি এখনো। (শেষ)
লেখক: অধ্যাপক এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান