ভারসাম্যমূলক প্রতিরক্ষানীতি ও দুটি ডুবোজাহাজ
হাবিবুর রহমান তাপস
‘খাল কেটে কুমির আনা’Ñ এই চিরায়ত বাংলার প্রবাদ বচনটি যথার্থ স্বার্থকতা পেল যখন মুঘল সম্রাট শাজাহানের কন্যা দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে জনৈক ইংরেজ চিকিৎসকের সুচিকিৎসায় আরোগ্য লাভ করলে সম্রাট খুশি হয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। তার কাছে জানতে চাইলেন, তার এই অসামান্য কাজের বিনিময়ে তিনি কি চান? এর জবাবে চিকিৎসক জানালেন, ব্যক্তিগতভাবে তার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। তবে তার যদি মর্জি হয়, তিনি যদি ইংরেজদের এদেশে ব্যবসা করার সুযোগ দেন, তাতেই তিনি সন্তুষ্ট হবেন। এরপর সম্রাট শাজাহান ১৬৫১ সালে ইংরেজদের বার্ষিক মাত্র ৩ হাজার টাকার বিনিময়ে বাংলায় বাণিজ্য করার সুযোগ দেন। কেউ না বুঝুকÑ বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা বুঝেছিলেন ইংরেজদের প্রকৃত উদ্দেশ্যের কথা। তাই তো ইংরেজ অ্যাডমিরাল যখন ‘কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম’ দুর্গে নিজেদের নিরাপত্তার কথা বলে কামান স্থাপন করলেন তখন নবাব সিরাজউদ্দৌলা নিজে ছুটে এসেছিলেন কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ দখল করে ইংরেজদের ষড়যন্ত্রের সমুচিত জবাব দিতে। ইংরেজরা জানত, এদেশিয় শাসকদের দুর্বলতা। তাই তো নবাব আসার আগেই সদলবলে পালিয়ে নৌপথে সমুদ্রে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। কারণ তারা জানত নৌ শক্তিতে এ দেশিয় শাসকদের সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতার কথা। তাই নিশ্চিন্তে সেখানে অবস্থান করতে লাগল। এই চতুর ইংরেজরাই একসময় নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের শাসন ভার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। তুর্কি, মুঘল, পাঠানÑ যাদের কথাই বলি না কেন, যুগে যুগে তারা সবাই ভারতীয় উপমহাদেশ আক্রমণ পরিচালনা করেছিল উত্তর দিক থেকে খাইবারপাসের দিয়ে। আর তাই এ দেশিয় শাসকগণ সবসময় শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে স্থলপথেই পাহারার ব্যবস্থা করত। সুচতুর ইংরেজরা সেই চিরায়ত স্থলপথে না এসে নৌপথে আক্রমণ করে করে আমাদের দুইশ বছর শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রেখেছিল।
তখন থেকেই পশ্চিমা বিশ্বের ধারণাÑ ভারতের উল্লেখযোগ্য কোনো রণনীতি সংস্কৃতি নেই। যা আছে তা সেনাবাহিনীভিত্তিক। কথিত আছে, ভারতের শত্রু সম্পর্কে আশংকা, ‘এক চোখা হরিণের গল্পের মতো’Ñ যে হরিণের একটি চোখ সচল, বাকিটা নষ্ট। সে নদীর পার্শ্বে নষ্ট চোখ রেখে ভালো চোখটি দিয়ে স্থলের দিকে সতর্ক নজর রেখে ঘাস খেতে খেতে ভাবে একপাশে তো নদী আছে তাই এদিক থেকে কেউ আমাকে আক্রমণ করতে পারবে না। তাই ভালো চোখটি দিয়ে স্থল প্রান্তে শত্রুর দিকে নজর রাখি। একদিন দেখা গেল নদী পথে নৌকায় করে শিকারি এসে গুলি করে হরিণটিকে শিকারে পরিণত করল। তেমনি প্রতিরক্ষাবাহিনীকে সবদিক থেকে চৌকস না করলে শত্রু আমাদের দুর্বল জায়গা দিয়ে আক্রমণ করবে। বর্তমান পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতিতে চিরস্থায়ী শত্রু-মিত্র দেশ বলে কোনো কথা নেই। আজ যে বন্ধু দেশ নিজ স্বার্থে আঘাত পেলেই সে শত্রুতে পরিণত হচ্ছে। যদিও আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’ আমাদের প্রধানমন্ত্রী এ সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমাদের উপর হামলা হলে তার সমুচিত জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।’ ক্ষমতা গ্রহণ করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুরু থেকেই একটি আধুনিক সুসজ্জিত প্রতিরক্ষাবাহিনী গঠনে মনোনিবেশ করেন। সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনীর পাশাপাশি তিনি আমাদের একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠনের ওয়াদা করেন। চলতি মাসে তিনি নৌবাহিনীর জন্য চীনের তৈরি দুইটি সাবমেরিন ক্রয় করে এর উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশ নৌবাহিনী এখন ত্রিমাত্রিক বাহিনী। অর্থাৎ নৌবাহিনী সমুদ্রের উপরে, নিচে ও আকাশ পথে দেশের শত্রুকে মোকাবিলা করতে পারবে। যারা চোখের জলের ভিতরেও কুমির খোঁজেন তাদের অনুরোধÑ থামুন! নিজ চরকায় তেল দিন। দেশের নিরাপত্তার কথা আমাদেরই ভাবতে দিন। যারা যুক্তি দিচ্ছেনÑ ডুবোজাহাজ তো শুধু আক্রমণাত্মক অপারেশনে ব্যবহৃত হয়। বলছেন, বাংলাদেশ যদি শান্তিকামী দেশ হয় আর এর প্রতিরক্ষা বাহিনী যদি আত্মরক্ষার কাজে ব্যবহৃত হয় তবে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ডুবোজাহাজের কী প্রয়োজন? উত্তর হচ্ছেÑ আত্মরক্ষা মানে শুধু ট্রেঞ্চে বসে থেকে গুলি ছুঁড়ে আক্রমণ প্রতিহত করা নয়; প্রয়োজনে আক্রমণ বা পাল্টা আক্রমণ করতে হয়। সার্বিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় কখনো আক্রমণাত্মক অপারেশনেরও যে প্রয়োজন রয়েছে তা সর্বস্বীকৃত। এছাড়া ডুবোজাহাজের ভূমিকা যে শুধু আক্রমণাত্মক এ ধারণাও সঠিক নয়। ডুবোজাহাজের দ্বারা গোপনে পর্যবেক্ষণ কাজ, স্পেশাল ফোর্সেস এর অপারেশনে সহায়তা প্রদান ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের কাজে লাগে।
আধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাসমূহ ডিটারেন্স থিওরি বা ‘নিবারণ তত্ত্ব’ নির্ভর। যেকোনো দেশ তার শত্রু আক্রমণের পূর্বে একটি লাভ-ক্ষতির হিসাব করে থাকে। যদি দেখা যায় যে, শত্রুকে আক্রমণ করলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি তাহলে সে আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকাই শ্রেয় মনে করে। এই হিসাবকে কেন্দ্র করে প্রতিরক্ষাবাহিনীকে সংগঠিত করা হয়। যেন আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য বজায় থাকে। বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জার মূলেও রয়েছে এই ‘নিবারণ তত্ত্ব’। আণবিক অস্ত্রসমূহ যুদ্ধের ব্যবহারের অস্ত্র নয়। এইগুলো আসলে যুদ্ধ নিবারণের অস্ত্র।
দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের নৌ ঘাঁটি নির্মাণে এই অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাই সে তার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে এখানে নৌ ঘাঁটি স্থাপন করেছে। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের স্বার্থ আন্তর্জাতিক আদালতকর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ভৌগোলিক দিক থেকে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় থাকায় আমেরিকা, চীন, ভারত, রাশিয়া সবাই চাচ্ছে বাংলাদেশকে সামরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে। তাছাড়া বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সেতু বলে মনে করে যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়াও ভারতের পূর্বাঞ্চলকে ভারতের একীভূত ধরে রাখতেও বাংলাদেশকে তার প্রয়োজন আছে।
ডুবোজাহাজ কেনা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক শক্তির বহিঃপ্রকাশও বটে। ৪৬ বছরে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সার্বিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ এখন বেশ শক্তিশালী। জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশের সামরিকবাহিনী ব্যাপক প্রশংসা পাচ্ছে। সামরিক শক্তির ভিত্তিতে ‘গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার’ বা ‘জিএফপি’ নামের একটি ওয়েবসাইট মার্কিন গোয়েন্দা দফতর সিআইএ-এর প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। সেখানে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৫৩তম এবং দক্ষিণ এশিয়ার চতুর্থ সামরিক শক্তিধর হলেও ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি, সমরনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। জাতির জনকের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিশ্বমঞ্চে লাল সবুজের পতাকা উড়বে তার আপন শক্তিতে। তার দূরদৃষ্টিতে ভারসাম্যপূর্ণ শক্তিশালী প্রতিরক্ষানীতি গ্রহণ করে শুধু এশিয়া নয়, বিশ্ব নেতৃত্বের সমীহ আদায় করে নেবে বাংলাদেশ।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান