কার দুর্নীতি কে রোধ করবে?
ইকতেদার আহমেদ
লেখক: সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
দেশে যে হারে দুর্নীতির বিস্তৃতি ঘটছে তাতে রাষ্ট্রযন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিসহ দেশের সচেতন জনমানুষের অনেকেই উৎকণ্ঠিত। সরকারের প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ নির্বাহী। একজন মন্ত্রী একটি মন্ত্রণালয়ের কৃতিত্বে যেমন ভাগীদার অনুরূপ দুর্নীতিরও ভাগীদার। এ কথাটি অনস্বীকার্য যে, যেকোনো মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী নিজে দুর্নীতিমুক্ত হলে এবং মন্ত্রণালয়স্থ ও তদঅধীনস্থ বিভাগের অপরাপরের দুর্নীতির ব্যাপারে কঠোর হলে উক্ত মন্ত্রণালয় ও তদঅধীনস্থ বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কাছ হতে দেশের সাধারণ জনমানুষ দুর্নীতিমুক্ত সেবা লাভ করবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো বর্তমানে বাংলাদেশে এমন কোনো মন্ত্রণালয় বা তদঅধীনস্থ বিভাগ নেই যেখান হতে দেশের সাধারণ জনমানুষের প্রাপ্তিযোগ ব্যতীত সেবা লাভের সুযোগ ঘটছে।
বর্তমান রাষ্ট্রপতি দেশের সাধারণ মানুষের মধ্য হতেই উঠে এসেছেন। তিনি আইন পেশায় নিয়োজিত এবং রাজনীতিতে সক্রিয় থাকাকালীন বিভিন্ন মামলা ও ঘটনা সংশ্লেষে সরকারের কোন মন্ত্রণালয় এবং কোন বিভাগে কিভাবে দুর্নীতি হচ্ছে সেসব বিষয়ে তার সম্যক ধারণা লাভের সুযোগ ঘটেছে। তিনি তার নির্বাচনি এলাকা থেকে সর্বোচ্চ সাতবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় তিনি যে সাধারণ জনমানুষের অতি পছন্দের ও কাছের এ সত্যটি প্রতিষ্ঠা পায়। বর্তমানে তিনি রাষ্ট্রপতি হওয়ার কারণে তার সংসদ সদস্য পদ না থাকলেও তিনি একটু সময় ও সুযোগ পেলেই নিজ এলাকায় জনমানুষের কাছে ছুটে যান। জনমানুষের নেতা হিসেবে জনমানুষ সরকারের বিভিন্ন কার্যালয়ে সেবা গ্রহণে কিভাবে দুর্ভোগ ও হয়রানিসহ বাধ্য হয়ে অর্থ প্রদান সত্ত্বেও কাক্সিক্ষত প্রতিকার প্রাপ্তিতে ব্যর্থ হচ্ছেন তা তার নিকট অজানা নয়। এরই বহিঃপ্রকাশে দেখা গেল সম্প্রতি তার নিজ নির্বাচনি এলাকায় সফরে গেলে জনমানুষের উদ্দেশে বক্তব্য প্রদানকালীন তিনি তার স্বভাবসুলভ সরল অভিব্যক্তিতে বলেন, মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা দুর্নীতি না করলে তাদের অধীনস্থ সরকারি কর্মচারীরা দুর্নীতি করার সাহস পাবে না। সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় ইতোপূর্বে বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকাকালীন মন্ত্রীদের দুর্নীতি বিষয়ে খোলামেলা এ ধরনের উক্তি করেছেন এমনটি শোনা ও জানা যায়নি।
দুর্নীতির মাত্রা পরিমাপের দুটি পদ্ধতি রয়েছে। এর একটি হলো একটি বিভাগের সাকুল্য কর্মচারীর কত সংখ্যক দুর্নীতিগ্রস্ত সে হারে সে বিভাগের কর্মচারীদের দুর্নীতির মাত্রা নিরূপণ করা হয়। আর অপরটি হলো একটি বিভাগের সাকুল্য কর্মচারী এক বছরে বেতন ও ভাতাবাবদ রাষ্ট্রীয় কোষাগার হতে যে পরিমাণ অর্থপ্রাপ্ত হয় তাদের দুর্নীতিলব্ধ প্রাপ্তি তার সমান নাকি তার চেয়ে এক বা এর অধিকগুণ বেশি। সরকারের যেকোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগে কর্মরতদের দুর্নীতি বিষয়ে দ্বিতীয় পদ্ধতিটির মাধ্যমে পরিমাপ করা হলে এমন কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগ পাওয়া যাবে না যেখানে দুর্নীতি শতভাগ নয়।
বাংলাদেশ জন্মলগ্ন হতেই একটি সম্ভাবনাময় দেশ ছিল। কিন্তু দুর্নীতির কারণে আমরা সে সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারিনি। আজ দুর্নীতির কারণে আমাদের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি যেমন ব্যহত একইভাবে অনেকের মধ্য হতে সততা, নীতিনৈতিকতা ও মূল্যবোধ নির্বাসিত। বর্তমানে আমাদের যে প্রবৃদ্ধি রয়েছে তা দুই অঙ্কের নিচে। এ কথাটি নির্দ্বিধায় বলা যায় দুর্নীতি না থাকলে প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্ক ছাড়িয়ে যেত। সমাজের উপর স্তরের ব্যক্তিদের এক বড় অংশ দুর্নীতির মাধ্যমে যে পরিমাণ অর্থ আহরণ করছেন এর উল্লেখযোগ্য অংশ তারা বিদেশে পাচার করে তথায় পরিবারসমেত সুখের নীড় গড়ায় ব্যস্ত রয়েছেন। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনট্রিগ্রিটির তথ্যমতে, গত দেড় দশকে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫ লাখ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। এ অর্থ পাচারের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত তারা সবাই দেশ ও সমাজের উপর স্তরের মানুষ। পাচারকৃত এই অর্থ দেশে বিনিয়োগ করা গেলে বহু পূর্বেই বাংলাদেশের চেহারার পরিবর্তন ঘটে বাংলাদেশ হতো এশিয়ার অন্যতম উন্নত ও সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র। বর্তমান সরকার প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের আশার বিপরীতে তাদের বেতন ও ভাতা অষ্টম বেতন স্কেলের মাধ্যমে যেভাবে বৃদ্ধি করেছেন এর ফলশ্রুতিতে দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল তা দুর্নীতি সম্পূর্ণ নির্মূলে সহায়ক না হলেও প্রত্যাশিত মাত্রায় এটিকে কমিয়ে আনবে। কিন্তু বৃদ্ধি পরবর্তী দেখা গেল এ দেশের জনমানুষ আশাহত হয়েছে এবং দুর্নীতির মাত্রার এতটুকুও হ্রাস ঘটেনি বরং ক্ষেত্রবিশেষে বৃদ্ধি ঘটেছে।
আমাদের অর্থমন্ত্রী অশিতিপর। স্বভাবসুলভ সরলতার কারণে তিনি অনেক সময় সত্য কথাটি বলতে দ্বিধা করেন না। একদা আমাদের অর্থমন্ত্রীকে বলতে শোনা গেল, আমরা অনেক বিষয়ে সফল হলেও দুর্নীতিরোধে সফলতা পাইনি। দুর্নীতিরোধে সফলতা না পেলে আমাদের পক্ষে কখনো প্রত্যাশিত পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব নয়। দুর্নীতিরোধ করতে হলে মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিবসহ ঊর্ধ্বতন পদে কর্মরতদের অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। এ বিষয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও তদঅধীনস্থ বিভাগের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে আমরা যে চিত্র পাই তা হতাশাব্যঞ্জক। যেকোনো মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদে আসীন ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত নিজেকে দুর্নীতিমুক্ত করতে না পারবেন ততক্ষণ পর্যন্ত তার পক্ষে অধীনস্থদের দুর্নীতিমুক্ত থাকার উপদেশ বাণী বর্ষণ অরণ্যে রোদনসম।
দুর্নীতি দমনের জন্য দেশে সরকারিভাবে যে সংস্থাটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এটি হলো দুর্নীতি দমন কমিশন, যাকে সংক্ষেপে বলা হয় দুদক। দুর্নীতি বিষয়ে অভিযোগ প্রাপ্ত হলে দুদক তার অধীনস্থ কর্মকর্তা দ্বারা তদন্তের ব্যবস্থা করে। তদন্তে বস্তুনিষ্ঠতা পাওয়া গেলে এজাহার দায়ের করা হয় এবং এজাহার দায়ের পরবর্তী পূর্ণাঙ্গ তদন্তের মাধ্যমে অভিযোগপত্র দায়ের করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, এজাহারে উল্লেখিত আসামির সংখ্যার চেয়ে অভিযোগপত্রে উল্লেখিত আসামির সংখ্যা অনেক অধিক। ভুক্তভোগী অনেকে যারা চূড়ান্ত বিচারে আদালতের মাধ্যমে খালাসপ্রাপ্ত হয়েছেন তাদের থেকে জানা যায়, এজাহার দায়ের পরবর্তী তদন্তকালীন তদন্তকারী কর্মকর্তাকে কাক্সিক্ষত পরিমাণ অর্থ দ্বারা সন্তুষ্ট করতে না পারার কারণেই অভিযোগপত্রে আসামি হিসেবে তার নামের অন্তর্ভুক্তি এবং অযথা ভোগান্তি।
দুদকের মামলা দালিলিক সাক্ষ্য নির্ভর হওয়ায় চূড়ান্ত বিচারে এসব মামলা হতে বেকসুর খালাস পাওয়া সম্ভাবনার বিপরীত হলেও প্রায়শই দেখা যায় বেকসুর খালাসের ঘটনা ঘটছে। প্রণিধানযোগ্য যে, ফৌজদারি মামলার প্রাণ হলো তদন্ত। তদন্ত সঠিক হলে এবং আদালতে উপস্থাপিত সাক্ষীরা সঠিকভাবে ঘটনার বর্ণনা দিতে পারলে সে মামলা আসামিদের বিরুদ্ধে সকল সন্দেহের ঊর্ধ্বে প্রমাণ না হওয়ার কোনো সঙ্গত কারণ নেই। দুদক কর্তৃক দায়েরকৃত মামলার সংখ্যানুপাতে সাজার হার খুবই কম এবং যেসব মামলায় এজাহার দায়ের পরবর্তী তদন্তকালীন এজাহারে উল্লেখিত নয় এমন ব্যক্তির আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্তি ঘটে তাদের বড় অংশের ক্ষেত্রেই খালাসের ঘটনা প্রত্যক্ষ করা যায়। দুদকের মামলায় অধিকহারে সাজা নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই তদন্তকারী কর্মকর্তাদের ন্যায়নিষ্ঠভাবে তদন্তকার্য পরিচালনা করতে হবে এবং এজাহার দায়ের পরবর্তী শুধুমাত্র অন্যায়ভাবে প্রত্যাশিত প্রাপ্তির আকাক্সক্ষা চরিতার্থ না হওয়ার কারণে নিরপরাধ ব্যক্তিকে অপরাধী হিসেবে অন্তর্ভুক্তি সম্পূর্ণরূপে পরিহার করতে হবে।
সম্প্রতি দুদকের চেয়ারম্যানকে আক্ষেপ করে বলতে শোনা গেছে, দুদকের মামলা দালিলিক সাক্ষ্য নির্ভর হওয়ায় শতভাগ ক্ষেত্রে সাজা হওয়ার কারণ থাকলেও তা হচ্ছে না। কি কারণে এবং কেন হচ্ছে না এটির কারণ উদ্ভাবনের দায়িত্ব সংস্থার প্রধান হিসেবে দুদক চেয়ারম্যানের। মামলা প্রমাণে ব্যর্থতার দায় যে ত্রুটিপূর্ণ তদন্তের মধ্যে নিহিত অন্তত এ সত্যটুকু উপলব্ধি করতে পারলে আশা করা যায় মামলা প্রমাণ না হওয়া বিষয়ে তিনি যে আক্ষেপ করেছেন তার অবসানের পথ অনেকটা প্রশস্ত হবে।
বর্তমানে দুর্নীতি সামাজিক ব্যাধির রূপ নিয়েছে। দুর্নীতির কারণে আজ সরকারের অধিকাংশ মন্ত্রণালয় ও তদঅধীনস্থ বিভাগের শৃঙ্খলা ব্যাপকাংশে বিনষ্ট। এ বিনষ্ট শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করে প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত দেখতে চাইলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন রাষ্ট্রপতির কথার অনুসরণে মন্ত্রীদের দুর্নীতি থেকে মুক্ত থাকা। মন্ত্রী যখন দুর্নীতি থেকে মুক্ত থাকবেন তখন কার দুর্নীতিকে রোধ করবে এ ধরনের প্রশ্নের উত্থাপনের চির যবনিকাপাত ঘটবে।
সম্পাদনা: আশিক রহমান