শত্রুর চোখে ২৬ মার্চ
রাহাত মিনহাজ
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক ঢাকায় আসেন ১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে। বাংলাদেশে তার দায়িত্ব শেষ হয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। যেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এরপর যুদ্ধবন্দি হিসেবে ভারতে দুই বছর কারাগারে থাকেন সিদ্দিক। ১৯৭৩ সালে দিল্লি চুক্তির মাধ্যমে মুক্তি পেয়ে পাকিস্তান ফিরে আবার সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ব্রিগেডিয়ার হিসেবে পদোন্নতি পান। এরপর ১৯৮৮ সালে তৎকালীন সামরিক শাসক জেনারেল জিয়ার সঙ্গে ভাওয়ালপুরে এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন সিদ্দিক সালিক। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র সিদ্দিক সালিক বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম নিয়ে ‘উইটনেস টু সারেন্ডর’ নামে একটি বই লিখেন ১৯৭৬ সালে। যা ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। বইটি বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম নিয়ে লেখা বিদেশিদের সেরা বইগুলোর মধ্যে একটি। তথ্য সমৃদ্ধ এই বইটিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও পাকিস্তানের রাজনীতির বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে। এছাড়া অপরেশন সার্চ লাইটসহ যুদ্ধের নয় মাস পাকবাহিনীর বিভিন্ন অভিযান ও পরাজয়ের ইতিকথাও স্থান পেয়েছে বইটিতে। বইটি লিখতে গিয়ে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী বা পাক সরকারের কাছ থেকে কোনো রকম সহযোগিতা পাননি। বাংলাদেশে দায়িত্বপালনকালে তিনি যেসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছিলেন সেগুলোই তিনি বইটিতে সংযুক্ত করেছেন।
প্রায় সাড়ে চারশ’ পৃষ্ঠার এই বইটিতে সিদ্দিক সালিক তিনটি পর্বে তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। রাজনৈতিক, রাজনীতি-সেনাবাহিনী ও সেনাবাহিনী এই তিনটি অধ্যায়ে বিভিন্ন অনুচ্ছেদের মাধ্যমে তিনি সেই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরেছেন। সিদ্দিক সালিক বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়ে দুই পর্বে অপারেশন সার্চ লাইটের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। প্রথম পর্বে ঢাকা অভিযান, পরের পর্বে চট্টগ্রামসহ সারাদেশের অভিযান। ‘উইটনেস টু সারেন্ডর’ বইটির বর্ণনা অনুযায়ী ২৬শে মার্চের ঘটনা প্রবাহ তুলে ধরছেন রাহাত মিনহাজ।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে ঢাকা সেনানিবাসে মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন যখন গভীর চিন্তায় মগ্ন এমনই এক সময়ে তার অফিসের সবুজ টেলিফোন বেজে ওঠে। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার, সময় সকাল ১১টা। টেলিফোনের অন্য প্রান্তে ছিলেন লে. জেনারেল টিক্কা খান। তিনি বলেন খাদিম, ইট ইজ টু নাইট। এতে খাদিমের মধ্যে তেমন কোনো ভাবান্তর হয়নি। কারণ তিনি এ রকম একটি নির্দেশেরই অপেক্ষায় ছিলেন। তার জন্য তিনি প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছিলেন। রংপুর থেকে ঢাকায় এনেছিলেন ২৯ ক্যালিভারির ট্যাংক বাহিনী। ২৬মে মার্চের প্রথম প্রহর অর্থাৎ রাত একটাকে নির্ধারিত করা হয়েছিল আক্রমণের উপযুক্ত সময় হিসেবে। কারণ সেই সময়ে পাকিস্তনের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের করাচি বিমানবন্দরে পৌঁছার করার কথা।
অপরেশন সার্চ লাইট দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। ঢাকায় অভিযানে নেতৃত্ব দেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী আর সারাদেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে অভিযান চালান মেজর জেনারেল খাদিম। আর পুরো অপারেশনের গতি-প্রকৃতি ঢাকায় বসে পর্যবেক্ষণ করেন লে. জেনারেল টিক্কা খান। সিদ্দিক সালিক লিখেছেন সেই রাতে আমাদের মতো জুনিয়র অফিসারের তেমন কিছু করার ছিল না। রাত ১০টার দিকে আমরা মার্শাল ল অ্যাডমিনস্ট্রেটরের অফিসে ছিলাম। এই রাতটি যাতে সহজ আর স্বাচ্ছন্দ্যে পার করা যায় সেজন্য কফির ব্যবস্থা করছিলাম। এছাড়া ওয়ারলেস লাগানো একটা জিপ আমাদের অফিসের সামনে তৈরি ছিল। বসন্তের সেই রাতে ঢাকার আকাশে ভরপুর জ্যোসনা ছিল। আরামের সেই রাতে শহরবাসীও ছিল গভীর নিদ্রায়।
তবে এই রাতে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি শহরে আরেক শ্রেণির মানুষ সক্রিয় ছিলেন। তারা ছিলেন বাঙালি পুলিশ, ইপিআর সদস্য, বর্তমান ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা, ছাত্র, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও দলের স্বেচ্ছাসেবক। তারা শেখ মুজিবুর রহমান, জেনারেল ওসমানীসহ গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি অফিসারদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিলেন। প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন শক্ত প্রতিরোধের। তারা ঢাকার রাস্তায় বেরিকেড দিচ্ছিল। এমন পরিস্থিতিতে রাত সাড়ে এগারোটার দিকে ঢাকার স্থানীয় কমান্ডার অপারেশনের অনুমতি চান। তার যুক্তি ছিল সময় যত যাচ্ছে প্রতিরোধ তত কঠিন হচ্ছে। এ সময় অফিসের সবাই ঘড়ি দেখেন। তারা অনুমান করেন প্রেসিডেন্ট এখনো কলম্বো-করাচির মধ্য পথে আছেন। তিনি করাচিতে পৌঁছার পরই শুরু হবে অভিযান।
ঢাকা সেনানিবাস থেকে প্রথম যে গাড়ি বহরটি বের হয় সেটি বাধার সম্মুখীন হয় ফার্মগেট এলাকায়। সেখানে অনেক বড় একটি গাছ কেটে রাস্তায় বেরিকেড দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া পুরাতন গাড়ি, পরিত্যক্ত বয়লারসহ বিভিন্ন ধরনের জিনিস দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল প্রতিবন্ধকতা। এ সময়ও শহরের রাস্তায় কয়েক হাজার আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী রাস্তায় সেøাগান দিচ্ছিল। আমি (সিদ্দিক সালিক) তাদের জয় বাংলা সেøাগান টিক্কা খানের অফিসের বারান্দা থেকেও শুনেছিলাম। সেøাগানের মাঝে রাইফেলের গুলির শব্দও শোনা যাচ্ছিল। মূল অভিযান রাত একটায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও অনেক জায়গায় একটার আগেই আক্রমণ শুরু হয়। যখন সেনারা প্রথম আক্রমণ শুরু করে তখন পাকিস্তান রেডিও তরঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ধরা পড়ে। কণ্ঠস্বর শুনে মনে হচ্ছিল এটা আগেই রেকর্ড করা। যে বার্তায় শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে সবার প্রতি আহ্বান জানান। আমি (সালিক) শেখ মুজিবের সেই ঘোষণা শুনিনি। তবে এর কিছুক্ষণ পরেই রকেট লাঞ্চারের দুটি ফায়ারের শব্দ শুনতে পাই। রাস্তার বেরিকেড সরাতে সেনারা যা ব্যবহার করেছিল।
সে রাতে লে. কর্নেল জেড.এ. খান ও মেজর বেলাল শেখ মুজিবের বাড়িতে পরিচালিত অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন। সেনারা যখন মুজিবের বাড়ির ভিতরে ঢুকতে যাচ্ছিল তখন বাড়ির সামনে থেকে গুলি ছোঁড়া হয়। তবে তারা বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। এরপর কয়েকজন সেনা বাড়ির দেওয়াল টপকে ভিতরে ঢোকে। সেখানে স্টেনগানের ফায়ার আর চিৎকার করে মুজিবকে ডেকে তারা সেনাদের আসার বার্তা দেয়। কিন্তু ভিতর থেকে কোনো সাড়া আসেনি। এরপর পাক সেনারা মুজিবের শোবার ঘরে বাহির থেকে তালা দেওয়া দেখতে পায়। সৈন্যরা গুলি করে তালা ভেঙে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে। এরপর তিনি (মুজিব) নিজেকে গ্রেফতারের আহ্বান জানান। একটু পর ৫৭ ব্রিগেডের কমান্ডার মেজর জাফর তার ওয়ারলেসে বলেন, ‘বিগ বার্ড ইন কেইজ’ আদার নট ইন দ্য নেস্ট’ ওভার..।
এই ম্যাসেজ শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পরই আমি দেখতে পাই একটি আর্মি জিপে করে বিগ বার্ডকে (শেখ মুজিব) ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসা হচ্ছে। তার পরণে ছিল সাদা শার্ট। পরের দিন সেখান থেকে তাকে ফ্লাগ স্টাফ হাউসে স্থানান্তর করা হয়। যেখান থেকে নেওয়া হয় করাচিতে। এ সময় মুজিবকে নিয়ে কি করা হবে তা নিয়ে ধুম্রজাল তৈরি হয়েছিল। এ সময় আমি আমার বন্ধু মেজর বিলালকে জিজ্ঞাসা করি কেন শেখ মুজিবকে আক্রমণের প্রথম পর্যায়ে শেষ করে দেওয়া হয়নি? সে বলে, জেনারেল মিথ্থা তাকে ব্যক্তিগতভাবে নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে মুজিবকে জীবিত গ্রেফতার করা হয়।
শেষ রাতের দিকে মুজিব যখন ক্যান্টমেন্টে বন্দী তখন ঢাকা মাহনগরী আগুনে পুড়ছিল। আমি আমার বারান্দা থেকে টানা চার ঘণ্টা ভয়ঙ্কর সব দৃশ্য দেখেছিলাম। আগুনের লেলিহান শিখা আকাশ ছুঁয়েছিল। ধোঁয়ার মেঘ তৈরি হয়েছিল ঢাকার আকাশে। যাতে বসন্তের পরিষ্কার আকাশের চাঁদের আলো ঢাকা পড়েছিল। শহরে সবচেয়ে বড় আগুনের শিখাটি উঠেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। এই এলাকায় সেনারা কিছুটা বাঁধার সম্মুখীন হয়েছিল। তবে ভোর চারটার মধ্যেই তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। শহরের অন্যপ্রান্তে রাজারবাগে ইপিআর সদস্যদের সফলতার সঙ্গে নিরস্ত্র করে পাকবাহিনী। আর শহরের অন্য সব জায়গায় সেনারা ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে শুধুই আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য।
২৬শে মার্চে আলো ফোটার আগেই সেনারা তাদের অভিযান শেষ করে। ভোর ৫টার দিকে জেনারেল টিক্কা খান তার সোফা থেকে উঠেন। এ সময় রুমাল দিয়ে ড্রিংকের গ্লাস পরিষ্কার করতে করতে বারান্দা দিয়ে তাকিয়ে বলেন বলেন, ওহ্ এখানে তো কোনো আত্মাও নেই। এ সময় আমি বাইরে তাকিয়ে দেখি একটা কুকুর একাকী শহরের দিকে হেটে যাচ্ছে।
লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সরহযধুথঁফফরহথফঁ@ুধযড়ড়.পড়স
সম্পাদনা: আশিক রহমান