জঙ্গিবাদ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আনসার-ভিডিপি যেভাবে অবদান রাখছে
ড. ফোরকান উদ্দিন আহমেদ
সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসবাদÑ ত্রাস শব্দ হতে উদ্ভূত। এর অর্থ হলোÑ ভয়, ভীতি, শঙ্কা। সন্ত্রাস হলো আতঙ্কগ্রস্ত করা, অতিশয় ত্রাস বা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা। আর সন্ত্রাসবাদ হলো, রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্য হত্যা, অত্যাচার ইত্যাদি কার্য অনুষ্ঠাননীতি। অর্থাৎ কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কোনো জনগোষ্ঠীর মাঝে প্রণালীবদ্ধ সহিংসতার মাধ্যমে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা।
জঙ্গি, জঙ্গিবাদ ও জঙ্গিবাদী শব্দগুলোর মূল হলো জঙ্গ। এটি ফার্সি ও উর্দু ভাষার শব্দ। জঙ্গ অর্থ যুদ্ধ, তুমুল কলহ, লড়াই, প্রচ- ঝগড়া। জঙ্গি অর্থ যোদ্ধা। সেভাবে জঙ্গিবাদ অর্থ জঙ্গিদের মতবাদ, দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মকা-। ধর্মীয় কারণে রাজনৈতিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে চোরাগোপ্তা হামলা, অতর্কিত আক্রমণ, হত্যা করা, আত্মঘাতী হামলা কিংবা কোনো নির্দিষ্ট মতবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে জনগণের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করাকে জঙ্গিবাদ বলে।
বর্তমানে নিরাপত্তার ধারণা শুধু বহিঃশত্রুর আক্রমণ হতে দেশের ভৌগোলিক অখ-তা রক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ভৌগোলিক অখ-তা রক্ষার জন্য সামরিক শক্তি অর্জনের পাশাপাশি মানবিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ জরুরি। দারিদ্র্যবিমোচন, খাদ্য ও পরিবেশ সুরক্ষা, জনগণের নির্ভয়ে বিচরণ ও ধর্ম-বর্ণ-পেশা ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবার জীবনমান উন্নয়নের সঙ্গে সার্বিক নিরাপত্তা জড়িত। আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষাবাহিনী দেশের অখ-তা রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে সহায়তা করার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখছে। প্রতিবছর এ বাহিনী এক লক্ষাধিক আনসার ও ভিডিপি সদস্যদেরকে আর্থসামাজিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন তথা দারিদ্র্যবিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পাশাপাশি প্রশিক্ষিত ভিডিপি সদস্যগণ স্বেচ্ছায় রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তথা জননিরাপত্তা নিশ্চিত করণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রশিক্ষিত ও সচেতন ভিডিপি সদস্যরা জনগণ ও সরকারের মাঝে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও উন্নয়নে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশসহ বিশ্বের কতিপয় দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বার্নিং ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। ইসলামের নাম ভাঙিয়ে যারা সন্ত্রাসী কর্মকা- পরিচালিত করে, তারা প্রিয় নবী (স.) এর শিক্ষা ও আদর্শ থেকে অনেক দূরে। সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদের কোনো ধর্ম নেই। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছেÑ সমাজ ও রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল ও আতঙ্কগ্রস্ত করে পার্থিব সম্পদ অর্জন, ক্ষমতা দখল ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা।
সন্ত্রাস আজকে একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা হলেও তাকে জাতীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রেখে আলোচনা করছি। স্বাধীনতা উত্তরকাল থেকে সন্ত্রাসী কর্মকা- দেখে আসলেও ৮০-এর দশকের পর থেকেই সন্ত্রাসী কর্মকা-গুলো ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। জাতীয় জীবনের সর্বস্তরেই এটি আজ সংক্রামিত। গ্রাম তৃণমূল পর্যায়ে এই সন্ত্রাসী কর্মকা- পরিলক্ষিত হয়েছে। ব্যক্তি ও সামাজিক দ্বন্দ্ব, ব্যক্তি স্বার্থ ও সামাজিক স্বার্থ এই সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মূল কারণ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। গোত্রগত দ্বন্দ্ব ও ধর্মীয় গোড়ামি ইত্যাদি সন্ত্রাসকে একটি ব্যাধিতে পরিণত করেছে। তৃণমূল পর্যায়ের এই সন্ত্রাসই ক্রমে ক্রমে জাতির গভীরে অনুপ্রবেশ করে জাতীয় বিবেককে দুমড়ে আছড়ে মারছে। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালতে, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই সন্ত্রাস নামে এই বিষফোড়া জাতিকে আজ ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এই ব্যাধি আজ আমাদের গর্ব জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে পর্যন্ত মারাত্মকভাবে স্পর্শ করেছেÑ যা হুমকির সম্মুখীন। ধবংস হচ্ছে আমাদের জাতীয় মেধা।
বাংলাদেশের ঈর্ষণীয় সামাগ্রিক আর্থসামাজিক অগ্রগতির ধারা ব্যাহত করার প্রয়াসে বিবিধ আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও স্থানীয় কতিপয় কুচক্রিমহলের চক্রান্তে সম্প্রতি জঙ্গিবাদের উত্থান শুরু হয়েছে। পাড়ায় মহল্লায় তৃণমূলে আনাসর ও গ্রাম প্রতিরক্ষাবাহিনীর বিপুল দেশপ্রেমিক সদস্য-সদস্যাকে এর প্রতিরোধ ও দমনে কার্যকরভাবে নিয়োজিত করার এখনই উপযুক্ত সময়। দেশের প্রতি ইঞ্চি জায়গা আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষাবাহিনীর সদস্য-সদস্যাদের মাধ্যমে নজরদারিতে এনে রাষ্ট্রবিরোধী জঙ্গি কার্যকলাপ বা এতদসংক্রান্ত উপাদান তাৎক্ষণিকভাবে আইনের আওতায় এনে নিরাপদ ও স্থিতিশীল বাংলাদেশ তৈরি করাই হবে এ উদ্যোগের প্রধান লক্ষ্য। এছাড়াও মানবনিরাপত্তা ওয়াচডগ হিসেবে এর বিপুল সদস্যদের সৃজনশীল অংশগ্রহণ দেশকে টেকসই নিরাপত্তা ও উন্নয়ন পরিবেশ দিতে সক্ষম হবে। জঙ্গিদের গুলশান হলি আর্টিজানে হামলা, শোলাকিয়া বৃহত্তম ঈদ জামায়াতে হামলা চেষ্টা ইত্যাদি ঘটনা সন্ত্রাসের এক নতুন মাত্রায় ইঙ্গিত দেয়। এর আগে মুক্তমনা ব্লগার, সংখ্যালঘু ধর্মযাজক, ইসলামে ভিন্ন মতাবলম্বী মাজহাবের অনুসারী ইমাম, মোয়াজ্জিন ইত্যাদি একক টার্গেট কিলিং মিশন ছিল জঙ্গিপনার তৃণমূল প্রকাশ। শহরের শিক্ষিত ধনিক শ্রেণির সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ যুবক থেকে মাদ্রাসা-স্কুল-কলেজের ছাত্ররা জঙ্গিপনায় ঝুঁকে পড়ছে। ইদানিং নারী জঙ্গিদের আত্মপ্রকাশ সংশ্লিষ্টদের নজরদারিতে এনে তাৎক্ষণিক আইনের আওতায় আনার জন্য প্রয়োজনীয় জনবলের তৃণমূল বিস্তৃতি কেবল আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষাবাহিনীর রয়েছে।
অপারেশনাল দায়িত্বের আওতায় আমাদের সদস্যগণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সন্ত্রাসীদের মোকাবিলা করছে এবং জাতীয় নিরাপত্তায় অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। এছাড়া আমাদের অঙ্গীভূত সাধারণ আনসার সদস্যগণ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ভি পি ও কে পি আইতে দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে। বাংলাদেশে প্রায় পঞ্চাশ হাজার অঙ্গীভূত আনসার আছে, যারা সরকারি বেসরকারি স্থাপনা যেমনÑ সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, ইপিজেড, আন্তর্জাতিক হোটেলসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরলসভাবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে নিরাপত্তা বিধান করছে। বাংলাদেশের এ ধরনের প্রায় ১৫০০ কে পি আইতে দায়িত্বপ্রাপ্ত এ সকল সদস্যরা সার্বক্ষণিতভাবে প্রহরার মাধ্যমে সংস্থাগুলোতে সন্ত্রাসমুক্ত সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রেখে জাতীয় আইনশৃঙ্খলার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে। গ্রাম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ভিডিপি সদস্যগণ সংগঠিত হয়ে গ্রামের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে স্থানীয় প্রশাসনকে বিভিন্ন কর্মকা-ে সহযোগিতা করতে পারে। আমরা ইতোমধ্যে লক্ষ্য করেছি যে, গ্রাম-গঞ্জে কমিউনিটি নিরাপত্তাব্যবস্থায় আনসার-ভিডিপি সদস্য-সদস্যাগণ অংশগ্রহণ করে সামাজিক সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের দিকে যদি দৃষ্টিপাত করি তাহলে আমরা নিম্নলিখিত কারণগুলো খুঁজে পাই। ক. দারিদ্র্যতা খ. রেকারত্ব গ. পুঁজিবাদী মন-মানসিকতা ঘ. ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ঙ. আইনের আড়ালে সন্ত্রাস লালন পালন চ. দুর্নীতি ছ. আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের দুর্নীতি জ. দুর্বল বিচারব্যবস্থা ঝ. রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ট. ক্রোধ, লোভ, লালসা ও প্রতিহিংসা পরায়ণ মন-মানসিকতা। উল্লেখিত বিষয় ছাড়াও আরও কিছু কারণ রয়েছে যার ফলে সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি হচ্ছে এবং ফলশ্রুতিতে আজকে পাড়ায়-পাড়ায়, মহল্লায়-মহল্লায় লুটতরাজ, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি ইত্যাদি অপকর্মগুলো সংগঠিত হচ্ছে। সন্ত্রাস আজ একটি জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য সন্ত্রাসকে এক নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে তা প্রতিকারের একটি কর্মসূচি ও যুগোপযোগী ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক। নিম্নে কার্যকরি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য কয়েকটি সাধারণ সুপারিশ প্রদত্ত হলোÑ এক. দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে আয় বর্ধনমূলক সরকারি ও বেসরকারি বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। দুই. আত্মকর্মসংস্থানের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তিন. সুশিক্ষার প্রসার এবং প্রয়োগের ব্যবস্থা নিতে হবে। চার. দেশি ও বিদেশি উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে কর্মসংস্থান প্রসার ঘটাতে হবে। পাঁচ. ছাত্র রাজনীতিকে জাতীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। ছয়. রাজনীতিবিদদের মধ্যে রাজনৈতিক সহনশীলতা থাকতে হবে। সাত. সকল রাজনীতিবিদ তথা আপামর জনগণকে গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। আট. সন্ত্রাস দমনে বর্তমান প্রচলিত আইনের যুগোপযোগী সংস্কার সাধন করতে হবে। নয়. আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সকল বিভাগের দুর্নীতি দমন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দশ. আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। এগারো. আপামর জনগণকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। বারো. যুগের চাহিদার প্রেক্ষাপটে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যেমনÑ আনসার ভিডিপি, পুলিশ, বিজিবিকে ঢেলে সাজাতে হবে।
আমরা আজ কোনো না কোনোভাবে মাদক ও সন্ত্রাসের মরণ ছোবলে আক্রান্ত। সন্ত্রাসের এই ছোবল আমাদের শুধু বর্তমান প্রজন্মকে নয় ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এমনকি দেশের স্বাধীনতা পর্যন্ত বিপন্ন হতে পারে। তাই দেশের অস্তিত্বের কথা ভেবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর সমাজ ও স্বাবলম্বী অর্থনীতি উপহার দেওয়ার জন্য দেশের সকল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, সহনশীলতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। চলুনÑ ঐক্যবদ্ধভাবে জঙ্গি, মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলি।
লেখক: উপ-মহাপরিচালক ও কমান্ড্যান্ট (পিআরএল), বাংলাদেশ আনসার-ভিডিপি একাডেমি, সফিপুর, গাজীপুর
সম্পাদনা: আশিক রহমান