গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা ও ‘চানক্য’ বচন
কাকন রেজা
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ইদানিং গণতন্ত্রের নানান ব্যাখ্যা শুনি, পড়ি, দেখি। কেউ বলেন, গণতন্ত্রের ‘ন্যায়’ না, ‘ন্যায়ে’র গণতন্ত্র চাই। কারও চাই ‘ন্যায্যতা’র গণতন্ত্র। কেউ বা ‘স্বপ্নময়তা’র। গণতন্ত্রের এমন সম্ভারে মনে হয় ‘গণতন্ত্র’ মেলায় কেনা রঙের পুতুল। যে যেভাবে ইচ্ছা সাজাতে পারেন! এমন সব বাক্যবাজিতে প্রশ্ন জাগে, ‘গণতন্ত্র’ কি জগার খিঁচুরি! অর্থাৎ জগাখিঁচুরি কোনো বিষয়। আব্দুল মান্নান সৈয়দের ‘কবিতার কারখানা’র মতো। কবিতার নাটবল্টু কম পড়ে গেলে পাশের লতিফের দোকান থেকে এনে লাগিয়ে দেওয়া যাবে! শব্দের ‘নাটবল্টু’ ছাড়া যেমন কোনো লেখা ‘কবিতা’ হয়ে ওঠে না, তেমনি ‘গণতন্ত্র’ বলে চিল্লালেই ‘গণতন্ত্র’ আত্মস্থ হয় না। যেমন অন্ধের হাতি দর্শন হয় না। শুঁড় ছেনে বলে, ‘গণতন্ত্র’ লম্বা গোল মতো, লেজ ধরে বলে ‘গণতন্ত্র’ দড়ির মতো। কানে হাত পড়লে বলে, না না কুলোর মতো, পা ধরলে বলে, ‘গণতন্ত্র’ থামের মতো। এই ‘থামের মতো’টা অনেকটা কাছাকাছি। গণতন্ত্র তো থাম’ই, যার উপর রাষ্ট্র নামের একটি বাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। চারটি পায়ে যেমন হাতি দাঁড়িয়ে থাকে। এই চার পায়ের একটি হলো সংবাদপত্র, অধুনা সংবাদমাধ্যম। আর এই মাধ্যমের বদৌলতে লোকজন যখন গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা দিতে ‘এক মুঠো গুড়, এক চিমটি লবণ’ ফর্মুলা প্রয়োগ করেন তখন দুঃখও হয়, হাসিও পায়।
আপনি বলবেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষেরাও মানুষ, সংখ্যাগরিষ্ঠের জোরে তাদের ‘ন্যায্যতা’র অধিকার কেড়ে নেওয়া যাবে না। কিন্তু তাদের জাতিসত্তা কেড়ে নেওয়াকে সমর্থন করবেন। তাকে চাকমা, মারমা, ম্রং, মুরং, গারো, হাজং, সাঁওতাল থেকে ‘বাঙালি’ বানাবেনÑ অথচ তাদের অধিকার আদায়েই নানা ‘গপ্পো’ ফাঁদবেন; ক্যামতে কী! সত্যিই সেল্যুকাস! সাঁওতালের ঘর-বাড়ি পুড়ে গেলে মাঠে নামেন, আর তাদের অস্তিত্ব পুড়িয়ে ফেলার আয়োজনে চোখ বন্ধ করে ‘ভারত-বাংলাদেশ’ ক্রিকেট দেখেনÑ এটাও সেল্যুকাস।
এসব কা-কারখানা দেখলে মাঝেমধ্যে মাথা আউলা হয়ে যায়। এনারা ‘সাতখ- রামায়ণ পড়ে বলেন, সীতা কার বাপ’! অবশ্য আমার এক উকিল বন্ধু এর কারণ বিশ্লেষণ করেছেন অনেকটা এভাবে, ‘এখন মিডিয়াও বেশি, চাহিদাও বেশি। প্র্রচারে প্রসার, যেকোনো টপিকের উপর একটা বলে দিলেই হলো, লিখে দিলেই হলো! আগের বলার বা লেখার দর্শনের সঙ্গে পরের দর্শনের ঘর্ষণ হলে কী আসে যায়! আর তাতে ‘দেশপ্রেম’ ধর্ষণে পরিণত হলেও ‘কুচ পরোয়া নেহি’। আছেন আমার মোক্তার, আছেন আমার ব্যারিস্টার! না হলে তো গোপাল ভাঁড় আছেই। বলে দেবেন, গরু হারালে এমনি হয় মা!’ এমন যুক্তির মুখে কী আর বলি! মুখ লটকে বসে থাকা ছাড়া আর কী করা।
একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের গঠন, সেই রাষ্ট্রের নাগরিকদের রাষ্ট্রিক পরিচিতি, নাগরিকের অধিকার, আর সেই অধিকার চর্চার সহজতাÑ এসব মিলিয়েই ‘গণতন্ত্র’। ন্যায্যতার নামে মানুষের অধিকার চর্চার ক্ষেত্র সংকুচিত করলে, অন্যের মতকে ‘অন্যায্য’ বলে অস্বীকার করলে যে ‘গণতন্ত্র’কে অন্য তন্ত্রমন্ত্রে সাজাতে হয়। ‘ন্যায্য’ ‘অন্যেয্যে’র রায় দেওয়ার আধিকারিক আদালতের ‘বিচারক’ তো আপনি একা নন, এই রায়ের মালিক সমষ্টিক জনগোষ্ঠী, নাগরিক। হিটলারও তো ‘ন্যায্য’তার কথা বলেছেন। বলেছেন মুসোলিনিও। কিন্তু নাৎসীবাদ, ফ্যাসিবাদ কিংবা নাৎসীতন্ত্র, ফ্যাসিতন্ত্র তো ‘গণে’র সনদ পায়নি। গণের সনদ পেতে হলে, আবেগ নিয়ন্ত্রিত করে বিবেক জাগ্রত করতে হবে। আবেগ মানুষকে অন্ধ করে। ‘আনুগত্য’ যেমন অন্ধের হাতে পড়লে তা হয় ‘ভয়াবহ’। অনেকটা তস্করের হাতে ছুরি এবং চিকিৎসকের হাতের ছুরির পার্থক্যের মতো। অন্ধ আনুগত্যের প্রকাশ করতে গিয়ে, ভুজংভাজং দিয়ে কিছু দাঁড় করানোর চেষ্টা করলে সেটা জগার খিঁচুরিই হবে, অন্যকিছু হবে না।
মনোবিজ্ঞানে সম্ভবত এমন জগাখিঁচুরি কর্মকা-ের কোনো একটি ব্যাখ্যা আছে। যেমন সাইকোপ্যাথদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা যা করে তার পেছনে কোনো একটি যুক্তি দাঁড় করাবার চেষ্টা করে। সিরিয়াল কিলারদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা খুনের পেছনে একটি যুক্তি দাঁড় করায়। নারী হন্তারকদের কেউ বলে, মেয়েরা বিশ্বাসঘাতিনী। এদের জন্য সংসার নষ্ট হয়, প্রেমে ব্যর্থ পুরুষেরা আত্মহনন করে। সুতরাং মেয়েদের শাস্তি দিতেই তাদের হত্যা করা হয়েছে! ইদানিং সন্ত্রাসীরাও এ ধরনের যুক্তি ব্যবহার করে। তারা শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে মানুষ হত্যা করে। অনেকে তামিল সিনেমার মতো, সমাজের নোংরা দূরীকরণ প্রকল্প হাতে নেয়! মনোবিজ্ঞান এসবকে মানসিক বৈকল্য হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়েছে। সুতরাং ‘জগাখিঁচুরি’র বিষয়েও মনোবিজ্ঞানের নিশ্চিত একটা ব্যাখা রয়েছে।
গণমাধ্যমে একটি খবর পড়লাম ‘ট্রাম্প’ বিষয়ক। সম্প্রতি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, ভদ্রলোকের এত বেশি খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে এবং সেসব খবরের অধিকাংশই ‘চমকপ্রদ’। যার ফলে চমকিত হবার মতোন অবস্থা আর নেই। তবুও সেই খবরটি রেটিনাবদ্ধ হলো। ’৭০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন রেটিং ট্রাম্পের’ এমন শিরোনামে ‘মানব জমিন’ অনলাইনের খবরটিতে বলা হয়েছে, গ্যালাপ জরিপ অনুযায়ী ক্ষমতা গ্রহণের দুমাসের মাথায় ট্রাম্পের জনসমর্থন দাঁড়িয়েছে ৩৭ ভাগে। অর্থাৎ মাত্র ৩৭ ভাগ আমেরিকান এখন ট্রাম্পকে সমর্থন করেন। আর প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাকে অনুমোদন করেন না শতকরা ৫৮ জন মার্কিন নাগরিক। লন্ডনের অনলাইন দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট, সিএনবিসি, নিউ ইয়র্কার ডেইলি নিউজ প্রমুখ গণমাধ্যমের মতে, বিগত ৭০ বছরের মধ্যে আমেরিকার কোনো প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তা এত নিচে আর নামেনি। অর্থাৎ ট্রাম্প হলেন বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে অজনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট।
ট্রাম্প সাহেবের কথাবার্তা কিন্তু জোশ। আমাদের বর্তমান তারুণ্যের ভাষায়, জোশ, হেভভি এবং ঝাকাস! তিনি কথায় কথায় গণমাধ্যমকে অসৎ বলেন! মুসলমানদের প্রতি উষ্মা দেখান, ছয় দেশের মানুষের প্রবেশ স্থগিত করেন! মেক্সিকানদের দেওয়াল দিয়ে আটকে দিতে চান! অভিবাসী প্রশ্নে ভূমিকম্প মাপার রিখটার স্কেলে আট মাত্রার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন! এমন প্রেসিডেন্ট জনপ্রিয় হবার তো কোনো কারণ থাকার কথা নয়। অন্তত সভ্য, শিক্ষিত এবং গণতান্ত্রিক দাবিদার একটি জাতির কাছে। তবে, এসবে ট্রাম্প সাহেবের কিছু আসে যায় না। তিনি তার বাক্যবাণে অবিচল। অজনপ্রিয় মানুষদের কাছ থেকেই মূলত ‘উত্তেজিত’ কথাবার্তা শোনা যায়। অন্যকে হেয় করার প্রবণতা, কটু বাক্য, চটুল কথাবার্তা অজনপ্রিয় মানুষদের কাছ থেকেই দেখা যায়, ধ্বনিত হয়। অথচ জনপ্রিয় কেউ অন্যকে হেয় করতে চান না। ‘ইনফিরিয়র’রাই নিজেদের ‘সুপিরিয়র’ প্রমাণ করতে চান, কমপ্লেক্সে ভোগেন, এমন কথা বলেছেন অনেক জ্ঞানী মানুষই। কটুবাক্যের ব্যবহার হয় মানুষকে অবদমিত করতে। আর চটুলতা হলো অস্বস্তি ও অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ।
প্রাচীন ভারতের একজন অর্থনীতিবিদ, দার্শনিক ও রাজ-উপদেষ্টা ‘চানক্য’ যিনি আমাদের অনেকেরই পছন্দের। সেই ‘চানক্যে’র ভাষায়ই বলি, ‘যদি কোনো সাপ বিষধর নাও হয়, তবুও তার উচিত বিষধর হওয়ার ভান করা, যেন সে ইচ্ছা করলেই বিষাক্ত দংশন করতে পারে। একইভাবে দুর্বল ব্যক্তিদেরও সবসময় নিজেদের দুর্বলতাগুলো লুকিয়ে রাখা উচিত।’ সুতরাং এমন ‘মহামহিম’রা হয়তো চানক্যের শিক্ষাই অনুকরণ করছেন।
কদিন আগে ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প, তুমি আসলে একজন জঘন্য প্রেসিডেন্ট এবং আমরা বারাক ওবামাকে ফেরত চাই’ এমন একটি মন্তব্য ফাস্টফুড চেইন শপ ‘ম্যাকডোনাল্ড’সের টুইটার একাউন্ট থেকে করা হয়। অবশ্য পরে মন্তব্যটিকে তুলে নেয় তারা এবং একাউন্ট হ্যাক হয়েছিল বলে ক্ষমাও চায়। কিন্তু ব্যাখ্যা আর ক্ষমাতেই কি সবকিছুর রেশ ফিকে হয়ে যায়? তেমনি নানা রঙে রাঙাতে চাইলেও ‘গণতন্ত্রে’র মূল রঙ কিন্তু ফিকে হয়ে যায় না। ‘গণতন্ত্র’ গণতন্ত্রই থাকে, তন্ত্রমন্ত্র হয় না। গণতন্ত্র বিষয়ে ব্যাখ্যা বাগিশদের ‘চানক্যে’র ভাষাতেই বলি, ‘যে ব্যক্তি নিশ্চিতকে ছেড়ে অনিশ্চিতের দিকে ধাবিত হয়, তার উভয়ই নষ্ট হয়।’ জয় হোক ‘চানক্যে’র।
সম্পাদনা: আশিক রহমান