জিজ্ঞাসাবাদ করতে ঢাকার র্যাব ও পুলিশের কয়েকজন সদস্য চট্টগ্রামে সীতাকুন্ডের ‘ছায়া নীড়ে’ তৈরি শক্তিশালী বোমা জঙ্গিদের হাতে
বিপ্লব বিশ্বাস: সীতাকুন্ডের জঙ্গি আস্তানা ছায়ানীড় থেকে গ্রেফতার জঙ্গি দম্পতি পুলিশকে বলেছে, চট্টগ্রামের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী তাদের টার্গেটে ছিলেন। ‘বড় ভাই’ হামলার টার্গেটও ঠিক করে দেয়। অস্ত্র ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ১২ দিনের রিমান্ডে নেয়ার পর দ্বিতীয় দিনের জিজ্ঞাসাবাদে জঙ্গি দম্পতি জহিরুল ইসলাম জসিম এবং তার স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা আরজিন এ তথ্য দেয়।
তারা বলেছে, এ সংগঠনের হয়ে কাজ করার সময় মৃত্যু হলে জান্নাত অবধারিত- এমন বিশ্বাসেই এ পথে পা বাড়ায় তারা। ‘পরকালে জান্নাতের লোভে’ এ সংগঠনের ‘সুসাইড স্কোয়াড’ টিমের সদস্য বনে যায় এ দম্পতি। তারা আরো বলেন, এক ‘বড় ভাই’য়ের কাছ থেকে তারা অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণও নিয়েছিল। বড় ভাই তাদের সাফ জানিয়ে দিয়েছে, সংগঠনের হয়ে কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়া চলবে না। এ জন্য তাদের সঙ্গে থাকত ‘সুইসাইডাল ভেস্ট’।
নির্দেশনা ছিল গ্রেফতারের উপক্রম হলেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সামনে (তাদের ভাষায় তাগুত বাহিনী) আত্মঘাতী হামলার মধ্যদিয়ে মৃত্যুবরণ করতে হবে। এ দম্পতির টিমে ৮ জন সদস্য ছিল। হৃদয় (রাফাদ আল হাসান) নামে এক যুবকের মাধ্যমে তারা দাওলাতুল ইসলামের সঙ্গে যুক্ত হয়। এরপর হৃদয়ই তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করত। তাদের উপার্জনের আর কোনো পথ ছিল না। রাশেদ ও হৃদয় তাদের সঙ্গে সমন্বয় করত। এ টিমে সোহেল রানা এবং শাহনাজ নামে আরও দুজন রয়েছে। তারা এখন কোথায় তা জানে না এ দম্পতি। সূত্র আরো জানায়, তাদের জিজ্ঞাসা করতে ঢাকা থেকে পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার কয়েকজন কর্মকর্তা চট্টগ্রামে গেছেন।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি (ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট) কুসুম দেওয়ান জানান, ‘জঙ্গিরা ছোট ছোট গ্রুপে ৭ থেকে ৮ জনে ভাগ হয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে। তাদের টিমের সদস্যদের বাইরে যে তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে এ রকম এক-দুজন ছাড়া দলের বেশিরভাগ লোককে তারা চেনে না। যার কারণে এ সংগঠনকে উপড়ে ফেলা সম্ভব হচ্ছে না।
রাশেদ ও হৃদয় বোমা তৈরির কারিগর ছিল এবং চট্টগ্রামের দুই জঙ্গি আস্তানায় যেসব বোমা বানানো হয়েছিল তা এ দুজনই তৈরি করে। বুধবার সাধন কুঠিরে প্রথম দফায় পরিচয়পত্র নিয়ে যখন বাড়ির মালিকের সঙ্গে জঙ্গি দম্পতির কথা কাটাকাটি হয় তখন ওই বাসা থেকে কেটে পড়ে। রাতে তারা দ্বিতীয় আস্তানা ছায়ানীড়ে অবস্থান নেয়। এদিকে নব্য জেএমবির চট্টগ্রামের সমন্বয়ক মুসার যাতায়াত ছায়ানীড়ে ছিল বলে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে। যদিও এ বিষয়টি স্বীকার করছে না জঙ্গি দম্পতি জসিম ও আরজিনা।
সূত্র জানায়, ঢাকায় র্যাব ব্যারাকে বিস্ফোরিত গ্রেনেড সীতাকুন্ড থেকে উদ্ধার করা গ্রেনেডের মতোই। সীতাকুন্ডের চৌধুরী বাড়ির ‘ছায়ানীড়’ ভবন থেকে উদ্ধার করা গ্রেনেডের সঙ্গে ওই সব গ্রেনেডের মিল রয়েছে। একইভাবে সীতাকুন্ডে উদ্ধার করা বোমার সঙ্গে মিল রয়েছে ৭ মার্চ কুমিল্লায় পুলিশ চেকপোস্টে হামলায় ব্যবহৃত বোমারও। কুমিল্লায় হামলার সময় গ্রেফতার করা হয় হাসান ও ইমতিয়াজ ইমু নামে দুই জঙ্গি সদস্যকে। গ্রেফতারের পর তারা পুলিশকে বলেছে, ধরা পড়ার এক সপ্তাহ আগে আরও যে ৮টি বোমা ঢাকায় নিয়ে গিয়েছিল সেই বোমাই বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে ঢাকায় র্যাব ব্যারাকে। এসব বোমা তৈরি হতো চট্টগ্রামের পটিয়ায় এবং পরে সীতাকুন্ডের ‘ছায়ানীড়’ নামের ওই বাড়িতে। বোমা তৈরির এসব কাঁচামাল চট্টগ্রাম নগরী, সীতাকুন্ডসহ দেশের বিভিন্ন খুচরা দোকান থেকে সংগ্রহ করা হতো। ইতিমধ্যে ওইসব এলাকার কয়েকটি দোকানের নামও পেয়েছে পুলিশ।
আটক জঙ্গি দম্পতি ও বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার জঙ্গি সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, নব্য জেএমবি মসজিদ-মাদ্রাসার নাম করে যেমন চাঁদা তোলে তেমনি সোনার দোকান, হুন্ডির টাকা ছিনতাই করেও তারা ফান্ড গঠন করে। চট্টগ্রামের সদরঘাটে ২০১৫ সালে এক ব্যবসায়ীর ওপর বোমা হামলা করে বিপুল পরিমাণ টাকা লুট করেছিল নব্য জেএমবি। ওই ঘটনায় এক জঙ্গি সদস্য ও এক ব্যবসায়ীও নিহত হয়। সে সময় গ্রেপ্তারের জেএমবির একাধিক সদস্য পুলিশকে জানায়, তারা সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ফান্ড গঠন করতেই এ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটায়। তিনি এও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে নব্য জেএমবি অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংগ্রহ করছে। আন্তজার্তিকভাবে চেনার জন্য জেএমবির শাখা সংগঠন হিসেবে ‘দাওলাতুল ইসলাম’র নামেই নব্য জেএমবি কার্যক্রম চালাত। তাছাড়া তারা কোনো মোবাইল ফোন ব্যবহার করে না। সম্পাদনা : এনামুল হক