জঙ্গি দমন ও জাতীয় সংস্কৃতির বিকাশ
মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম
লেখক: সাবেক এমপি আহ্বায়ক জাগরণী শান্তিসংঘ
জঙ্গি দমনে বাংলাদেশের গলদঘর্ম অবস্থা। সরকার, সকল বিরোধী দল, এনজিও এবং সুশীলসামজ সবাই এ কাজে ব্যস্ত। শিক্ষিত শহুরে জনগোষ্ঠী ও সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন। জনগণ গভীর নিদ্রায় মগ্ন। জনগণ বলতে আমি গ্রামীণ জনপদের উৎপাদনলগ্ন মানুষদের বোঝাচ্ছি। তবে এক্ষেত্রে শহুরে গরিব মানুষেরাও জনগণের কাতারে পড়ে। জঙ্গি দমনে সরকারের নীতি দৃশ্যত পীড়নমূলক। সরকার এ ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্সে’র কথা বলছেন। আর অন্যদের অবস্থা ‘মারো ঠেলা হেইয়ো’ জিকিরে শামিল হওয়ার মতো।
জঙ্গিবাদ আসলে পশ্চিমাদের একটি এজেন্ডা। এই এজেন্ডা বাস্তবায়নের কাজে কে কার আগে যোগ দেবে এই প্রতিযোগিতায় মত্ত আমাদের দেশের উল্লেখিত শক্তিগুলো। আইএসআইএস অর্থাৎ ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া জঙ্গিত্বের এখনকার মতো সর্বশেষ সংস্করণ, আর শুরু হয়েছিল তালেবান দিয়ে বিগত শতকের সত্তরের দশকের শেষের দিকে। মাঝে দৃশ্যপটে ছিল আল-কায়দা। তালেবান আফগানিস্তানে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনের ফসল। আল-কায়দা দৃশ্যপটে আসে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজতন্ত্রের পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুনিয়ায় একক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পর তার বিশ্বায়নবাদী আধিপত্যবাদী নীতি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রতিক্রিয়ার ফল হিসেবে। আর আইএসআইএস একই আধিপত্যবাদী ধারার সৃষ্টি। আইএসআইএস-এর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান চলছে। এরাও বসে নেই, মাঝে মাঝেই আঘাত হানছে লক্ষ্যস্থলে। সাড়া দুনিয়াই বলতে গেলে জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযানের অভিঘাতে রয়েছে। তবে বিশেষভাবে এবং গভীরভাবে অভিঘাতের স্পর্শ পড়ছে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল ও দেশগুলোতে।
এই সংকটের মূলে অর্থনৈতিক আগ্রাসন তাতে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার চেয়েও গভীরস্পর্শী একটি অনুসঙ্গ। সেটি হলো সাংস্কৃতিক সংঘাত। কিন্তু অনেকটা অভ্যাসবসতই সেদিকে মানবজাতির নজর নেই। দুনিয়াটা চলছে অর্থের হিসেবে। এমনকি মানুষের মতো জীবকেও অর্থতুল্যদ-ে তোলা হচ্ছে এবং গোটা পৃথিবীটাকেই বিবেচনা করা হচ্ছে অর্থের মানদ-ে। অথচ মানুষ মূলত একটি সংস্কৃতি। মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর সংস্কৃতি নেই। মানুষের প্রাথমিক পরিচয় নৃতাত্ত্বিক গঠনে। নৃতত্ব মানে নিরন্তর জীবন-সংগ্রাম এবং প্রকৃতির সঙ্গে চলা অবিরাম মিথস্ক্রিয়া। সাধারণ নৃতত্ব বিশিষ্ট মানুষের সম্মিলিত জীবনধারা ও প্রাকৃতিক-ভৌগলিক পরিবেশ তৈরি করে জাতিসত্তা। জাতিসত্তার স্বাধীন বিকাশের উপর নির্ভর করে জাতি বিশেষের দ্বারা গঠিত জাতি-রাষ্ট্রের গতি-প্রকৃতি এবং সমৃদ্ধি। অপরাপর জাতি ও জাতিসমূহের সঙ্গে পারস্পরিক সংমিশ্রণে জাতির সংস্কৃতি হৃদ্ধ হয়। কিন্তু সাংস্কৃতিক আধিপত্য জাতিকে দুর্বল-হীনবল ও পরনির্ভর-পরাধীন করে তোলে। বাঙালি জাতির জন্ম বিকাশ ইত্যাদিকে এই আলোকে না দেখে জঙ্গিত্ব নিয়ে আমরা যেভাবে খেলায় মেতে আছি তাতে শেষ পরিণতির কোথায় গিয়ে গড়াবে সেটা বলা মুশকিল। সংস্কৃতিকে গান-বাজনা, নর্তন-কুর্দন এসব বিনোদন মাধ্যম কিংবা বাহ্যিক আবরণের বাতাবরণের দ্বারা বিবেচনা করে অর্থনীতিকে প্রথম ও শেষ কথা ভাবলে যে কি মাসুল গুনতে হয় তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া উচিত। কিন্তু বেঘোরে মানুষের অবস্থা। সেদিকে কারও নজর নেই। অর্থের অনর্থই আজ মানবজাতির জীবনকেই বিষিয়ে তুলছে। বর্তমান সময়টাই এর বড় উদাহরণ হতে পারে। বিশেষ উদাহরণ হয়ে আছি আমরা বাংলাদেশের মানুষ। আমরা দাবি করি উন্নয়নের মহাসড়কে আমরা পৌঁছে গেছি। অর্থনীতির তথাকথিত মাথাপিছু হিসাবভিত্তিক প্রবৃদ্ধির মানদ-ে মানুষকে মাতিয়ে রাখলেও জাতিসত্তার ভিতরে গায়ে-গায়ে জ্বলছে তুষের আগুন। মুখে আমরা যতই উন্নতির ফেনা তুলি না কেন ভিতর আমাদের জ্বলে-পুড়ে ছাড়খার সেই তুষের আগুনে। জঙ্গিবাদকে দেখতে হবে আমাদের এরই আলোকে।
বাঙালি পালাক্রমিক আধিপত্যবাদী ধারায় বেড়ে উঠেছে। তার জীবনের পরতে পরতে বাসা গেড়ে আছে বিজাতীয় জীবনধারার সস্কৃতির অনুসঙ্গ। সাধারণ-স্বাভাবিক বিবর্তনের ধারায় বিকাশপ্রাপ্ত হলে জাতির অবস্থা এমন কিম্ভূতকিমাকার হতো না। বৈচিত্রকে যথাযথভাবে আত্মস্থ করা জাতির পক্ষে আজ অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ফলে আজকে জাতি বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশের নেতিবাচকতার দ্বারা দ্বিধান্বিত হয়ে আত্মবিশ্বাস হারাতে বসেছে। জাতি আজ দুই প্রধান বিপরীত ধারায় বিভাজিত। একদিকে পশ্চিমা ভাবাদর্শ আর অপরদিকে মধ্য এশিয়ার ভাবধারা। নিকট অতীতে জাতির জীবনে এই বিভাজন রেখা স্পষ্ট করে এক ট্যাজিক মহড়া হয়ে গেল এই ঢাকা শহরে। শাহবাগ চত্বরের তথাকথিত গণজাগরণ ও শাপলা চত্বরের হেফাজতি জাগরণের প্রতিক্রিয়া জাতির মানসকে স্পষ্টতই দুভাগে ভাগ করে দিয়েছে। দুই পক্ষেরই জমায়েতকৃতদের শারীরিক গঠন অর্থাৎ রক্তে-মাংসে তারা এক হলেও তাদের ভিতরের বিশ্বাস পরস্পর জানের শত্রু এই বাস্তব চিত্রই যেন ফুটে উঠল জাতির সামনে। এরূপ আত্মদহন জাতির চিরসঙ্গী।
আমাদের দেশের জঙ্গিত্বকে বিচার করতে গেলে এবং এর থেকে মুক্তি পেতে হলে এই মহড়াকে গভীরভাবে বিবেচনা নেওয়া দরকার। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ কিংবা হেফাজতে ইসলামÑ এর কোনটি আমাদের স্বকীয় সংস্কৃতিভিত্তিক? দুই পরস্পর বিপরীত ধারার মিলিতরূপ কি বাঙালি সংস্কৃতি? আমাদের মুক্তির পথ কি একটাকে নির্মূল করে আর অন্যটিকে জয়ী করা? আমরা কি এই পারস্পরিক নির্মূল যুদ্ধেই মেতে থাকব, না কি স্বকীয় সংস্কৃতির সন্ধান করব? এসব প্রশ্নের সমাধান করতে হবে আমাদের। তা না হলে পরাধীনতার জিঞ্জির হতে মুক্ত হওয়া যেমন অসম্ভব তেমনি জঙ্গিমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করাও সম্ভব নয়।
এটা কেবল আমাদের একার সমস্যা নয়। এটি বৈশ্বিক সমস্যা, সভ্যতার সংকট। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতির ফলে সৃষ্টি হয়েছে এই সমস্যা। এই নীতিতে চলা ইতিহাস আজ তার গতি হারিয়ে ফেলেছে। সর্বত্র বিরাজ করছে অসুস্থতা, শঠতা, মিথ্যাচার, ভাগাভাগির রাজনীতির উত্তেজনাকর এক উন্মত্ত পরিস্থিতি। আজ মানুষের বিরুদ্ধে মানুষ। পুরুষের বিপক্ষে নারী আর নারীর বিপক্ষে পুরুষ। শ্রমিকে-মালিকে দ্বন্দ্ব আর শ্রমিকের বিরুদ্ধে শ্রমিক। অস্তিত্বের বিরুদ্ধে আজ অস্তিত্ব আর প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষ। আদর্শবাদ আজ আদর্শবাদের প্রতিপক্ষ। ধর্মের বিপরীত অবস্থানে ধর্ম। এ পাল্টাপাল্টি, এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত, এই বিবাদ-বিরোধ বিষিয়ে তুলছে সকলের জীবনকে। এসব দ্বন্দ্ব-সংঘাত, বিবাদ-বিরোধে বিকাশ নেই, আছে শুধুই ধ্বংস, আছে কেবলই সীমাহীন-কঠিন শত্রুতা। ফলে আজ বিপন্ন পৃথিবী, বিপন্ন সভ্যতা। মানবজাতি মানবীয় সংস্কৃতির বিকাশ রুদ্ধ হয়ে অচলায়তনে আটকা পড়েছে, মানুষ দ্রুত মানবিক গুণাবলি হারাচ্ছে। মানবজাতির সামনে সভ্যতা ও মনষ্যত্ব বিকাশের সদর্থক কোনো আদর্শ নেই। চলছে চরম আদর্শিক নৈরাজ্য। মানুষের আধিপত্যবাদী প্রবণতা আজ বিশ্বায়নবাদী নাম নিয়ে মানবজাতির উপর হামলে পড়েছে। দুর্বল জাতিরাষ্ট্রগুলো তাদের স্বকীয় বিকাশের পথ হারিয়ে ক্রমশ দুর্বল ও অকার্যকর হয়ে পড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পরিচালিত বিশ্বায়নের জালে আটকা পড়েছে আজ সভ্যতা, সংস্কৃতি, প্রগতি-সামনে আগ্রসর হওয়ার সব পথ রুদ্ধ। অথচ এই বিপদ নিয়ে কেউ ভাবছে না। সকল মহলই পুরাতন গতানুগতিকতা নিয়ে পরস্পর কলহে মত্ত রয়েছে।
আজকে জঙ্গি নিয়ে যে বিরক্তিকর এক সমস্যায় জড়িয়ে পড়েছি আমরা, তার জন্য জাতির আত্মগঠন দরকার। আপন সংস্কৃতির নির্ভর হয়ে নিরন্তর সংগ্রামের স্বাধীন পথ ধরেই কেবল এ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। অর্থাৎ সঠিক জাতীয়তাবাদ এবং সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদই মুক্তির একমাত্র পথ। আমরা এ লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছি। আমরা এই গ্রহটিকে মানুষের বাসযোগ্য করতে চাই। আমরা ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এই নীতিতে তছনছ, খ–বিখ-, ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পড়া বিশ্বব্যবস্থার ন্যায্য পুনর্গঠন চাই এবং জাতি ও জাতিরাষ্ট্রগুলোর সুষম বিকাশ চাই। প্রত্যেকটি জাতি নিজস্ব কর্মসূচির ভিত্তিতে নিজেদেরকে পুনর্গঠিত করবে। আমরা মনে করি, বাংলাদেশে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক প্রণীত আটাশ দফাÑ আমাদের মুক্তির ও উন্নতির কর্মসূচির ভিত্তিতে জাতিকে ভিতর থেকে জাগিয়ে তোলা সম্ভব।
সম্পাদনা: আশিক রহমান