সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না : বিশেষজ্ঞ মত যুক্তরাজ্যের হামলার ঘটনায় বাংলাদেশে প্রভাব পড়েবে না
নাশরাত আর্শিয়ানা চৌধুরী: লন্ডনে হামলার ঘটনা বাংলাদেশে কোন প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সেখানে বাংলাদেশী যারা আছেন তাদের উপর এখনই প্রভাব পড়বে না। তবে আগামী দিনে ইংল্যান্ড সরকার যদি বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের উপর কড়াকড়ি আরোপ করে তাহলে সেটা সমস্যা হতে পারে। তবে সেই বিষয়টিওর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো লন্ডনে যে ঘটনা ঘটেছে সেখানে অনেক পর্যটক থাকে। একজন মানুষ একটি গাড়ি নিয়ে একটি ছুরি দিয়ে মানুষ মারলো। এত মানুষকে আহত করলো ঘটনাটি স্বাভাবিক কোন ঘটনা নয়। এটা অপরাধী, সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাসী ও নাশকতার কর্মকা- করার পরিবির্তত কৌশল। আর এই পরিবর্তিত কৌশল হিসেবে আগে সন্ত্রাসীরা আগ্নেয় অস্ত্র ও বোমা, গ্রেনেড ব্যবহার করলেও এখন সেটাকে পরিবর্তন এনেছে। এছাড়া যে ঘটনাটি ঘটিয়েছে সে বাইরের নয় বৃটিশ সিটিজেন। আমাদের দেশে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটলেই বলা হয় জঙ্গিরা হোম গ্রোন। এরা আইএস নয়। লন্ডনের ঘটনায় ভেতর থেকেই ঘটনা ঘটিয়েছে। আমাদের এখানেও এই ধরণের ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়ে যায়। সেই হিসাবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় সাধন। গোয়েন্দাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা প্রয়োজন। কোন ঘটনা ঘটলে আগেই রাজনৈতিক কালার না দিয়ে প্রপার তদন্ত প্রয়োজন। এরপর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। লন্ডন হামলার ঘটনাকে এভাবে বিশ্লেষণ করেছেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আজম খান।
সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, লন্ডনের ঘটনাটি ঘটেছে অভিবন একটি কায়দায়। এই ধরণের সন্ত্রাসী হামলা করার জন্য অপরাধীরা নতুন কৌশল নিয়েছে। এই ঘটনায় আমাদের এখানে তেমন প্রভাব ফেলবে না। তবে সেই ধরণের প্রভাব না পড়লেও এটা ঠিক বাংলাদেশে এই ধরণের ঘটনা ঘটতে পারে। কারণ বাংলাদেশে আইএস নেই। আইএস না থাকলেও বলা হচ্ছে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন রয়েছে। এই অবস্থায় ওই সব ঘটনা থেকে জঙ্গিরা নতুন কৌশলে নতুন ধরণের ঘটনা ঘটানোর জন্য চেষ্টা করতে পারে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকার বিভিন্ন ধরণের উদ্যোগ নিয়েছে জঙ্গি হামলা ও সন্ত্রাসী হামলা বন্ধ করার জন্য। কিন্তু তা সব সময় কাজে আসছে না। ও ঘটনা বন্ধ করা যাচ্ছে না। কারণ গৃহীত ব্যবস্থাকে মাথায় রেখে অপরাধীরাও নতুন নতুন কৌশল করছে।
তিনি বলেন, আমাদের এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা কোন ঘটনা ঘটলে রাজনৈতিক প্রলেপ দেওয়া হয়। এটা ঠিক না। সন্ত্রাস ও জঙ্গি হামলারোধে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবে।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে লন্ডনের হামলার প্রভাব পড়বে না। কারণ যে ঘটনা ঘটিয়েছে সে বৃটিশ নাগরিক। একজন বৃটিশ নাগরিক ওই ঘটনা ঘটানোর কারণে অন্য দেশের মানুষকে সেইভাবে নজরদারীও করা হবে না। তবে তারা তাদের অভ্যন্তরে নজরদারী বাড়াতে পারে। তবে তদন্ত করার পর আন্তর্জাতিক কোন মহলের সম্পৃক্ততা থাকলে তখন তারা কড়াকড়ি করতে পারে।
সাবেক আইনমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশে যারা বড় বড় অপরাধ করছে তারা বিদেশি নয় দেশি। আর বিদেশ থেকে এসেও করছে না। তারা এই দেশেই জন্ম ,বেড়ে উঠা ও বসবাস। আর এই পর্যন্ত সন্ত্রাসীরা ব্যক্তি ও বিভিন্ন ধরণের স্থাপনায় হামলা করলেও এখনও পর্যন্ত সরকারি কোন স্থাপনা কিংবা জনসাধারণের চলাচলের স্থানে কোন হামলা করেনি। বিভিন্ন সময়ে চেষ্টা করেছে। এরপর আবার তাদেরকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।
তিনি বলেন, লন্ডনের ঘটনার পর বাংলাদেশকে সতর্ক হতে হবে। বড় ধরণের কোন স্থাপনায় হামলার ঘটনা ইতোপূর্বে না হলেও আগামী দিনে হতে পারে। সেই আশঙ্কা থেকে সতর্কতা মূলক ব্যবস্থা বাড়ানোর পাশাপাশি নজরদারী বাড়াতে হবে। কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।সবচেয়ে বড় কথা কোন ঘটনা ঘটলে সেই ঘটনা কারা করেছে সেটা না প্রাধান্য দিয়ে অপরাধীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টানমূলখ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, লন্ডনের ঘটনাটি যে ঘটিয়েছে যে বৃটিশ নাগরিক। এই কারণে এখনই তারা লন্ডনে প্রবেশের ব্যাপারে হয়তো বড় ধরণের কড়াকড়ি আরোপ করবে না। তবে সতর্কতা বাড়াবে।
আর তারা ওই ব্যক্তিকে একবার এর আগে সন্দেহজনক আচরণের কারণে আটক করেছিল। কিন্তু কিছু না পাওয়ার কারণে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাকে ছেড়ে দিয়েছিল। এখন এই ধরণের ঘটনা লন্ডন কেন কোন দেশের পক্ষেই কিংবা কোন দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে বন্ধ করা সম্ভব হবে না। আবার আগামও ধরা সম্ভব না। কারণ সে একটি ছুরি দিয়ে এত বড় ঘটনা ঘটিয়েছে। এই ঘটনা থেকে এটা বোঝা যাচ্ছে সন্ত্রাসীরা অগ্নেয় অস্ত্রবহণ করার চেয়ে ধারালো অস্ত্রকে প্রাধান্য দিচ্ছ। আর এই ঘটনাটি এমন নয় যে এটা খুব সংঘবদ্ধভাবে করা হয়েছে।একজন মানুষ একটি ছুরি নিয়েছে, গাড়ি নিয়েছে, একের পর এক হামলা করেছে। ছুরি দিয়ে পুলিশসহ ৪০ জনকে আহত করেছে।
তিনি বলেন, একজন মানুষ সাধারণ মানুষ চলাচল করলে তাকে সব সময় নজরদারি করা সম্ভব হবে না। তা না করতে পারার কারণে সমস্যা বাড়বে। এই ধরণের আরও হামলার সুযোগও থেকে যাচ্ছে। তবে এটা কোন দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে আগে রোধ করা সম্ভব হবে না।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটছে। সেখানে জঙ্গিদের ব্যাপারে তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, আইজি, ডিআইজি, এসপি, থানার ওসি, র্যাব ও ঘটনাস্থলে যে সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করে তারা একেক জন একেকক রকম স্টেটমেন্ট দেয়। আর প্রথম সুযোগেই এটাকে রাজনৈতিক পরিচয় দেওয়া হয়। তখন বিষয়টি নিয়ে তর্ক বিতর্ক হয়। এছাড়াও যেটা করা হয় বলা হয় নব্য জেএমবি করছে। আমি বুঝতে পারি না। ঘটনা ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে কিভাবে ওটাকে বলা হয় যে নব্য জিএমবি করেছে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে এই ধরণের ঘটনা ঘটনার সম্ভাবনা রয়েছে এমন বিবেচনা করে এখানে নজরদারী বাড়াতে হবে। চেক পোষ্টগুলো বসানো হয়। এতে সাফল্য আসে না। হয়রানী বাড়ে। এই চেকপোস্টে পাহারা যেভাবে করা হয় সেইভাবে হবে না। নজরদারিটা আরও আধুনিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করে করতে হবে।
তিনি বলেন, হোমগ্রোন বলে যাদেরকে বলা হচ্ছে তাদেরকে নির্মূল করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই কারণে কয়েকদিন পর পর আমরা শুনি তারা হামলা করছে। কিন্তু আমার মনে হয় এগুলো না বলে যদি তাদেরতে সমূলে উৎপাটনের ব্যবস্থা নেওয়া হয় সেটা কাজে আসবে। এছাড়াও গোয়েন্দা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়টা যথাযথ হওয়া দরকার।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আজম খান বলেন, লন্ডনের হামলাটি একটি নতুন ধরণের সন্ত্রাসী হামলা। এর আগে ছুরি দিয়ে এক দুইজনকে আহত করার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু একসঙ্গে পুলিশসহ মানুষ মারা, ৪০ জনকে আহত করা আবার নিজেও মারা গেছে। এতে করে বোঝা যায় যে অপরাধীরা ধরণ পাল্টাচ্ছে। তবে এই ঘটনাটি কের ঘটিয়েছে। তা আগে বের করতে হবে। আর ঘটনাটির কারণ বের করে তারা হয়তো সেটাকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিবে। আর ওই ব্যক্তি একাই সব করেছে এমনতো নয়। আটজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আরও কেউ কেউ জড়িত থাকতে পারে।
তিনি বলেন, লন্ডনের ঘটনায় বাংলাদেশে তেমন কোন প্রভাব পড়বে না। কিন্তু যেটা হতে পারে এই ঘটনার কৌশলগুলো দেশের জঙ্গিরা কিংবা সন্ত্রাসীরা অনুকরণ করতে পারে। সেটি বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে,আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ও গোয়েন্দাদের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। নজরদারী বাড়াতে হবে। চেকপোস্টে এখন যা করা হয় তাতে হয়রানী বেশি হয়। এই সিস্টেমে পরিবর্তন করে আধুনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। যাতে করে প্রকৃত চেকিং করা হয়। এখানে চেক পোস্টে গাড়ি পাহাড়া দিয়ে ও চেক করে অস্ত্র উদ্ধার হয় না, বোমাও উদ্ধার হয় না। কিন্তু সময় নষ্ট হয়। যানজট বাড়ে। এই অবস্থায় বাংলাদেশকে সতর্ক হতে হবে যেহেতু আমাদের এখানে বাইরের সন্ত্রাসী ও আইএস নেই বলে সরকার দাবি করে সেই জন্য অপরাধীরা বিভিন্ন ধরণের কৌশল নিতে পারে। তাই আগামী দিনে আমাদের স্থাপনাগুলোকে নিরাপত্তা আরও জোরদার করার পাশাপাশি অভিযানও পরিচালনা করতে হবে। তবে একটা কথা সরকারকে মনে রাখতে হবে রাজনৈতিক ভাবে অপরাধ বিচার করলে আর সব ঘটনা বিএনপির উপর আর নামধারী জঙ্গিদের উপর চাপালে হবে না। অপরাধীদের পরিচয় নিশ্চিত করে অপরাধ চিহ্নিত করে এরপর বিচারের মুখোমুখি করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
তারা বলেছেন, লন্ডনের ঘটনার পর ওই সেখানকার প্রধানমন্ত্রী ঘটনাকে কোন রাজনীতিকরণ করেননি। আবার জঙ্গি বলেও বলেননি। কারণ তারা তদন্ত করেই ঘটনার উদঘাটন করবেন। এরপর ব্যবস্থা নিবেন।
আমেরিকায়, যুক্তরাজ্যে, প্যারিসে ঘটনা ঘটলে তারা ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্তদের বের করে ফেলে অনেক কম সময়ে। তাছাড়া রাজনীতিও করে না। অন্য দরের উপর দোষ চায় না। এখানে এটা করা হয়। এই প্রবণতা পরিহার করতে হবে। সম্পাদনা: বিশ্বজিৎ দত্ত