করুণার অবতার “শ্রীগৌরহরি”
শ্রীপাদ চারু চন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী
সাধারণ সম্পাদক , ইস্কন বাংলাদেশ।
ৃঅনর্পিতচরীং চিরাৎ করুণয়াবতীর্ণঃ কলৌ
সমর্পযিতুমুন্নতোজ্জ্¦লরসাং স্বভক্তিশ্রিয়ম্।
হরিঃ পুরটসুন্দরদ্যুতিকদম্বসন্দীপিতঃ
সদা হৃদয়কন্দরে স্ফুরতু বঃ শচীনন্দনঃ॥
যা পূর্বে দেওয়া হয় নাই- মানবজাতি যা পূর্বে জানতে পারে নাই; সেই ভগবদ্ভক্তির সর্বোত্তম শোভা সকলকে সম্যক্রূপে অর্পণ করবার জন্য মহাপ্রভু এসেছিলেন। তিনি যদি কতকগুলি কথা না বলতেন, তাহলে মানব জাতি পরজগৎ সমন্ধে অনেক বিষয়ে অজ্ঞ থাকত। তিনি দয়া করে সেই কথাগুলি সকলকে জানিয়ে দিয়েছেন। পূর্ব পূর্ব অবতারে পারমার্থিক সত্য যে প্রকারে উদ্ঘাটিত হয়েছিল তা মানুষ সাধারণভাবে জানতো। তিনি যে কথাগুলি বলেছিলেন তা মানুষ জানতো না এবং জানবার প্রয়োজনও মনে করে নাই। তাঁর দয়াতে জানতে পারি যে মানব জাতি দরিদ্র ছিল। তাঁর যথেষ্ট দয়া, কিন্তু মানব জাতির অনেকেই সেই কথাগুলি গ্রহণ করতে পারে নাই। যারা সেই কথাগুলি গ্রহণ করতে পেরেছে তারা অত্যন্ত লাভবান হয়েছেন। তাই মহাজনগণ গেয়েছেন- যদি গৌর না হইতো,তবে কি হইতো, কেমনে ধরিতাম দে। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেব যিনি পূর্ণ পুরুষোত্তম। তিনি আমাদের গৌরহরি। তিনি পূর্ণ পুরুষোত্তম হয়েও সাধারণ উপদেশকের ন্যায় জগতে অবতীর্ণ হয়ে নিজের সমন্ধে কথা বলেছেন। তিনি আত্ম ধর্ম সমন্ধে বলেছেন। প্রাপঞ্চিক অবস্থায় যেটুকু দেখা যায় সেইটুকু মাত্র প্রকাশ করবার জন্য যে তিনি এসেছেন তাহা নহে। গুণজাত জগৎ সমন্ধে মানুষ যেটুকু বুঝে সেইটুকু বুঝাবার জন্য তিনি আসেন নাই। তদ্ব্যতীত বলতে এসেছেন। করুণার অবতার গৌরহরি আমাদিগকে সর্বপ্রথম আত্মজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হইতে বলিয়াছেন। নতুবা আমরা আত্মার সহিত দেহ-মনের পার্থক্য কি করিয়া জানিব। আত্মা কিছু সময় মন, মন কিছু সময় আত্মা নয়। মন ব্যাহ্য জগতের দ্রষ্টা ও কর্তা। দশ ইন্দ্রিয় দ্বারা বাহ্য জগতের অভিজ্ঞান লাভ করিয়া জড় ভোক্তা, তাহার কত কিছু জ্ঞান, বিচার, আনন্দ সমস্তই বাহ্য জগৎ লইয়া। তাই আমাদের গৌরহরি জানিয়েছেন-
আত্মইন্দ্রিয় প্রীতিবাঞ্চা তারে বলি কাম।
কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতিবাঞ্চা ধরে প্রেম নাম।।
অতএব আমরা শ্রীচৈতন্য চন্দ্রের দয়ায় বুঝিতে পারি যে, শ্রীকৃষ্ণ অখিলরসামৃত সর্বশক্তিমান মূর্তি; তিনি সকল অবতারের অবতারী। তাহার ভজনা করিলেই সমস্ত ব্যষ্টি ও সমষ্টি বিষ্ণুর ভজনা করা হয়। এই সমস্ত নতুন বিষয় প্রচারিত করে শ্রীচৈতন্যদেব ভাগবত ধর্মের দরিদ্রতা, অসম্পূর্ণতা বিদুরিত করে ভগবৎসেবা ধর্মকে সমৃদ্ধ করেছেন। উন্নত উজ্জ¦ল সেবা রস পূর্বে জগতে দেওয়া হয় নাই । রাধাগোবিন্দের পরম রমনীয় লীলা কথা তিনি জগতে প্রকাশ করেছেন। জগতে যে সকল দানের পরিচয় আছে সেই সকল দান অল্পকাল স্থায়ী ও অসম্পুর্ণ । তারপর জগতে দানের সমষ্টিও অতি অল্প। যদি দান প্রার্থীর আশা ভরসা বেশী থাকে তাহলে সেই সকল দাতা প্রার্থীগণের আশানুরূপ দান দিয়ে উঠতে পারেন না। পন্ডিত মূর্খগণকে, ধনবান দরিদ্রগণকে, স্বাস্থ্যবান রোগীগণকে, বুদ্ধিমান নির্বুদ্ধিগণকে তাদের আশানুরূপ দান দিয়ে উঠতে পারেন না। কিন্তু গৌর সুন্দর মানব জাতিকে যে দান প্রদান করেছেন, মানব জাতি ততবড় দানের আশাও প্রার্থনা করতে পারে নাই। এতবড় দান জগতে আসতে পারে, জীবের ভাগ্যে বর্ষিত হতে পারে একথা মানব জাতি পূর্বে ভাবতে ও আশা করতে পারে নাই। শ্রীগৌর সুন্দর যে অপূর্ব দান মানবজাতিকে দিয়েছেন, তা সাক্ষাৎ ভগবৎপ্রেমা। জগতে প্রেমের বড়ই অভাব; সেই জন্যই হিংসা, বিদ্বেষ, কামনা, অন্যান্য জীবকুলকে এত ক্লেশ প্রদান করছে।
পারেন শ্রীচৈতন্যদেব সেই রূপ মহাবদান্য।
শ্রীগৌরসুন্দর মুঢ় জীবের প্রতি পরম-করুণা-পরবশ হইয়া আমরা যে ভাষায় তাহার কথা বুঝিতে পারিব, সেই ভাষায় আমাদের নিকট হরি কীর্তন করিয়াছেন। ভক্তগণের হৃদয়ে তিনি পূর্ব্ব পূর্ব্ব অবতারে যে সকল ভাব উদয় করাইয়াছিলেন কেবল মাত্র তা দৃশ্যত দান করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই । পরন্তু তিনি এই যুগে অনর্পিত বস্তু দান করিয়াছেন। তিনি স্বীয় উন্নতোউজ্জ¦লরসময়ী স্বভক্তি শোভা প্রদান করিবার জন্য, জগতে সকল জীবকে কৃষ্ণ প্রেম বিতরণ করিবার জন্য তিনি জগতে আসিয়াছেন। পরম করুণাময় গৌরহরি কলিযুগের জীবের দুঃখ দর্শণ করিয়া গোলকের প্রেমধন হরিনাম সংকীর্তন জগৎধামে প্রচার করিয়াছেন।
পরম করুনাবতার শ্রীগৌরসুন্দর বলিয়াছেন- শ্রীকৃষ্ণ সংকীর্তনই মানব জাতির একমাত্র পরকৃত্য। এটি তাঁহার মহাবদান্যতা । শ্রী চৈতন্যচন্দ্রের দয়া যিনি বিচার করিবার সৌভাগ্য লাভ করিয়াছেন, তাঁহার নিরন্তর চৈতন্য-চরণ কমল সেবা ব্যতীত অন্য কোন অভিলাষ মুহুর্তের জন্য হৃদয় উদিত হইতে পারে না। তাই শ্রীল কৃষ্ণদাস করিরাজ গোস্বামী বলিয়াছেন।
চৈতন্যচন্দ্রের দায় করহ বিচার ।
বিচার করিলে চিত্তে পাবে চমৎকার।।
পরিশেষে প্রার্থনা সেই করুণার অবতার শচীনন্দন শ্রীগৌরহরি সর্বদা সকলের হৃদয় কন্দরে স্ফুরিত হোন।