ব্রজগোপিকাদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের প্রেম পরকীয়া নয় স্বকীয়া
শ্রী সুদর্শন নিমাই দাস
ব্রজগোপিকাদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের সম্পর্ককে অনেকেই পরকীয়া প্রেম বলে মন্তব্য করেন। আপাতদৃষ্টিতে গোপীদের পরস্ত্রী মনে হলেও এর পেছনে রয়েছে এক গভীর তত্ত্ব। ব্রহ্মা যখন কৃষ্ণের ভগবত্ত্বা পরীক্ষা করার জন্য তাঁর সঙ্গের সমস্ত গোপবালক এবং গোবৎসদের হরণ করেন, তখন কৃষ্ণ নিজের দেহ থেকে সমস্ত গোপবালক ও গোবৎসদের অবিকল প্রতিমূর্তি প্রকাশ করেন। অর্থাৎ সেসময় বৃন্দাবনের সমস্ত ব্রজবাসীদের পুত্র এবং বাছুরেরা একেকজন স্বয়ং কৃষ্ণ। আর সেসময় বৃন্দাবনের সমস্ত গোপবালকদের সঙ্গে গোপীদের বিবাহ হয়। অর্থাৎ সমস্ত গোপিকাদের বিবাহ কৃষ্ণের সঙ্গেই হয়। (পরবর্তীতে ব্রহ্মা যখন ভুল বুঝতে পেরে গোপবালক ও গোবৎসদের ফিরিয়ে দেন, তখন গৃহে ফিরে এসে গোপবালকরা সব বুঝতে পারে এবং সকল গোপিকাদের তারা নিজের স্ত্রী নয়, বরং কৃষ্ণের স্ত্রী হিসেবেই সম্মান করে।) কেউ-ই শ্রীকৃষ্ণের পর নয়: তাছাড়া, কে কৃষ্ণের পর? প্রতিটি জীব তাঁরই অংশ। পরমাত্মারূপে শ্রীকৃষ্ণ সকলেরই হৃদয়ে একান্তে রয়েছেন। তাই, যদি সকলেই তাঁর আপন হয়, ব্রজগোপিকাদের সঙ্গে তাঁর প্রেম কী করে পরকীয়া হয়? অবতারী শ্রীকৃষ্ণ থেকে যেভাবে রাধারাণীসহ সমস্ত অবতারের বিস্তার হয়, তেমনি শ্রীমতি রাধারাণী থেকে সমস্ত লক্ষ্মী, মহিষী ও ব্রজদেবীগণ প্রকাশিত হন।” সুতরাং, গোপিকারা সকলেই কৃষ্ণের শক্তি, যা তাঁর হৃদয়ে ছিল। আর যেহেতু তিনি ইচ্ছাময় হরি, তাঁর ইচ্ছায় তিনি সেই শক্তিকে রূপদান করে তাঁদের সঙ্গে বিহার করেছিলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর নিজ আত্মার সঙ্গে বিহার করেছেন সেই আত্মাকে দেহ ধারণ করিয়ে। সুতরাং, তা পরকীয়া নয়। কৃষ্ণ সকলের পতি: আমাদের প্রত্যেকের মা-ই অনিত্য ও প্রাকৃত দেহধারী তথাকথিত পতির সেবা করছেন। আবার, এ জগতে মেয়েরা চায়, “আমার পতি হবে সবচেয়ে সুন্দর, শিক্ষিত, ঐশ্বর্যশালী ও বীর্যশালী (শক্তিমান)। কিন্তু জগতে এমন কোনো পুরুষ আছে কি যিনি পরমেশ্বর কৃষ্ণের সমান বা তাঁর থেকে বড়? নেই। তাই ব্রজবধূগণ কৃষ্ণকে তাদের পতিরূপে পাওয়ার জন্য কাত্যায়নী দেবীর পূজা করেছিলেন এবং কৃষ্ণকে পতিরূপে প্রাপ্ত হয়েছিলেন।
আবার, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে, কৃষ্ণ হচ্ছেন সমস্ত কিছুর পরম ভোক্তা (পুরুষোত্তম)। আর সবকিছু হচ্ছে প্রকৃতি বা ভোগ্যবস্তু। তাহলে ব্রজবালাগণ কি কৃষ্ণের উপভোগ্য নয়? কিন্তু আমরা দেহাভিমানের কারণে নিজেদের পুরুষ (আমি ভোক্তা) ভাবছি। তার ফলে সীমাহীন দুঃখ-কষ্ট ভোগ করছি। কিন্তু ব্রজগোপীকারা জানতেন যে, কৃষ্ণ তাদের নিত্য পতি, তাই তাঁরা তাঁদের নিত্য পতির সঙ্গে বিহার করেছেন একান্তে। একান্তে সঙ্গ করার জন্য আমরা কখনো পিতামাতার নিন্দা করি না। বরং তাদেরই সবচেয়ে বেশি সম্মান এবং শ্রদ্ধা করি। যদিও কৃষ্ণ আমাদের পিতা এবং মাতা উভয়েরই, এমনকি প্রত্যেকের পতি। তিনি জগৎপতি। যদি তা-ই হয়, তবে সেই পরমপতি কৃষ্ণ যে একান্তে গোপিকাদের সঙ্গ দিয়েছেন, তা কি দোষের? নাকি তা কৃষ্ণের অধিকার?
তাছাড়া ‘পতি’ বলতে কেবল স্বামীকে বোঝায় না। ‘পতি’ মানে যিনি পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণ করেন। যেমন, সভা পরিচালনা করেন সভাপতি, রাষ্ট্র পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণ করেন রাষ্ট্রপতি। একইভাবে গোপিকারা সর্বতোভাবে শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হয়ে তাঁর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে চেয়েছিলেন। সেজন্য তারা শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে কামনা করেছিলেন। ভক্ত ও ভগবানের মিলন: এখন প্রশ্নÑ কৃষ্ণ, যিনি হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান, যে কথা সমস্ত বৈদিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে, তিনি যদি ব্রজবালাদের আলিঙ্গন দান করেন, তাতে দোষ কী? কোন অজ্ঞ ব্যক্তি আছে, যে পরমেশ্বরের দৃঢ় আলিঙ্গন পেতে চায় না? ধরুন, কারো মা মহান কৃষ্ণভক্ত, প্রতিদিন নিষ্ঠা সহকারে কৃষ্ণের সেবা করেন, রোজ নানা রঙের সুগন্ধি ফুলের মালা গেঁথে শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহের সামনে দাঁড়িয়ে অঝোরে কান্না করতে করতে মালাটি তাঁর গলায় পরিয়ে দেন এবং তিনি সবসময় প্রতীক্ষায় থাকেনÑ কবে তিনি সাক্ষাৎ শ্রীকৃষ্ণের গলায় মালা পরিয়ে দিবেন! একদিন সত্যিই শ্রীকৃষ্ণ তার সামনে আবির্ভূত হলেন, আনন্দে আত্মহারা হয়েও মা তাঁকে প্রণাম করে হাতের মালাটি পরিয়ে দিলেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ করুণা করে তাঁর শুদ্ধভক্তকে (সেই মাকে) দৃঢ় আলিঙ্গন দান করলেন। আর তা দেখে সেই মায়ের পতি অথবা অন্য কেউ যদি শ্রীকৃষ্ণ এবং সেই মায়ের নিন্দা করে, তাহলে বুঝতে হবে সে ভগবৎ-বিদ্বেষী অসুর।
সে উপলব্ধি করতে পারে না যে, ভক্ত এবং ভগবানের মিলন কতই না মধুর! তাছাড়া আলিঙ্গন হচ্ছে ভালোবাসার একটি বহিঃপ্রকাশ। ঠিক যেমন, ভালোবেসে প্রভু ভৃত্যকে আলিঙ্গন করে, বন্ধু বন্ধুকে আলিঙ্গন করে, মাতা তার পুত্রকে আলিঙ্গন করে, চুম্বন করে, পতি পতœীকে আলিঙ্গন করে। আর রাসলীলায় পরমেশ্বর ভগবান আলিঙ্গন করেছেন তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ ভক্তদের।