একাত্তরের ২৫ মার্চ ও মুক্তিযুদ্ধ
ডা. এম এ হাসান
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী
এরপর অনেক বাঙালি ইপিআরকে বন্দী করা হয়। এদেরকে পরে রমনা কালিবাড়ির সামনে নিয়ে হাতবাঁধা অবস্থায় গুলি করে ইপিসিএফ অফিসার মেজর গোলাম মোহাম্মদ। সে অবাঙালি ছিল। ২৫ মার্চের আঁধার কাটতে না কাটতে একটি রেডিও থেকে প্রচারিত হয় বঙ্গবন্ধু উচ্চারিত স্বাধীনতার ঘোষণা। ওই সম্প্রচার যন্ত্র যে ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করেছিলেন তাকে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা।
ইপিআরগণ অসাধারণ সাহস প্রদর্শন করে দেশের নানা প্রান্তে পাকিস্তানিদের কোণঠাসা করেছিল। তাদের সাহসী ভূমিকা পাকিস্তানিদের মনোবল ভাঙতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। অপরদিকে ২য় বেঙ্গল এবং ১ম বেঙ্গল ছাড়া অন্যান্যদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব হওয়ায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাঙালি সেনাগণ। ওই সময় ৩য় বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার কর্নেল জলিল ও ২য় বেঙ্গলের কর্নেল রকিবের মতো কাপুরুষসহ কিছু বাঙালি কুলাঙ্গারদের কারণে বড় ধরনের মূল্য দিতে হয় সাধারণ সেনা ও নিম্ন পর্যায়ের অফিসারদেরকে। এরপরও মুক্তিযুদ্ধে বেঙ্গল রেজিমেন্টসহ বাঙালি সেনাদের ভূমিকাকে অসাধারণ বললে কম বলা হবে। কতিপয় শহুরে যুবক ও অপরিণত বালকের ক্ষণিকের সাহসিকতা বা বানোয়াট গল্প দিয়ে তাদের অবদানকে খর্ব করাটা হবে অমার্জনীয় অপরাধ। ২৫ মার্চ প্রতিরোধ সম্পর্কে নানা মত রয়েছে। অতিরঞ্জিত মিথ্যে ইতিহাস রয়েছে। প্রথম বচনে ব্যক্ত কথ্য ইতিহাস থেকে সত্যিকারের ইতিহাস বের করা অতি কঠিন। সত্যিটা হলোÑ ২৫ মার্চ রাতে পুলিশ ও ইপিআর বিশেষ করে ইপিআরদের সাহসিক প্রতিরোধ। এই সাহসিকতা ছড়িয়ে যায় সাধারণ জনগণের মাঝে। যে কারণে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, চুয়াডাঙ্গা, দিনাজপুর ও রংপুরে সাধারণ মানুষ শুরুতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে ঢাকার প্রতিরোধকে অনুসরণ করে। চট্টগ্রামে প্রতিরোধ শুরু হয় ২৫ মার্চ রাতে মেজর রফিকের নেতৃত্বে। আর রংপুরে সমতলের আদিবাসী সাঁওতালসহ হাজার হাজার মানুষ ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করে ২৮ মার্চ ’৭১-এ। প্রায় ১ হাজার সাধারণ মানুষকে ক্যান্টনমেন্টে ঢুকিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা।
২৫ মার্চ রাতে জগন্নাথ হলে ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মচারী মিলে প্রায় ৭০ জনকে হত্যা করা হয় এবং গণকবরে মাটিচাপা দেওয়া হয়। ওই ৭০ জনের মধ্যে ৪১ জন ছিল ছাত্র ও শিক্ষক। ৪১ জনের মধ্যে ১ জন ছিল মুসলমান। তিনি ছিলেন ড. মুনিরুজ্জামান। ড. অধ্যাপক গোবিন্দচন্দ্র দেব-এর পালিত কন্যা রোকেয়া বেগমের স্বামী মোহাম্মদ আলী ও ড. অধ্যাপক গোবিন্দচন্দ্র দেবকে একসঙ্গে মাটিচাপা দেওয়া হয়। ইকবাল হলের প্রায় ২০০ ছাত্রসহ ৫ শতাধিক ছাত্র ও শিক্ষক হত্যা করা হয় ২৫ মার্চ ’৭১-এ। পুরো ঢাকা শহর এবং পুরান ঢাকা মিলে ওই রাতে প্রায় ৭ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। ২৭ তারিখে আদমজী ও টঙ্গীসহ বৃহত্তমর ঢাকায় ওই সংখ্যাটি প্রায় ২৩ হাজারে পৌঁছে। অনেকের মতে ওই রাতে ৫০ হাজার লোককে হত্যা করা হয়।
কুমিল্লা, সিলেট, হবিগজ্ঞ ও নোয়াখালিতে ২য় ও ৪র্থ বেঙ্গল, চট্টগ্রামে ১ম বেঙ্গল, উত্তরবঙ্গে মেজর নাজমুল, দক্ষিণবঙ্গে মেজর জলিল, পশ্চিমে ৮ম বেঙ্গল মোড় ঘুড়িয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধের। তাদের অধীনস্থ সেনা ও শিষ্যগণ দেশের মাঝে কাজ করেছে। মুক্তিযোদ্ধারাই ২৫ মার্চ থেকে যুদ্ধটা এগিয়ে নিয়েছে ’৭১-এর ২২ নভেম্বর পর্যন্ত। এরপর দৃশ্যপটে যৌথবাহিনী। মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধটা যেমন আসে বাঙালি সেনাদের পক্ষে তেমনি ঢাকার অভ্যন্তরে প্রথম প্রবেশ করে তারাই। এটা ঘটে ১৪ ডিসেম্বর ৭১-এ। ২য় বেঙ্গলের এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে ওই আক্রমণ চালায় লেখক (ডা. এম এ হাসান) নিজে। (সূত্র: মেজর জেনারেল মঈনুল হোসেন চৌধুরীর আত্মকাহিনী)
’৬৯-এ আইয়ুবের পতনের পরই পাকিস্তান সামরিক গোয়েন্দারা ’৬৯-এর আন্দোলন ও আইয়ুবের পতনের কারণ নিয়ে কাজ করছিল। অনেকের মতে ওই সময় সিআই-এর সঙ্গে পাকিস্তানি সামরিকজান্তার কথা হচ্ছিল। দৃশ্যপটে ইয়াহিয়া আগমনের আগেই পরিকল্পনা ঠিক করা হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ ব্যাপক গণহত্যা ও গুমের বিষয়টি তখন থেকে সামরিক প্রভুদের মাথায়। সব হিসাব উল্টে দেয় পূর্ব বাংলার জনগণ। তাদের পথ চলার সঙ্গে সঙ্গে নানা মত, পথ ও স্রোতের মিলন এবং পথ পরিবর্তনই জনগণের স্বপ্ন ও সংকল্পকে পরিপক্ক করে। এ অবস্থায় কালজয়ী পথপ্রদর্শক ও শতাব্দীর নেতার মতোই ভূমিকা রাখলেন বঙ্গবন্ধু।
মিথ সৃষ্টিকারী মহানায়কের মতোই পথের দিশা দেন তিনি। তার স্বপ্নের সঙ্গে একাকার হয়ে যায় জনগণের স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা। মুক্তিযুদ্ধটা কোনো সূচিকর্ম ছিল নাÑ বাধাঁ পথে অনেক কিছু চলেনি, তারপরও শেষ হাসি হেসেছে মুক্তিসেনারা এবং এ দেশের জনগণ। (শেষ পর্ব)
সম্পাদনা: আশিক রহমান