জঙ্গিবাদ দমন : শর্ত নয়, সমাধান
প্রতীক ইজাজ
বারবার জঙ্গি হামলা হয়। মানুষ মারা যায়। দেখা দেয় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। সতর্ক হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। উত্তপ্ত হয় রাজনীতি। মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী দলের নেতারা দোষেন একে অন্যকে। সংকট নিরসনের কথা বলেন বিশ্লেষক-বিশেষজ্ঞরা। গণমাধ্যম সাধ্যমতো চেষ্টা চালায় অনুসন্ধানের। সামনে আসে নানামত, নানাদিক। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ‘জাতীয় ঐকমত্য’। এভাবে চলতে থাকে কিছুদিন। জঙ্গিরা আবারো স্তিমিত হয়। থেমে যায় সব। রাজনীতি, সমাজ, সরকারÑ চলতে থাকে যে যার গতিতে। কেবল ক্ষত থেকে যায় মানুষের মনে। পেছনে ঘুরতে থাকে প্রগতির চাকা। গত বছরের জুলাইয়ে হলি আর্টিজানে হামলা হলো। ২০ নিরীহ মানুষকে নৃশংসভাবে খুন করল জঙ্গিরা। শোকে বেদনায় স্তুব্ধ হলো দেশ। সরব হলো রাজনীতি। জঙ্গি দমনে নানা পথ বাতলে দিলেন চিন্তকরা। তৎপরতা বাড়ল সরকারের। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে একটা শক্ত জনমত তৈরি হলো। সর্বকণ্ঠে, বিএনপিও বলল, ‘জাতীয় ঐকমত্য’র কথা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও বলল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আটকে গেল শর্তে, দুই বড় দলের পরস্পরকে বিষোদ্বগারে। কাজের কাজ কিছুই হলো না।
গত ১৫ মার্চ বুধবার চট্টগ্রামের সীতাকু-ে একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে আটক হলো জঙ্গিরা। আত্মঘাতীতে মারাও গেল। দুদিন পর শুক্রবার ঢাকার আশকোনায় র্যাবের ক্যাম্পে (ভবিষ্যৎ হেড কোয়ার্টার) আত্মঘাতী হামলা চালাল এক জঙ্গি। পরদিন খিলগাঁওয়ে র্যাবের তল্লাশি চৌকিতে আত্মঘাতী হামলার আগেই র্যাবের গুলিতে মারা গেল আরেক জঙ্গি। আবার আমরা নড়ে উঠলাম। রাজনীতি সরগরম হলো। আগের মতোই দুষলাম পরস্পরকে-আওয়ামী লীগ বিএনপিকে, বিএনপি আওয়ামী লীগকে। ক্ষীণকণ্ঠে জাতীয় ঐকমত্যের কথাও বললেন কেউ কেউ। বিএনপিও। কিন্তু কোনোই কাজ হলো না। বাতাসে খেল দাবিমালা। যখনই হামলা হয় গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে দায়িত্ব পড়ে বিশ্লেষণে, সমাধানে পথ অনুসন্ধানে। বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলি। ক্ষুব্ধ মন নিয়ে যতেœর সঙ্গে তুলে ধরি যুক্তি-তর্ক-বিতর্ক। একটা সমাধান মেলে। স্বস্তি পাই; যত না পেশাগত, তার চেয়ে নাগরিক হিসেবে বেশি। মনে প্রশ্নও জাগে নানা। চায়ের কাপে চুমুক দিই। মস্তিষ্ক কাজ করে না। ঘুরেফিরে কতগুলো শব্দ তাড়া করে, নিশ্চয় আরও অনেককেইÑ ‘জাতীয় ঐকমত্য’, ‘সর্বজনীন সংহতি’, ‘ব্যক্তি অভিধা’, ‘মুক্ত চেতনা’। আবার সেই রাজনীতিতেই ফিরে যাই।
জঙ্গি দমনে রাজনৈতিক দল-শীর্ষ নেতা-সরকারের মন্ত্রীরা এই যে এত কথা বলেন, উদ্বেগ উষ্মা প্রকাশ করেন, আমি হলফ করে বলতে পারি এর সবই তারা করেন দলের স্বার্থে, ব্যক্তি স্বার্থে। রাজনীতির এমন সুকঠিন বৃত্তায়ন, এমন শাসন-তোষণ, তার আগল ভেঙে সত্য উচ্চারণের সাহস আজ আমরা পাই না। তাই জাতীয় সংকট, অনাস্থা কিংবা দোদুল্যমানতা কাটাতে ঐক্যবদ্ধ হতে পারি না। সৎ সাহস নিয়ে দাঁড়াতে পারি না নাগরিকের পাশে। তাই সঙ্গতই প্রশ্ন জাগেÑ আসলেই কি আমরা জঙ্গি দমন চাই; নাকি জঙ্গিকে ইস্যু করে খুলতে চাই রাজনীতির নতুন ঘেরাটোপ? এ প্রশ্নের উত্তর না, আমরা চাই সমাধান। রাজনৈতিক দলগুলো আজ শুধুই খোলস। দলীয় স্বার্থের বাইরে কোনো বক্তব্য নেই, ভাবনা নেই। দল ও ব্যক্তি স্বার্থসংকীর্ণতায় আচ্ছাদিত। রাষ্ট্রের চেয়ে ঘর এখন অনেক প্র্রিয় আমাদের। সর্বজনীতার চেয়ে প্রিয় ব্যক্তি। ‘আমি’র জন্য ভাবতে ভাবতে ভুলতে বসেছি ‘আমরা’। জলকাদায় ডোবা দুর্গন্ধযুক্ত রাস্তা পেরিয়ে ঘরে উঠি। তকতকে মেঝে, সুগন্ধি বাথরুম, ফুলগাছশোভিত বারান্দা দেখি। সন্তানের গালে চুমু এঁকে দিই। রাষ্ট্রে দেখি না। নাগরিক দেখি না। রাস্তাঘাট, ল্যাম্পপোস্ট, ডাস্টবিনÑ আমার ভাবি না। একদলা থুথু পথে ছিটিয়ে রুমালে মুখ মুছে হাসিমুখ নিয়ে ঘরে ফিরি। ভাবি না, পরে যখন পথে নামব সেই থুথু ফিরবে আমারই মুখে এমনকি প্রিয় সন্তান স্ত্রী স্বজনের মুখে।
যতদিন বিশ্বে অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা থাকবে, ততদিন সন্ত্রাস থাকবে, ধর্মীয় উগ্রতা থাকবে। ধর্ম এখন ধনী রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতা ও আধিপত্যের মোক্ষম অস্ত্র। তাই জঙ্গিবাদ যত না নির্মূল, তার চেয়ে বেশি ভাবতে হবে প্রতিকারের কথা, যেতে হবে দমনের পথে। ধর্মীয় উগ্রতাবাদ এক ধরনের আদর্শ। এর বিরুদ্ধে লড়তে হবে ধর্মীয় উদারতার আদর্শ দিয়ে। সে জন্যই রাজনীতির বিভেদ ভুলে, ভোটরাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন থেকে বেরিয়ে, একটি ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম চাই আমাদের। অন্তত জঙ্গিবাদের মতো জাতীয় ইস্যুগুলোতে জাতীয় ঐকমত্যের কোনোই বিকল্প নেই।
লেখক: সাংবাদিক, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
সম্পাদনা: আশিক রহমান