কবি শ্রীজাতের বিরুদ্ধে মামলা ও বিবিধ গল্প
কাকন রেজা
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ভারতাধীন ‘পশ্চিমবঙ্গ’ অধুনা ‘বাংলা’র এক কবি শ্রীজাত বন্দোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা দায়ের করেছে সেখানকার পুলিশ। কবির বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করেছেন। ফেসবুকে কবিতা পোস্ট করেছেন, আর সেই কবিতাতে তিনি ‘হিন্দু’ ধর্মে পবিত্র মানা ত্রিশূলসহ ধর্মীয় বিষয়াদির পবিত্রতা নষ্ট করেছেন। শ্রীজাতকে ‘বাংলা’র নতুন প্রজন্মের পরিচিত ও প্রিয় কবি বলেন অনেকেই।
প্রথমেই বলে রাখি, অভিযুক্ত ‘কবিতা’টি ফেসবুকের কল্যাণে আমিও পড়েছি। কবিতা ও কবির বিরুদ্ধে মামলা এ দুটো বিষয়েই আমি কিছু বলতে চাইছি না। সাম্প্রতিক সময়ে কোনো লেখক, কবি ও সাংবাদিক আক্রান্ত হওয়ার প্রতিবাদে আমার উল্লেখযোগ্য কোনো লেখা প্রকাশিত হয়নি। আক্রান্তরা আমাদের দেশের হোক বা ভিনদেশের। সুতরাং আমি মনে করি এক শ্রীজাতকে নিয়ে সেই অর্থে আমার প্রতিবাদী হওয়ার কোনো অধিকার নেই। আর সেজন্যেই আমার লেখা সেদিকে যাবে না। যাওয়া উচিত নয়। আমার ঘরে যখন আমি ‘ইমপার্শিয়াল’ হতে ব্যর্থ হব, তখন অন্যের ঘরে উঁকি দেওয়াকে আমি অন্যায় মনে করি, আস্পর্ধা হিসেবে ভাবি। সে কারণেই প্রায়শ আমি ‘বৈপরীত্য’ নিয়ে কথা বলি, লিখি। প্রতিবাদে যখন ‘ইনটেনশন’ যোগ হয় তখন তাকে প্রতিবাদ হিসেবে ‘মেনশন’ করা যায় না। আর ‘মেনশন’ করার মতো ‘প্রতিবাদ’ ও ‘প্রতিবাদী’ খোঁজার চেষ্টাতেই আমার বৈপরীত্য নিয়ে লেখা-লিখি।
কবি শ্রীজাতের কবিতা এবং তার মামলার খবরটি সামাজিক ও গণমাধ্যমে চাউর হবার পর সাম্প্রতিক অভ্যস্ততার দরুণ খুব বেশি চমকিত হইনি। কিন্তু ভ্রু কুঁচকেছে এ বিষয়ে সামাজিকমাধ্যমে বিভিন্ন জনের ‘কমেন্ট’ নিয়ে। একজন লিখলেন, অহেতুক ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করাটা এখন আমাদের ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে, অনেকটা এমন কথা। মজার ব্যাপার যিনি লিখেছেন তিনি কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তচিন্তক ‘বিজ্ঞানমনষ্ক’দের ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদার। আমাদের দেশের অনুভূতির আঘাতজনিত বিষয়াদিতে তার কোনো আঘাত লাগেনি বরং তিনি ‘শূলে’ ধার দিয়েছেন। একজনের মন্তব্য ছিল অনেকটা এ রকম, ‘পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি সরকার সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে, আদিত্যনাথ যোগি উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হবার পর মুসলিমদের মাংসের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে, মুসলমানদের ধর্মীয় অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, শ্রীজাতের মতো অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেছে ইত্যাদি। এই ভদ্রলোক দেশে আবার বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বিজেপির মোদির প্রশংসা করেছেন অতি সাম্প্রতিককালে। আরেকজন মোদির বাংলাদেশের রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব নিয়ে সোচ্চার। অথচ তারও মন্তব্য, ধর্মীয় বিষয়টি স্পর্শকাতর বিধায় এ নিয়ে না লেখালেখিই ভালো। একজন ‘মাধ্যম’ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিত্বেরও মতো অনেকটা এ রকমই। অবশ্য তিনি নিজ দেশের ক্ষেত্রে আবার ‘ভয়াবহ’ রকম মুক্তচিন্তক। গত হয়ে যাওয়া বইমেলায় ‘শ্রাবণ প্রকাশনী’ বিষয়ক ঘটনার দিকে তাকালেও এসব ‘মুক্তচিন্তকে’র চিন্তার দৌড় বোঝা যায়। বাংলা একাডেমি নিষেধাজ্ঞা দিল, তারা বললেন, ঠিক তো, ঠিক তো! আবার উঠে গেলে, তাও বললেন, ঠিক তো, ঠিক তো! আরে ভাই এটা সেল্যুকাস নয়, রীতিমতো ‘আলুকাস’! ‘আলু’ সব তরকারিতেই লাগে। আরও লাগে ‘জলপানে’র চিপসে, ফ্রেঞ্চফ্রাইয়ে, ঠিক কি না?
এ জন্যেই আমি বারবার বৈপরীত্য নিয়ে কথা বলি। সাম্প্রতিক আমার অনেক লেখাতেই বৈপরীত্যের ব্যাপারটি উঠে এসেছে। যদিও এক বিষয়ে বারবার বলতে ভালো লাগে না, আবার না বলেও উপায় কী! সবক্ষেত্রেই যখন ‘বৈপরীত্যে’র সঙ্গে দেখা হয়, চলতে গেলে পায়ে পায়ে ঠোকা লাগে, তখন তো নিরুপায়। বৈপরীত্যের আরও একটি নমুনা দিই। আমাদের অনেক ‘সেলিব্রেটি’ ও উঠতি সেলিব্রেটিরা কাজের চাপে ভয়াবহ রকম ব্যস্ত থাকেন। ‘পানাহার’ সহযোগে কিছু পার্টি এবং ‘ফোক ফেস্ট’ এর মতোন কিছু ব্যতিক্রমী আয়োজন ব্যতীত কোথাও খুব একটা যেতে পারেন না। তবে মন তো চায়, ‘দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে’। সেই উদ্দেশ্যেই মাঝেমধ্যে তারা বেরিয়ে পড়েন ছুটি বা অফ ডেতে। কিন্তু দেশের সড়ক তো আর রাতের লাস্যময়ী পার্টি না। সড়কে বেরিয়ে দেখা হয় আমজনতার প্রতিদিনের প্রাপ্য ‘যানজটে’র সঙ্গে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে বসেও ‘সেলিব্রেটি’গণ ঘামতে থাকেন। যানজট তাদের আনন্দে জট বাঁধিয়ে সব ভজঘট করে দেয়। তারা বিরক্তিতে সব ভুলে ‘জটে’ বসে ‘উন্নয়ন’ কেন্দ্রিক ‘হট’ স্ট্যাটাসে লিখেন, ‘আহা রে উন্নয়ন’!
আমি যাদের লেখার মূল সারাংশ জানালাম ‘তাহারা’ অনেকেই সেই ‘আহা রে উন্নয়নে’র প্রশ্নবোধক ‘অংশীদার’! ‘তাহারা কাদম্বিনীর সমগোত্রীয়, তাহারা মরিয়া প্রমাণ করিতে চাহেন তাহারা মরেন নাই’। ‘ইহাদের’ই একজন সড়কে এক আমজনতার দুর্ভোগ নিয়ে লিখেছিলেন, ‘বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্রতম ক্ষতি স্বীকার করে নিতে হয়’। আহারে, কী মধুর বচন! কী বৈপরীত্য! তবে স্বীকার না করে নিলেও আমজনতা যে দুর্ভোগের ‘শিকার’ হয়েছেন তা তাদের ‘ভজঘট’ স্ট্যাটাসেই প্রমাণিত হয়।
বৈপরীত্যের আরও কথা বলি। লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি এমন হিসাবে শ্রীলঙ্কা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে সরে গেছে। আমাদের দেশেও ‘রামপাল’ নিয়ে আন্দোলন চলছে। সুন্দরবন বাঁচাতে নানা কথামালা শোনা যাচ্ছে। এ নিয়ে আমার কোনো কথা নেই, আমিও চাই শুধু সুন্দরবন নয়, সারাদেশ বাঁচুক। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটি সারাবিশ্বেই বর্জিত। ঘরের পাশেই শ্রীলংকার উদাহরণ দৃশ্যমান। সেক্ষেত্রে বাঁচা এবং বাঁচানোর প্রশ্নে ক্ষতিকর এবং অলাভজনক জানা সত্ত্বেও কেন ‘প্রকল্প’টি বাতিলের দাবি না তুলে বিকল্প স্থানের প্রস্তাব করা! কেন ক্ষতিকরের ক্ষতি থেকে বাঁচাতে, পুরোপুরি বাতিলের দাবিতে দৃঢ় না থেকে নমনীয় হওয়া! সত্যিই সেল্যুকাস! ‘পরিবেশ’ যা নষ্ট করে তা সবখানেই করে। শুধু সুন্দরবন নয়, মধুপরের গজারি বনেরও করে। ঝড়ের সময় বাতাসকে নিজ বাড়ির ডানে-বামে পাঠানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। প্রলয় ‘অন্ধ’ সে ডান-বাম দেখে না। নিজে অন্ধ হলেও সে সময় বাঁচার পথ বন্ধ হয়ে যায়। সুতরাং ‘ডান’ ‘বাম’ করে কোনো লাভ নেই। ‘বাঁচতে হলে জানতে হবে’ এবং বুঝতে হবে।
‘ডান’ ‘বাম’ প্রশ্নে আবার পশ্চিমবঙ্গের কথায় ফিরি। কবি শ্রীজাত আদর্শিক জায়গায় বাম। ভারতের মূল ক্ষমতায় চরম ‘ডান’। যে সে ডান নয় ‘আরএসএস’ ‘শিবসেনা’ সমর্থিত ডান। পশ্চিম বাংলাতেও প্রাদেশিক ক্ষমতা ‘মমতা’র আয়ত্বে। বামদের হারিয়ে ক্ষমতা পেয়েছে মমতা এবং তার রাজনৈতিক উত্থান মধ্যপন্থি কংগ্রেসের হাত ধরে। যে কংগ্রেস মুখে সেক্যুলার হৃদয়ে ‘বহুব্রীহি’। মূলত ভারতের রাজনীতিটাই গোলমেলে। বহুজনের দেশে এ রকমই হয়। এখানে আদর্শিক দিকটা খুঁজে পেতে বিভ্রান্ত হতে হয়। এদের বাধ্য হয়েই চলতে হয় গোঁজামিল আর জোড়াতালিতে। সুতরাং শ্রীজাত পড়ে গেছে সেই গোলমালের মধ্যেই।
ফুটনোট: প্রসঙ্গ ছাড়াই একটি গল্প বলি। এক দেশের চালাক কিছু লোক চিন্তা করতে লাগল, কাজ ছাড়া, কষ্ট ছাড়া কী করে আরাম আয়েশে জীবন কাটানো যায়। এমন চিন্তা-ভাবনার মধ্যেই রাজার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। ঢোল পিটিয়ে জানান দেওয়া হলো, স্তাবক দরকার। খাওয়া-পরা, অর্থকড়ির কোনো চিন্তা নেই। সবি বেতনের অন্তর্ভুক্ত। চালাক কজন তো মহাখুশি। সবাই চাকরির আবেদন করল রাজার দরবারে। কিন্তু ইন্টারভিউতে টিকে গেল মাত্র তিনজন।
তাদের একজনকে রাজা জিজ্ঞাসিলেন,
‘সাঁজে অস্ত যায় রবি পূবে?
স্তাবক কহেন, ভুল কী হয় মহারাজের অনুভবে!’
পরের জনকে শুধালেন,
‘সকালে পশ্চিমে জাগে রবি?
স্তাবক কহেন, মহারাজ তো জানেন সবি!’
শেষ জনকে বললেন,
‘শ্রীজাতে লোকসান, জোটে ঘটে অপমান!
স্তাবক কহেন, কথা সত্য, রাজা হলেন ভগবান!’
তিন স্তাবক কেন টিকে গেল উপরোক্ত কাব্যাংশের সারাংশ ঘেটে কেউ কি বের করে নিতে পারবেন? পারা তো উচিত। ‘আক্কেল মন্দ কা লিয়ে’ ‘ইশারা’ বিষয়টিই তো ‘কাফি’ হওয়া উচিত।
সম্পাদনা: আশিক রহমান