এ সফর জনআশা পূরণে সহায়ক হবে কি?
ইকতেদার আহমেদ
লেখক: সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী রাষ্ট্র। স্থলসীমান্তে বাংলাদেশ দক্ষিণ পূর্বাংশের স্বল্প স্থান ব্যতীত তিনদিকে ভারত দ্বারা বেষ্টিত। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের স্থলসীমান্তের পরিমাণ ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার যা দৈর্ঘ্যে পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম স্থলসীমানা। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতীয় রাজ্যসমূহের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্থলসীমনার পরিমাণ সর্বাধিক ২২১৭ কিলোমিটার। এর পরের অবস্থানে রয়েছে ত্রিপুরা ৮৬২, মেঘালয় ৪৪৩, আসাম ২৬২ এবং মিজোরাম ১৮০ কিলোমিটার। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের স্থলসীমানার পরিমাণ ২৭১ কিলোমিটার। ভারতের পূর্বাংশে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী চারটি রাজ্যসহ অপর যে তিনটি রাজ্য যথা মনিপুর, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল রয়েছে এগুলোকে সম্মিলিতভাবে বলা হয় সেভেন সিস্টার্স। সেভেন সিস্টার্স সতের মাইল দীর্ঘ শিলিগুড়ি করিডোর যার অপর নাম ঈযরপশবহ ঘবপশ ঈড়ৎৎরফড়ৎ দ্বারা ভারতের মূল ভূ-খ-ের সঙ্গে সংযুক্ত। সেভেন সিস্টার্স স্থলবেষ্টিত এবং বাংলাদেশ দ্বারা অবরুদ্ধ হওয়ায় ভারতের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ সমৃদ্ধ সেভেন সিস্টার্স-এর সম্পদ আহরণপূর্বক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির উপযোগী করা এবং মূল ভূ-খ- থেকে বিভিন্ন বাণিজ্যিক পণ্য সড়ক পথে সেভেন সিস্টার্সে পৌঁছানো সময় সাপেক্ষে, ব্যয়বহুল ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অসাশ্রয়ী বিবেচিত। বাংলাদেশ যেমন স্থলসীমানায় তিনদিকে ভারত দ্বারা বেষ্টিত সেভেন সিস্টার্সের অন্তর্ভুক্ত ত্রিপুরা অনুরূপ তিনদিকে বাংলাদেশ দ্বারা বেষ্টিত।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষ বিভাজনের মধ্য দিয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলে বর্তমান বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তান নামে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ভারতবর্ষ বিভাজন পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সড়ক, রেল ও নৌ যোগাযোগ নিয়ন্ত্রিতভাবে অক্ষুণœ থাকলেও ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ পরবর্তী তা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৬৫ পরবর্তী ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য শূন্যের কোঠায় নেমে আসলেও খুবই সীমিত পর্যায়ে অবৈধ বাণিজ্য বা চোরাচালান অব্যাহত ছিল। বাংলাদেশ অভ্যুদ্বয় পরবর্তী সে চিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় দেখা যায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি সৃষ্টির পর দীর্ঘকাল আমদানি বাণিজ্যে ভারতের অবস্থান শীর্ষে ছিল। সম্প্রতি চীন ভারতের স্থলাভিষিক্ত হলেও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাপক বাণিজ্য বৈষম্য বিদ্যমান। ভারত হতে বাংলাদেশে বর্তমানে অবৈধভাবে অর্থাৎ চোরাচালানের মাধ্যমে যে পরিমাণ পণ্য আসে তা বিবেচনায় নেওয়া হলে বাংলাদেশই ভারতের বৃহত্তম পণ্য বাজার।
বর্তমানে বাংলদেশে আট লক্ষাধিক ভারতীয় দক্ষ বিবেচনায় বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত রয়েছে। এরা প্রতিবছর বাংলাদেশ হতে ভারতে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণ করে তা ভারতের জন্য পঞ্চম বৃহত্তম। বাংলাদেশের স্বনামধন্য ও নির্ভরযোগ্য থিঙ্কট্যাঙ্ক সিপিডির তথ্য মতে এ অর্থের পরিমাণ বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। তাছাড়া প্রতিবছর ভ্রমণ, শিক্ষা, চিকিৎসা ও কেনাকাটা সংশ্লেষে বাংলাদেশিরা ভারতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে এর পরিমাণ ভারতের সঙ্গে সামগ্রিক আমদানি বাণিজ্যের কয়েকগুন অধিক।
ভারতের পক্ষ হতে বাংলাদেশকে বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র বলা হলেও ভারতের আচরণে কতিপয় ক্ষেত্রে বৈপরিত্য পরিলক্ষিত হয়। ভারত যেভাবে বাংলাদেশকে কাঁটাতারের বেড়া দ্বারা আবৃত্ত করে রেখেছে তা কেবল পরস্পর বৈরী মনোভাবাপন্ন রাষ্ট্র যেমন ইসরাইল-ফিলিস্তিন, উত্তর কোরিয়া-দক্ষিণ কোরিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে দেখা যায়। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। আন্তর্জাতিক নদী আইন অনুযায়ী অভিন্ন নদীর ক্ষেত্রে দুটি দেশ পানির সম হিস্যার ভাগিদার। এ ৫৪টি নদীর মধ্যে শুধুমাত্র গঙ্গা যা বাংলাদেশে পদ্মা নামে অভিহিত এর ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পানির হিস্যাভিত্তিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে যদিও চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ শুষ্ক মৌসুমে কখনো তার ন্যায্য হিস্যা পায়নি। তিস্তা নদীর পানির প্রবাহ বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের চুক্তি দীর্ঘকালব্যাপী চূড়ান্ত হয়ে থাকলেও তা ভারতের পক্ষ হতে অজানা কারণে বিলম্বিত হচ্ছে। অভিন্ন ৫৪টি নদীর প্রতিটি হতেই ভারত তার নিজ ভূ-খ-ে প্রবাহিত অংশে বিভিন্নভাবে বাঁধ দিয়ে একতরফাভাবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পানি শুষ্ক মৌসুমে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ভারতের নিকট হতে শুষ্ক মৌসুমে পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ার কারণে বাংলাদেশের ভূ-খ-ে নৌ চলাচল ও কৃষি মারাত্মকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তাছাড়া পানির প্রত্যাহারজনিত কারণে প্রবাহ ক্ষীণতর হওয়ায় পলি জমে নদীগুলো নাব্যতা হারিয়ে পরিবেশগতভাবে মারাত্মক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করছে। এ বিষয়গুলোর আশু সমাধান না হলে ভূ-প্রাকৃতিক পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানির বিপরীতে রপ্তানি খুবই কম। বাংলাদেশের এমন অনেক পণ্য রয়েছে যেগুলো সাশ্রয়ী বিবেচনায় ভারতের বাজারে প্রবেশাধিকার দেওয়া হলে এ বাণিজ্য বৈষম্যের বহুলাংশে হ্রাস ঘটবে। কিন্তু রাজ্য সরকার কর্তৃক আরোপিত বিভিন্ন অশুল্ক বাধার কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য প্রায়শই বিঘিœত হচ্ছে।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘ প্রতিক্ষীত পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর, স্থলসীমান্ত ও ছিটমহল বিরোধ নিরসন, সমুদ্র সীমানা চিহ্নিতকরণে সফলতা সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কের বার্তাবহ। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্নধর্মী সম্পর্কের ব্যাপকতায় অপরাপর যে সকল সমস্যা যেমন অভিন্ন নদীসমূহের পানির অসম হিস্যা, সীমান্ত হত্যা, মাদক প্রবেশ, চোরাচালান, সন্ত্রাসীদের আশ্রয়দান, বাণিজ্য বৈষম্য, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে সম্পাদিত ট্রানজিট চুক্তির বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা, কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের বৈরী মনোভাব প্রভৃতির অবসান না হলে বাংলাদেশ অব্যাহতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে।
ভারতের মূল ভূ-খ- হতে সেভেন সিস্টার্সে স্থল ও নৌপথে পণ্য পরিবহনে এবং চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে সেভেন সিস্টার্সের পণ্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যেভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশও নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে ট্রানজিট বিষয়ে এবং সেভেন সিস্টার্সে পণ্য রপ্তানি বিষয়ে ভারতের নিকট হতে অনুরূপ সাহায্য প্রত্যাশী।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আগামী ৭ এপ্রিল থেকে চারদিনব্যাপী ভারত সফরকালীন দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্প, কানেক্টিভিটি, অবকাঠামো, জ্বালানি ও প্রতিরক্ষাবিষয়ক ৩০টির মতো চুক্তি, সমঝোতা স্মারক এবং নথি স্বাক্ষর বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এ সফরের মধ্য দিয়ে হয়তো উপরোক্ত ৩০টি বিষয়ে চুক্তি, সমঝোতা স্মারক এবং নথি স্বাক্ষরিত হবে। কিন্তু উপরোক্ত ৩০টি বিষয়ের চেয়েও এ দেশের জনমানুষের নিকট যে বিষয়গুলোর সমাধান অতীব জরুরি তার উপেক্ষা ও অবজ্ঞায় অপরাপর বিষয়ে চুক্তি, সমঝোতা স্মারক ও নথি স্বাক্ষর জনআশা পূরণের ক্ষেত্রে যে অন্তরায় হিসেবে দেখা দিবে অন্তত এ বিষয়টি বিবেচনায় ভারতের নিকট হতে এ দেশের জনমানুষ প্রকৃত সুপ্রতিবেশীসুলভ আচরণ ও মনোভাব প্রত্যাশা করে।
সম্পাদনা: আশিক রহমান