ভুট্টো তখন খুবই বিবর্ণ ছিল এবং প্রচুর সিগারেট খাচ্ছিল
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাহাত মিনহাজ
সাইমন জন ড্রিং। যুদ্ধ সাংবাদিকতায় এক কিংবদন্তিতুল্য নাম। ১৯১৭ সালে ২৫ মার্চ কালো রাত্রিতে পাকবাহিনী যে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালায় সাইমনের প্রতিবেদনের মাধ্যমেই বিশ্ববাসী তা প্রথম জানতে পারে। ৩০ মার্চ টেলিগ্রাফ লিড আকারে প্রকাশ করে সাইমনের আলোড়ন সৃষ্টিকারী সেই প্রতিবেদন। ‘নেম অফ অব গড অ্যান্ড ইউনাইটেড পাকিস্তান’। যাতে সাইমন বর্ণনা করেন শুধু এক রাতেই পাকবাহিনী অন্তত সাত হাজার মানুষকে হত্যা করেছে।
প্রশ্ন: ২৫ মার্চ বিকেল বেলার পরিস্থিতি কেমন ছিল? কি জানতে পারছিলেন আপনারা?
সাইমন ড্রিং: সাত মার্চের ভাষণের পর সবকিছুই দ্রুত ঘটছিল। ইয়াহিয়ার সঙ্গে দফায় দফায় মিটিং হচ্ছিল। ভুট্টো ঢাকায় আসে। এর মধ্যে মুজিবের সঙ্গে আমার কয়েকদিন সাক্ষাৎ হয়। মধ্য মার্চের দিকে তার ৩২ নাম্বারের বাসায় গিয়ে আমি কয়েকবার দেখা করি। এতে আমার রিপোর্টিং করতে সুবিধা হচ্ছিল। ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনা নিয়ে মুজিব আশাবাদী ছিলেন। শেষ মুহূর্তে একটা সমঝোতা হবে, এমনটা ভাবছিলেন আওয়ামী লীগ নেতারা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই বিষয়গুলো কেউ বিশ্বাস করছিল না। আলোচনার মধ্যে প্রতিরোধ শুরু হয়ে যায়। সশস্ত্র প্রতিরোধও গড়ে ওঠে বিভিন্ন জায়গায়।
২৫ মার্চ বিকেলেই আমরা জানতে পারি ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেছে। তখন প্রায় ২০০ সাংবাদিক হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থান করছিল। তাদের সবার মধ্যেই গুঞ্জন ছিলÑ আলোচনা ব্যর্থ হবে। ইয়াহিয়া হয়তো সামরিক অভিযানের নির্দেশ দেবে। যাই হোক, ওইদিন বিকেলেই আমরা ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জানতে পারি। আমরা তখন পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম ‘পযরঢ়ং ধৎব ফড়হি’ (খুব খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে)। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। আজ রাতেই।
প্রশ্ন: ক্র্যাকডাউন বা মূল আক্রমণ কখন শুরু হলো?
সাইমন ড্রিং: তখন আনুমানিক রাত ১১টা। আমরা গুলির প্রচ- শব্দ শুনতে পাই। শেলিং-এর আওয়াজ। এই শব্দ আসছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে। এর কিছুক্ষণ পরেই আমরা যুদ্ধাস্ত্রের গর্জন শুনতে পাই রাজারবাগ এলাকা থেকে। ঢাকার সড়কগুলো তখন ফাঁকা ছিল। চারদিকে শুধুই গুলির শব্দ। পাকিস্তানি সেনারা কোথাও কোনো বাধার সম্মুখীন হয়নি। চারদিকে যা ঘটছিল তাতে মনে হচ্ছিল নির্বিচারে মানুষ হত্যা চলছে। সবকিছু দেখে মনে হচ্ছিল পাঞ্জাবি সেনারা এখানে এসেছে বাঙালি জাতিকে চরম এক শিক্ষা দিতে। রক্তাক্ত-ভীতিকর শিক্ষা।
প্রশ্ন: ওই রাতে আপনারা কি করলেন?
সাইমন ড্রিং: আমরা সারারাত হোটেলর ছাদ থেকে ছবি তুলছিলাম। ভিডিওগ্রাফাররা শ্যূটিং করছিল। আর যারা কক্ষে ছিল তারাও, জানালা দিয়ে সবকিছু দেখছিল। আমি ওইদিন সন্ধ্যার পরই মুজিবের বাসায় ফোন করি। জানার চেষ্টা করিÑ সে আসলে কি করতে যাচ্ছে। আমার সঙ্গে মুজিবের প্রেস সেক্রেটারি বাদশার কথা হয়। সে আমাকে জানায়, মুজিব বাসাতেই থাকবে। সে কোথাও যাবে না। তার মতো নেতার আত্মগোপনে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। বাদশা আমাকে জানায়, মুজিব বলেছেন তিনি আত্মগোপনে গেলে পাকিস্তানিরা পুরো ঢাকা শহর জ্বালিয়ে দেবে। তাই তিনি ৩২ নম্বর বাসাতেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর কয়েক ঘণ্টা পর প্রেস সেক্রেটারি বাদশা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আসেন। এরপর মধ্যরাতে আমি আবার মুজিবের বাসায় ফোন করি। তখন ফোনটি বিকল (ডেড) ছিল।
প্রশ্ন: পর দিন অর্থাৎ ২৬ মার্চ আপনারা কী করলেন?
সাইমন ড্রিং: আমরা সবাই সেদিন হোটেলেই ছিলাম। কেউ বের হতে পারিনি। আমরা হোটেলে থেকেই যে যার মতো সংবাদ পাঠানোর চেষ্টা করছিলাম। এরপর সকাল ১১টার দিকে আবার ফায়ারিং শুরু হলো। এবার গুলির শব্দ আসতে থাকল পুরাতন ঢাকার দিক থেকে। খুবই তীব্র গোলাগুলি আর শেলিংয়ের শব্দ আসছিল। কয়েক ঘণ্টা ধরে এই গোলাগুলি চলে। আমরা সবাই হোটেলে বসেছিলাম। সুইমিং পুলের পাশে অন্য কোনো জায়গায়Ñ অন্য দিকে ঢাকা পুড়ছিল।
প্রশ্ন: ওই হোটেলে তো জুলফিকার আলী ভুট্টো ছিল। তার সঙ্গে আপনার কি কোনো কথা হয়েছে?
সাইমন ড্রিং: এখানে একটা বিষয় আছে। ২৫ মার্চ রাতে, দিনের হিসেবে তখন ২৬ মার্চ রাত একটার দিকে আমি ভুট্টোর কক্ষে যাই। সে তার সহযোগিদের সঙ্গে বসেছিল। ভুট্টোর কক্ষটি ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ছিল। তিনি সোফায় বসে ছিলেন। তার সামনে এস্ট্রে ছিল। যা সিগারেটে ছাইয়ে ভরা। আমি পরিষ্কার বলতে পারি সে খুবই ভীত। সে খুবই বিবর্ণ ছিল। প্রচুর সিগারেট খাচ্ছিল।
আমার মনে হয়েছিল, সে আসলে জানে না কি ঘটতে যাচ্ছে। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়েও তিনি শঙ্কিত। পূর্বের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী বলা যায়, সে খুবই চালাক-চতুর প্রকৃতির মানুষ, কিন্তু সে সময় সে খুবই ভীত ছিল। পরদিন সকালে আমি তাকে হোটেল লবিতে দেখি। সে লিফটে নামছিল। তার সঙ্গে সহযোগী আর পুলিশ। সেখান থেকে তাকে সরাসরি একটা গাড়িতে তোলা হয়। এরপর সরাসরি বিমানবন্দর। আমি যখন তাকে শেষবার দেখি তখন তাকে সুখী দেখায়নি।
প্রশ্ন: ওইদিন পরের দিকে কি ঘটল?
সাইমন ড্রিং: বিকেল ৩-৪টার দিকে মেজর সিদ্দিক সালিক হোটেলে আসেন। সে গোয়েন্দা বিভাগের অফিসার ছিল। সে তখন সামরিক সরকারের প্রেস লিয়াজোঁ অফিসার ছিল। তখন আমি হোটেল লবির পাশে ছিলাম। আমি লবিতে এসে দেখলাম সব বিদেশি সাংবাদিক জড়ো হয়েছেন। তারা সালিকের কথা শুনছেন। তখন আমার এক বন্ধু আমাকে বলল, আমাদের চলে যেতে বলা হচ্ছে। আমি তা শুনে খুব অবাক হই। আমার বন্ধু বলে, আমাদের ব্যাগ গোছাতে বলা হয়েছে। কাল কারফিউ তুলে নেওয়া হবে। তখন আমাদের ঢাকা ত্যাগ করতে হবে। এতে আমি খুবই রাগান্বিত হই। ঢাকায় আমার প্রচুর বাংলাদেশি বন্ধু আছে। আমি তাদের খোঁজ-খবর করতে চেয়েছিলাম। ২৫ মার্চ রাতে তাদের কি পরিণতি ঘটেছে তা নিয়ে আমি শঙ্কিত ছিলাম। তখন আমি মেজর সিদ্দিকীর কাছে যাই। তাকে জিজ্ঞাসা করি, মেজর কি হচ্ছে, আমাদের কি চলে যেতে হবে। সে তখন বলল, তা না, তোমাদের যেতে হবে না। যাদের ইচ্ছা তারা যাবে। আর যারা থাকতে চায় তারা থাকবে। তখন আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি, যদি আমি থাকতে চাই, তাহলে কোনো সমস্যা আছে? তিনি বলেন, না না কোনো সমস্যা নেই! কিন্তু চতুর সিদ্দিক বলেন, এটা একটা গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি। এখানে থাকা খুবই ভয়ংকর। আমরা তোমাদের নিরাপত্তার কথাই ভাবছি। তোমাদের এখানে থাকা নিরাপদ নয়!
তখন আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি, কখন আমাদের যেতে হবে। কখন বাস আসবে? সিদ্দিক বলে, রাত ৯টার দিকে। এরপর আমি তাদের সামনেই আমার কক্ষে যাই। এমন ভাব করি যেন আমি ঢাকা ত্যাগ করতে চাই। ব্যাগ গুছাই। তারপর ইচ্ছাকৃতভাবে আমি সেই বাস মিস করি। তারপর আমি কোথাও লুকানোর পরিকল্পনা করি। প্রথমে হোটেলের ছাদে যাই। সেখানে এয়ারকন্ডিশনের জন্য বড় একটা রুম ছিল। আমি সেটার পেছনে লুকায়। সেখানে কয়েক ঘণ্টা লুকিয়ে থাকি। তখন একটা মিলিটারি ট্রাক হোটেলে আসে।
পাকিস্তানিরা একটা ভুল করেছিল। তারা সাংবাদিকদের গণনা করেনি। আমি ছাদ থেকে দেখলাম, আমার সব কর্মীকে ট্রাকে তোলা হচ্ছে। রাত ৯টার দিকে ট্রাকগুলো চলে যায়। কেউ আমার খোঁজ করেনি। আমি ছাদে প্রায় এক ঘণ্টার মতো অপেক্ষা করি। এরপর সতর্কতার সঙ্গে এক একটা ফ্লোর হয়ে হোটেল লবিতে নেমে আসি। লবি ম্যানেজার আতঙ্কিত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, তুমি এখানে রয়ে গেছ? তখন আমি জানতে পারি, আরও একজন এখানে রয়ে গেছেন। একজন ফ্রেঞ্চ ফটোগ্রাফার। এপি ফটোগ্রাফার মিশেল লরেন্ট। দোতলার একটা কক্ষে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়। তখন আমি মনে মনে খুশিই হই। মনে মনে ভাবি, একজন রিপোর্টার আর ফটোগ্রাফার মিলে ভালো কাজ করা যাবে।
তখন বাঙালি স্টাফরা আমাদের খুবই সহযোগিতা করেছিল। আমি তাদেরকে প্রথম পর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মনে করি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা আমাদের লুকিয়ে রেখেছিল, আমাদের রক্ষা করেছিল। সহযোগিতা করেছিল। তারা সবাই মিলে একটা পরিকল্পনা করেছিল। কিভাবে স্থান পরিবর্তন করে করে আমাদের লুকিয়ে রাখা যায়।
প্রশ্ন: তারপর আপনারা কি করলেন। ২৭ মার্চ সকালে কী করলেন?
সাইমন ড্রিং: হোটেলের স্টাফরা আমাদের জন্য একটা ভ্যানের ব্যবস্থা করল। আমি আর মিশেল সেই ভ্যানে চড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে রওনা হলাম। আমি একটা সাদা পাঞ্জাবি পরেছিলাম। মিশেলও পাঞ্জাবি পরেছিল। ছোট্ট সেই ভ্যানে করে আমরা রওনা হলাম। আমরা ওই ভ্যানে করে রাজারবাগ-ধানমন্ডি আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গেলাম। এরপর পুরাতন ঢাকা।